ঈদের আগে-পরে ও বৈশাখী উৎসবে ভালো ইনকাম করা যাবে- এ আশায় রোজার শেষভাগে ঢাকায় এসেছিলেন রংপুরের রিকশাচালক গিয়াস উদ্দিন। শেষ দুই রোজাতে ভালো আয় হলেও ঈদের দিন থেকে তীব্র গরমে প্রায় পিচ গলে যাওয়া ঢাকার রাস্তায় যাত্রী পাওয়া যেন ভাগ্যের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। দাবদাহের আঁচে পহেলা বৈশাখের আনন্দ-উৎসবেও ভাটা পড়ায় সেদিনও আশানুরূপ যাত্রীর দেখা পাননি তিনি। এর সঙ্গে 'মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা' হয়ে দাঁড়ায় শারীরিক অসুস্থতা।
রিকশাচালক গিয়াস উদ্দিন জানান, ঈদের ছুটি শেষে কর্মজীবী মানুষ ঢাকায় ফিরতে শুরু করেছে। বাস-লঞ্চ টার্মিনাল ও রেলস্টেশন থেকে এ সময় ভালো প্যাসেঞ্জার পাওয়ার কথা। কিন্তু প্রখর রোদ ও অসহনীয় গরমের কারণে কেউই যেন রিকশায় উঠতে চায় না। এরপর যাত্রী পেলেও টানা ট্রিপ বেশি দেওয়া কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। ২০-৩০ বার প্যাডেল মারার পর শরীর দরদর করে ঘামতে থাকে। আক্রান্ত হন ডায়রিয়ায়, শরীরে দেখা দেয় পানিশূন্যতা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বৈশাখ শুরুর ক'দিন আগ থেকেই প্রখর সূর্য কিরণে তেঁতে উঠেছে গোটা দেশ। কোথাও কোথাও তাপমাত্রার পারদ ছুঁয়েছে ৪০ ডিগ্রিতে। তবে গরম অনুভূত হচ্ছে আরও অনেক। বেলা কিছুটা বাড়তেই রিকশা-ভ্যান-ঠেলা চালক, নির্মাণ ও কৃষি শ্রমিকসহ কায়িক শ্রমে জড়িত নিম্ন আয়ের মানুষ অল্পতেই ঘেমে নেয়ে উঠছে। ক্লান্ত হয়ে পড়ছে দুপুর না গড়াতেই। এতে
তাদের দৈনিক আয় হু-হু করে কমছে।
প্রখর খরতাপে দীর্ঘসময় কাজ করার কারণে এসব শ্রমজীবী মানুষের শারীরিকভাবে অক্ষম হওয়ার ঝুঁকি দিন দিন বাড়ছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘসময় বেশি তাপমাত্রায় থাকলে লিভার, কিডনি, ইউরিনারি বস্নাডারে সমস্যা দেখা দিতে পারে। হতে পারে ডায়রিয়া, ফুসফুস, হৃদরোগ, এমনকি ক্যানসারও। এ ছাড়া অত্যধিক তাপমাত্রায় হিটস্ট্রোকের আশঙ্কা থাকে।
চিকিৎসকদের ভাষ্য, তীব্র গরমে দীর্ঘসময় কাজ করার কারণে মাত্রাতিরিক্ত ঘেমে শ্রমজীবী মানুষের শরীর থেকে প্রচুর পানি বের হয়ে যায়। এতে তাদের শরীরে পানির অভাব দেখা দেয়। এর ফলে জারণ-বিজারণ প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শরীরের মেটাবলিক সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে লিভার, কিডনি, খাদ্যনালির সেলগুলি ক্ষতিগ্রস্ত করে। আর এভাবে বেশিদিন চলতে থাকলে শরীরে মরণব্যাধি ক্যানসার বাসা বাঁধতে পারে।
এ ছাড়া পরিবেশ দূষণের কারণে আবহাওয়ার ব্যাপক পরিবর্তন হচ্ছে। পরিবেশ দূষণের কারণে বায়ুমন্ডলের ওজনস্তর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পৃথিবীতে প্রবেশ করছে সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি। এর জেরে প্রখর সূর্য কিরণ গায়ে লাগিয়ে দীর্ঘসময় কাজ করা শ্রমজীবী মানুষের ত্বকের ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
অন্যদিকে প্রচন্ড গরমে কাজ করার কারণে শারীরিকভাবে অক্ষম হওয়ার ঝুঁকিও বাড়ছে বলে দাবি করেন চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা। বৈশ্বিক উষ্ণতা শ্রমজীবী মানুষের ওপর কী প্রভাব ফেলছে, তা নিয়ে সম্প্রতি একটি গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশ করে বিজ্ঞান সাময়িকী নেচার কমিউনিকেশনস। 'ইনক্রিজড লেবার লসেস অ্যান্ড ডিক্রিজড অ্যাডাপটেশন পটেনশিয়াল ইন আ ওয়ার্মার ওয়ার্ল্ড' শীর্ষক যৌথ গবেষণাটি করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি, ডিউক ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনসহ স্বনামধন্য কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক।
নিবন্ধে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দিন দিন বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ছে। সঙ্গে বাড়ছে আর্দ্রতাও। পরিবেশে একই সঙ্গে উষ্ণতা ও আর্দ্রতা বেশি থাকা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। এমন গরম আবহাওয়ায় শরীরে ঘাম হয়। ঘাম শুকিয়ে শরীর দ্রম্নত শীতল হওয়ার সুযোগ কমে যায়। অতি উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ায় খোলা আকাশের নিচে কাজ করা কৃষক ও শ্রমিকদের শরীরে বিভিন্ন জটিলতা দেখা দেয়। তাদের উৎপাদনক্ষমতা কমে যায়। তারা বারবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থতা মৃতু্যঝুঁকিও তৈরি করে।
ওই নিবন্ধে অতি উষ্ণ আবহাওয়ার কারণে কর্মঘণ্টার ক্ষতির হিসাবও তুলে ধরা হয়। জানানো হয়, বেশি গরমের কারণে বিশ্বে প্রতিবছর গড়ে ২২ হাজার ৮০০ কোটি শ্রমঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। এর মধ্যে বাংলাদেশে বছরে ক্ষতির পরিমাণ ১ হাজার ৪০০ কোটি শ্রমঘণ্টা। মাথাপিছু হিসাবে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ২৫৪ শ্রমঘণ্টা। কর্মঘণ্টার ক্ষতির কারণ হিসেবে শ্রমিকদের হাঁপিয়ে যাওয়া, বারবার বিশ্রাম নেওয়ার প্রয়োজন দেখা দেওয়া ও অসুস্থ হয়ে পড়ার বিষয় উলেস্নখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, বৈশ্বিক আর্থিক ক্ষতির বড় অংশই হয় নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে, যেখানে শারীরিক পরিশ্রম বেশি করতে হয়। বিশেষ করে কৃষি ও নির্মাণ খাতে ক্ষতি বেশি। জলবায়ু পরিবর্তন রোধে দ্রম্নত কার্যকর ব্যবস্থা না নিতে পারলে আগামী দিনগুলোতে শ্রমঘণ্টার এবং শ্রমিকের শারীরিক ক্ষতি আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন দেশীয় গবেষকরা।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিজ্ঞানবিষয়ক সাময়িকী প্রসিডিংস অব দ্য ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেসে ৫০টি শহরের ওপর করা একটি সমীক্ষার ফলাফল তুলে ধরে বলা হয়, বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রভাবে ঢাকাবাসীর কর্মক্ষমতা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি কমেছে। অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে ঢাকায় প্রায় ৫ কোটি ৭৫ লাখ মানুষ (বিভিন্ন কাজে ঢাকার বাইরে থেকে আসাসহ) তাদের স্বাভাবিক কর্মক্ষমতার চেয়ে কম কাজ করতে পারছেন।
পরিবেশবিদ জানান, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ পৃথিবীর বেশির ভাগ শহরে জলাভূমি ও গাছপালা রক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে এবং বেশি বেশি গাছ লাগানো হচ্ছে। বাংলাদেশে কিছুই হচ্ছে না। উল্টো মহানগরের অপরিকল্পিত নগরায়ণ জেলা ও উপজেলা শহর এবং গ্রামে ছড়িয়ে পড়ছে। অথচ বাড়তি তাপমাত্রার সঙ্গে অভিযোজিত হতে কৃষকসহ শ্রমজীবী মানুষকে উৎসাহী ও দক্ষ করে তোলার কোনো উদ্যোগ নেই। দিনের মধ্যভাগের উষ্ণ সময়ে কাজ না করে অপেক্ষাকৃত শীতল সময়ে কাজ করার ব্যাপারে তাদের সচেতন করে তোলা হচ্ছে না। এতে একদিকে যেমন উৎপাদন কমছে, তেমনি শ্রমিকদের শারীরিকভাবে অক্ষম হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে।
গবেষকদের মতে, কাজের প্রচলিত সময়ে পরিবর্তন আনার মধ্য দিয়ে শ্রমঘণ্টা নষ্ট হওয়ার হার ৩০ শতাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব। তবে তাপমাত্রা আরও বাড়লে এটার সুফল না-ও মিলতে পারে। ওই পরিস্থিতিতে দিনের শুরুর দিকেও শ্রমিকদের বাড়তি তাপমাত্রায় কাজ করতে হতে পারে। তবে এতে যাতে তারা অসুস্থ হয়ে না পড়েন এ ব্যাপারে কৃষক ও শ্রমিকদের বাড়তি কিছু সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছেন গবেষকরা।
তাদের পরামর্শ, বাড়তি তাপমাত্রায় কাজ করার সময় শ্রমিকের শরীরে যাতে পানি ধরে রাখা যায়, তারা যাতে পানিশূন্যতায় না ভোগেন, তা নিশ্চিত করা জরুরি। এজন্য কাজের ফাঁকে কৃষক ও শ্রমিকদের ছায়ায় বসে পর্যাপ্ত সময় বিরতি দেওয়া ও বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ দিতে হবে।
আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, কয়েকদিনে দেশে গরমের তীব্রতা কমার আভাস নেই। আর তাপদাহে বাতাসে আর্দ্রতা কমে গেছে। বাতাসে আগের তুলনায় জলীয়বাষ্প কমে যাওয়ায় এ গরমে মানুষের হাত-মুখ শীতের মতো শুকিয়ে যাচ্ছে।
মঙ্গলবার রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, খিলগাঁও, কমলাপুর, বাড্ডা, রামপুরা, কারওয়ান বাজার ও ফার্মগেট এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, তীব্র গরমে অল্প কাজ বা হাঁটাচলা করে হাঁপিয়ে উঠছে অনেকে। তীব্র গরম থেকে বাঁচতে সুযোগ পেলেই শ্রমজীবীরা ছায়ায় গিয়ে জিরিয়ে নিচ্ছেন। তবে উচ্চমূল্যের বাজারে আয় কমে গেলে সংসার চালানো দুষ্কর হয়ে পড়বে এ শঙ্কায় রিকশা-ভ্যান চালক ও নির্মাণ শ্রমিকরা টানা কাজ করছেন। এতে অনেকে দ্রম্নত অসুস্থ হয়ে পড়ায় উল্টো তাদের মহাবিপাকে পড়তে হচ্ছে।
খিলগাঁও এলাকার একটি গাছের নিচে বিশ্রাম নেওয়া রিকশাচালক জমির মিয়া জানান, সকালের দিকে তিন ট্রিপ যাত্রী নিয়ে দেড়শ' টাকা রোজগার করেছেন। তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তায় যাত্রী কমে যাওয়ায় দুপুর পর্যন্ত তেমন কোনো ইনকাম হয়নি। প্রখর রোদ ও তীব্র গরমের কারণে প্যাডেলচালিত রিকশা চালিয়ে হাঁফিয়ে উঠেছেন। তাই কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিচ্ছেন।
জমির মিয়ার দাবি, গত কয়েকদিন ধরে তার দৈনিক আয় দেড়-দুইশ' টাকা কমে গেছে। এভাবে দাবদাহ দীর্ঘ হলে সপ্তাহে ৪-৫ দিন রিকশা চালানোও কঠিন হয়ে পড়বে।