মশাবাহিত রোগের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর রূপ ধারণ করছে ডেঙ্গু। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, প্রতি বছর বিশ্বের ৭ লাখ ২৫ হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয় মশা। এর মধ্যে ডেঙ্গু জ্বরে মারা যান ৩৬ হাজার মানুষ। সংস্থাটি এক সতর্ক বার্তায় জানিয়েছে, বিশ্বের অর্ধেক মানুষই রয়েছেন ডেঙ্গু ঝুঁকিতে। তাছাড়া বিশ্বের কোনো কোনো দেশে জরুরি জনস্বাস্থ্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে ডেঙ্গু। ২০২৩ সালে পৃথিবীর প্রায় ১৩০টি দেশে ডেঙ্গু সংক্রমণ ঘটেছিল। এর মধ্যে ৭টি দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ তীব্র হয়েছে। বাংলাদেশ ছাড়াও ডেঙ্গুর প্রকোপ তীব্র হওয়া দেশগুলোর তালিকায় রয়েছে ব্রাজিল, বুরকিনা ফাসো, ফিজি, পাকিস্তান, ফিলিপাইন ও ভিয়েতনাম।
এদিকে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, কীটতত্ত্ববিদ ও চিকিৎসকরা বলছেন, ২০১৩ সালের আগ পর্যন্ত, মার্চ-এপ্রিলে ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যেত। ২০১৩ সালের পর থেকে ২০১৬ পর্যন্ত দুয়েক মাস বাদ দিয়ে প্রায় সব মাসেই ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেছে। ২০১৬ থেকে এখন পর্যন্ত প্রতি মাসেই উলেস্নখযোগ্য সংখ্যক ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যাচ্ছে। এবারও ডেঙ্গু পরিস্থিতি গতবারের চেয়ে নাজুক হতে পারে। সংক্রমণ ও মৃতু্য সেই পূর্বাভাস দিচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ৮৬৫ জন। তাদের মধ্যে মারা গেছেন ২৩ জন। ২০২৩ সালে এ যাবৎকালের সর্বাধিক ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়। তবে তখন রোগী বেশি ছিল মে থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত। এ বছর জানুয়ারিতেই হাজারের বেশি রোগী পাওয়া গেছে, যা আগে কখনও পাওয়া যায়নি। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে রোগী পাওয়া যায় ১২৬ জন, ২০২১ সালের জানুয়ারিতে রোগী ছিল মাত্র ৩২ জন।
মশা নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার চলতি বছর ডেঙ্গুর ব্যাপকতা বেশি হওয়ার শঙ্কার কথা জানিয়েছেন। তিনি জানান, তিনি যে ফোরকাস্টিং মডেলটি তৈরি করেছেন, সেখানে দেখা যাচ্ছে ২০২৪ সালে ডেঙ্গু বেশ ক্ষতিগ্রস্ত করবে বাংলাদেশকে। ঢাকা ছাড়াও ঢাকার বাইরের কিছু জেলায়
\হবিগত বছরগুলোর সব হিসাব অতিক্রম করে ডেঙ্গু আঘাত করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম, বরিশাল, বরগুনা, কক্সবাজার, চাঁদপুর, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ ও খুলনায় ডেঙ্গুর ব্যাপক সংক্রমণ হতে পারে। এই জেলাগুলো ছাড়াও বাংলাদেশের ৬৪টি জেলায় ডেঙ্গু সংক্রমণ ঘটবে চলতি বছর।
অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, 'এপ্রিল মাসের পর থেকে যখন বৃষ্টিপাত শুরু হবে তখন থেকেই এডিস মশার প্রজনন বাড়তে থাকবে। বৃষ্টি হলে বাড়ি, বাড়ির আঙিনা অথবা বিভিন্ন জায়গায় আনাচে-কানাচে পড়ে থাকা পাত্রে পানি জমা হবে এবং সেই পানিতে এডিস মশা ডিম পেড়ে তার বংশবিস্তার ঘটাবে। কোনো একটি জায়গায় এডিস মশার ঘনত্বের ইনডেক্স বা ব্রোটো ইনডেক্স যখন ২০ অতিক্রম করবে; তখনই সেই এলাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে থাকবে। মৌসুমের শুরুতে পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা; বিশেষ করে এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংসের কার্যক্রম সঠিকভাবে করতে পারলে একে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।'
ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নের ওপর জোর দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বিশিষ্ট কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, 'কোনো দেশে যদি একবার ডেঙ্গুর সংক্রমণ দেখা দেয় তা পুরোপুরি নির্মূল করার উপায় নেই। তবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। নিয়ন্ত্রণের প্রধান উপায় হলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন। কিন্তু গ্রামে এসবের ঘাটতি রয়েছে। এ কারণে চলতি বছর গ্রামে ডেঙ্গু সংক্রমণ বাড়বে বলে ধারণা করা যায়। গ্রাম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে মশা নিধনের অভিজ্ঞতা, সম্পদ, জনবলের কোনোটাই নেই। ডেঙ্গুতে মৃতু্যহার বেশি হওয়ার পেছনের প্রধান কারণ অতিমাত্রায় কেন্দ্রীভূত স্বাস্থ্যব্যবস্থা। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা কার্যকর করতে না পারলে এই সংকট বাড়বে।'
পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে ডেঙ্গু রোগীদের সময়মতো ও যথাযথ চিকিৎসাসেবা দিতে গত মার্চ মাসে সারাদেশের সব হাসপাতাল প্রস্তুত রাখার নির্দেশ দিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন। ঈদের পর সোমবারও সচিবালয়ের নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, 'কারো যাতে ডেঙ্গু না হয় সেজন্য সবাইকে কাজ করতে হবে। আমরা হাসপাতালগুলোকে বলে রেখেছি। এখন চিকিৎসকরা ডেঙ্গু চিকিৎসা সম্পর্কে ভালোভাবে জানেন। স্যালাইনের যে সংকটের কথা ভাবা হয়েছে, সেটা নিয়েও বৈঠক করেছি। স্যালাইনের কোনো সংকট হবে না। তবে ডেঙ্গু না হোক; সেটা আমাদের সবার প্রার্থনা। বিপর্যয় না হওয়ার জন্য কী করতে হয়; সেটা আপনারা ভালো করে জানেন।'
জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ড. মো. গোলাম ছারোয়ার বলেন, 'আগে আমরা বলতাম মৌসুমের মধ্যে ডেঙ্গু সীমাবদ্ধ। কিন্তু এখন এটা অনেক বেড়ে গেছে। অর্থাৎ মৌসুমের বাইরেও মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন শীতকাল ছোট হয়ে গেছে। তাপমাত্রা, সূর্যের আলো, বাতাসের প্রবাহ সবকিছুই বর্তমান প্রেক্ষাপটে এডিস মশা জন্মানোর উপযোগী। এডিস মশাকে নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে সমন্বিত বাহক ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি দরকার। শুধু কেমিক্যালের ওপর নির্ভরশীল হলে চলবে না। আমাদের মনে রাখতে হবে, যেসব জায়গায় এডিস মশা জন্ম নেয় সেগুলো ধ্বংস করতে হবে। সবকিছু দিয়ে এই মশাকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করতে হবে।'
অন্যদিকে, ডেঙ্গু প্রতিরোধের ব্যবস্থা সম্পর্কে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলম একটি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, 'পুরো বছরজুড়েই সিটি করপোরেশনের মশক নিধন কার্যক্রম চলে। বিশেষ করে ডেঙ্গু মৌসুমে এই কার্যক্রমটা ব্যাপকভাবে চালানো হয়। এবার নতুন করে আমরা কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যেটা বাস্তবায়নের কাজ শুরু হবে ২২ এপ্রিল থেকে।'
তিনি জানান, তারা দেখেছেন, স্ত্রী এডিস মশার সবচেয়ে বেশি জন্ম হয় ডাবের খোসা, পরিত্যক্ত টায়ার, দইয়ের হাঁড়ি, চিপসের প্যাকেটসহ এই ধরনের জিনিসপত্রের মধ্যে। ফলে সর্বশেষ মিটিংয়ে তারা এবার এগুলো টাকা দিয়ে কিনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যেমন চিপসের খালি প্যাকেট এক টাকা; দইয়ের হাঁড়ি, ডাবের খোসা দুই টাকা; পরিত্যক্ত টায়ার ৫০ টাকা করে কিনবেন। ২২ এপ্রিল থেকে এই কার্যক্রম শুরু হবে। তারা সবার কাছ থেকেই এটা কিনবেন। তাদের ধারণা, এতে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি হবে এবং মশা নিয়ন্ত্রণে রাখতে এটা কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
'ডেঙ্গু :বৈশ্বিক পরিস্থিতি' শিরোনামে প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনে ১৩ কারণে সারা বিশ্বে ডেঙ্গুর সংক্রমণ বাড়তে দেখা যাচ্ছে বলে উলেস্নখ করা হয়। এগুলো হলো- এডিস মশা পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে, অপরিকল্পিত নগরায়ন ও মশার বসবাসের উপযোগী অন্যান্য কর্মকান্ড বাড়ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ডেঙ্গুর উপযোগী আবহাওয়া, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে থাকা ভঙ্গুর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, একই সঙ্গে ডেঙ্গুর একাধিক ধরনের বিস্তার, সুনির্দিষ্ট লক্ষণ না থাকায় ডেঙ্গু শনাক্ত করার সমস্যা, ল্যাবরেটরি ও পরীক্ষা ব্যবস্থার অপ্রতুলতা, কোভিড-১৯সহ একই সময়ে দীর্ঘস্থায়ীভাবে চলা প্রাদুর্ভাব, ডেঙ্গুর সুনির্দিষ্ট চিকিৎসার অনুপস্থিতি, ডেঙ্গু সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা ও আচরণ বিষয়ে তথ্য-উপাত্তের ঘাটতি, কমিউনিটি-কেন্দ্রিক স্বাস্থ্য উদ্যোগ ও মশা নিয়ন্ত্রণ কর্মকান্ডের ঘাটতি, মশার ওপর নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ দক্ষতার ঘাটতি, স্থায়ীভাবে অর্থায়নের ঘাটতিসহ অংশীজনদের কাজে সমন্বয়ের অভাব এবং মানুষ ও পণ্যের ব্যাপক চলাচল। বাংলাদেশের প্রসঙ্গ উলেস্নখ করে সংস্থার ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডে উলেস্নখযোগ্যভাবে ডেঙ্গু বেড়েছে। দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের কার্যকারিতা বাড়ানোর কৌশল নিয়ে নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে ১৫ এপ্রিল সোমবার থেকে শুরু হয়েছে কর্মশালা।