বেড়েছে ভোগ্যপণ্যের দাম
মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতার প্রভাব বাজারে
প্রকাশ | ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি রিপোর্ট
ঈদের পরেই বদলে গেছে রাজধানীর বাজারের চিত্র। রমজানে স্থিতিশীল থাকা বেশিরভাগ পণ্যের দাম এখন ঊর্ধ্বমুখী। যদিও বাজারে তেমন ক্রেতার চাপ নেই, পণ্যের চাহিদাও কম। কিন্তু গত ৭ দিনের ব্যবধানে বেড়েছে দেশীয় ও আমদানিসহ অতিপ্রয়োজনীয় অন্তত ১০টি পণ্যের দাম। এই তালিকায় রয়েছে- আলু, চিনি, আটা, ময়দা, ভোজ্যতেল, ডিম, পেঁয়াজ ও রসুনসহ মোটা চাল।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিশ্ব এখন ইরান-ইসরাইল যুদ্ধের আশঙ্কার মধ্যে রয়েছে, মূলত হরমুজ প্রণালি কেন্দ্রিক সরবরাহ চেইন নিয়ে বড় ধরনের সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের মতো আমদানিকারক দেশগুলো সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়তে পারে বলে অনেকই ধারণা করছেন। তাই আমদানি কমিয়ে দেওয়াসহ এলসি খোলার প্রবণতা হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে পণ্য মজুতের প্রবণতা তৈরি হয়েছে। যা বাজারে এক ধরনের সংকট তৈরি করছে।
এদিকে ঈদের ছুটি শেষ হলেও শুক্রবার রজধানীর বাজার ছিল অনেকটাই ফাঁকা, বন্ধ ছিল অনেক দোকানও। এ অবস্থায় হঠাৎ করেই একসঙ্গে এতগুলো পণ্যের দাম বৃদ্ধি নিয়ে বিস্ময় ছিল ক্রেতাদের মাঝে। শুধু খুচরা বাজারে নয়, গত এক সপ্তাহে পাইকারি বাজারেও বেড়েছে আলু, পেঁয়াজ, আটা, ময়দা, রসুনসহ বিভিন্ন মসলাপণ্যের দাম। এর মধ্যেই বৃহস্পতিবার বাড়ানো হয়েছে বোতলজাত ভোজ্যতেলের দাম। এছাড়াও অস্থিরতা দেখা দিয়েছে আমদানি পণ্যের বাজারেও।
চট্টগ্রামভিত্তিক খাদ্যশস্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বিএসএম গ্রম্নপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী বলেন, 'রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, হুথি বিদ্রোহীদের কারণে বৈশ্বিক পণ্যবাহী জাহাজ চলাচলে নৌ-রুট সীমিত হয়ে পড়েছে। এখন ইরান-ইসরাইল সংঘাতময় পরিস্থিতিতে মধ্যপ্রাচ্যে এ সংকট আরও ভয়াবহ আকার নেয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এর প্রভাব এখন শুরু না হলেও ব্যবসায়ীদের মধ্যে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। দেশের অভ্যন্তরীণ সংকটগুলো কাটিয়ে ওঠার আগেই ইরানের ইসরাইল আক্রমণ কিংবা ইসরাইল যদি ইরানে আক্রমণ শুরু করে তবে আমাদের আমদানি বাণিজ্যে কোনো না কোনোভাবে প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে ভোগ্যপণ্যের বাজার নিয়ে ব্যবসায়ীদের শঙ্কা এখন সবচেয়ে বেশি।'
এদিকে রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে ঈদের আগে ৩৫ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি হলেও এদিন বিক্রি হয়েছে ৬০ থেকে ৬৫ টাকা দরে। অর্থাৎ ৭ দিনের ব্যবধানে দাম বেড়েছে প্রায় ৩০ টাকা। মৌসুমের শুরুতেই আলুর এমন দাম নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে খোদ বিক্রেতারই। আমদানি পর্যায়ে দাম বৃদ্ধি ও কৃষকের আলুর মজুত কমতে থাকায় বাজারে সংকট শুরু হয়েছে বলেও জানান তারা।
এদিকে সরকার নির্ধারিত আলুর খুচরা দাম ২৯ টাকা হলেও শুক্রবার পাইকারি বাজারে বিক্রি হয়েছে ৪৪ টাকা দরে। ফলে তা খুচরা ৫৫ থেকে ৬০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। কারওয়ান বাজারের আলুর পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানান, ঈদের পর হিলি স্থলবন্দর এলাকায় আমদানিকৃত প্রতি কেজি আলুর দাম ১০-১২ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু ঈদের আগে এই আলু পাইকারিতে ২৮ টাকা এবং খুচরায় সর্বোচ্চ ৪০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে।
এদিকে গত মৌসুমে কৃষক পর্যায়ে প্রতি কেজি আলুর দাম ছিল সর্বোচ্চ ১৩ টাকা। এবার উৎপাদন খরচ বৃদ্ধিতে ১৩ টাকা ৯০ পয়সা নির্ধারণ করে কৃষি বিভাগ। কিন্তু প্রকৃত উৎপাদন খরচ আরও বেশি হওয়ায় কৃষি বিভাগ পরে তা ১৮ থেকে ১৯ টাকা নির্ধারণ করে। অন্যদিকে গত বছর একই সময় খুচরায় আলুর কেজি বিক্রি হয়েছে ২৮-৩০ টাকায়। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) বলছে, খুচরা বাজারে মার্চের তুলনায় এপ্রিলে আলুর দাম ২৬.৬৭ শতাংশ, আর বছরের ব্যবধানে ৬৩.৭৯ শতাংশ বেড়েছে।
গত এক সপ্তাহে খুচরা বাজারে রসুনের দাম বেড়েছে কেজিতে ২০ টাকা পর্যন্ত। এদিন প্রতি কেজি রসুন বিক্রি হয়েছে ২৩০ টাকা দরে। আমদানি বন্ধ থাকায় বাড়তির দিকে পেঁয়াজের দামও। মানভেদে ৫-১০ টাকা বেড়ে প্রতিকেজি বিক্রি হয়েছে ৭০ টাকা দরে। একই সময়ে প্রতিকেজি আটার দাম ৫২-৫৫ টাকা থেকে বেড়ে এদিন বিক্রি হয়েছে ৫৫-৬০ টাকায়।
ঈদের আগে সাধারণত মসলার বাজার চড়া থাকে, কিন্তু এবার ঈদের পর হঠাৎ বেড়েছে মসলার দাম। গত দুই সপ্তাহে পাইকারি বাজারে এলাচের দাম বেড়েছে কেজিতে ৭০০ টাকা। ধনিয়ার দাম কেজিতে ৩০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১৬৫ টাকা; হলুদের দাম কেজিতে ২০-২৩ টাকা বেড়ে লেনদেন ২৫৩-২৫৫ টাকায়। ১৫-২৫ টাকা বেড়ে প্রতি কেজি শুকনা মরিচ ৩০০-৩৫০ টাকা, ৮০ টাকা বেড়ে কিশমিশ ৫৩০ টাকা দরে। ফলে খুচরা বাজারে দাম এই হারে। এছাড়াও সপ্তাহ ব্যবধানে চালের দাম কিছুটা বেড়েছে। মাঝারি আকারের চালের কেজিতে ২-৩ টাকা বেড়ে বিক্রি হয়েছে ৫৫-৫৮ টাকা।
রমজানে আমদানি ও উৎপাদন পর্যায়ে ৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহার করে সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ১০ টাকা কম করা হয়েছিল। তবে রমজান শেষে ৫ শতাংশ ভ্যাট যুক্ত করায় বোতলজাত সয়াবিন তেলের লিটারে ৪ টাকা বাড়িয়ে ১৬৭ টাকা করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। সে হিসাবে ৫ লিটারের বোতলের দাম ৮০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮১৮ টাকা করা হয়েছে। তবে খোলা সয়াবিন তেলের দাম ২ টাকা কমিয়ে ১৪৭ টাকা ও আর পাম অয়েলের (খোলা) দাম সর্বোচ্চ ১৩৫ টাকা করা হয়েছে।
ঈদে আগ মুহূর্তে রাজধানীর বজারে মুরগির দাম কিছুটা বাড়লেও পরে তা কমে যায়। তবে তা আবার বেড়েছে। এদিন কেজিতে প্রায় ২০ টাকা বেড়ে প্রতিকেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয়েছে ২৩০ টাকা ও সোনালি ৩৩০ টাকা। একইভাবে বেড়েছে ডিমের দামও, প্রায় ১০ টাকা বেড়ে বিক্রি হয়েছে ১৩০ টাকা দরে।
এছাড়াও বাড়তি দাম রয়েছে চিংড়ি ও ইলিশ মাছের বাজারে। তবে অপরিবর্তিত রয়েছে অন্যান্য মাছের দাম। এদিন ৪শ' থেকে ৫শ' গ্রামের ইলিশের কেজি বিক্রি হয়েছে ১১শ' টাকার ওপরে। ৮শ' গ্রামের ওপর ইলিশ বিক্রি হয়েছে ১৬শ' এবং ১ কেজির ওপর ইলিশ বিক্রি হয়েছে ২৪ থেকে ২৮শ' টাকা দরে। মাঝারি আকারের রুইয়ের কেজি বিক্রি হয়েছে ৩২০ থেকে ৩৫০ টাকা, বড় কাতল ৪শ' টাকা, বড় পাঙ্গাশ ২২০ টাকা, চাষের কই (ছোট) ৩শ' টাকা, তেলাপিয়া ২২০ টাকা, শিং মাছ ৪শ' থেকে ৫শ' টাকা, শোল মাছ ৮শ' টাকা, পাবদা ৪শ' থেকে ৫শ' টাকা, ট্যাংরা মাছের কেজি আকার ভেদে ৬শ' থেকে ৭শ' টাকা, মলা মাছ ৫শ' টাকা, বাইলা ৮শ' টাকা, পোয়া মাছ ৩৫০ থেকে ৪শ' টাকা, মাঝারি আকারে বোয়াল ৫শ' থেকে ৬শ' টাকা, গুঁড়ামাছ ৩শ' টাকা, ছোট চিংড়ি ৫শ' টাকা, গলদা ৯শ' এবং রূপচাঁদা ১২শ' টাকা দরে।