সড়ক কেড়ে নিল ২০ প্রাণ
ফরিদপুরে একই পরিবারের ৪ জনসহ ১৪ জন ময়মনসিংহে ২, গোপালগঞ্জে ২, নাটোর ও জামালপুরে একজন করে নিহত হয়
প্রকাশ | ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি ডেস্ক
ফরিদপুরের ছত্রকান্দা গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে পাশাপাশি খোঁড়া হয়েছে চারটি কবর। এখানেই চিরনিদ্রায় শায়িত হবেন রাকিবুল হাসান মোলস্নাসহ পরিবারের চার সদস্য। বাড়ির উঠোনে রাখা চারটি মৃতদেহ ঘিরে রয়েছে শোকার্ত গ্রামবাসী ও আত্মীয়-স্বজনের ভিড়। সবার চোখ অশ্রম্নসজল। মৃতদেহের পাশে বসে আহাজারি করছেন অনেকে। পরিবারের চার সদস্যকে চিরতরে হারানো রাকিবুল হাসানের পিতা সত্তরোর্ধ তারা মোলস্ন্যার আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠেছে পরিবেশ। তিনি বলছেন- 'আমি কী অন্যায় করেছিলাম যে আমাকে এত শাস্তি পেতে হলো'। মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় পরিবারের চারজনকে হারানোর পাশাপাশি তার স্ত্রী গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাকে প্রবোধ দেওয়ার ভাষা কারও জানা নেই।
মঙ্গলবার সকালে ঈদুল ফিতর ও পহেলা বৈশাখের ছুটি শেষে পিতা-মাতা আর দাদির সঙ্গে গ্রাম থেকে রাজধানীতে ফিরে আসছিল দুই ভাই ছোট্ট আলবি রোহান ও আবু সিনান। কিন্তু তাদের বহনকারী পিকআপ ভ্যানের সঙ্গে একটি বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে তারা চারজনসহ নিহত হয়েছেন ১৪ জন। এদিকে সোমবার রাত থেকে মঙ্গলবার বিকাল পর্যন্ত ময়মনসিংহ, গোপালগঞ্জ. নাটোর ও জামালপুরে পৃথক দুর্ঘটনায় আরও ৬ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত ৪০ জন।
ফরিদপুর ও বোয়ালমারী (ফরিদপুর) প্রতিনিধি জানান, সকাল পৌনে আটটার দিকে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের ফরিদপুর সদরের দিগনগর তেঁতুলতলা এলাকায় যাত্রীবাহী বাস ও পিকআপভ্যানের সংঘর্ষে ১৪ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। এর মধ্যে একই পরিবারের চারজন। তারা হলেন- ফরিদপুরের বোয়ালমারীর ছত্রকান্দা গ্রামের রাকিবুল হাসান মোলস্না ওরফে মিলন (৪২), তার স্ত্রী শামীমা আক্তার ওরফে সুমি (৩৫) এবং তাদের দুই ছেলে আলবি রোহান (৯) ও আবু সিনান (৬)। দুর্ঘটনায় রাকিবুলের মা রাকিবুলের মা হুবাইয়া বেগম (৬০) ফরিদপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন
রয়েছেন। রাকিবুল ঢাকায় একটি সরকারি অফিসে লিফটম্যান হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
এ ছাড়া দুর্ঘটনায় নিহত ১০ জন হলেন- ফরিদপুরের বোয়ালমারীর মর্জিনা বেগম (৭৩), আলফা ডাঙ্গার তবিবুর খান (৫৫), পিকআপ চালক নজরুল ইসলাম (৩৫), জাহানারা বেগম (৪৫), সোনিয়া বেগম (২৮), ২ বছরের নুরানী, কহিনূর বেগম (৬০), শুকুরুন্নেছা (৭০), সূর্য বেগম (৪০) ও ইকবাল শেখ (২৫)।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা থেকে মাগুরাগামী ইউনিক পরিবহণের সঙ্গে ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা থেকে আসা একটি পিকআপ ভ্যানের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে ঘটনাস্থলে ১১ জন এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনজন মারা যান।
মঙ্গলবার বেলা ১টার দিকে রাকিবুল ও তার এক ছেলের লাশ প্রথমে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। পরে দেড়টার দিকে তার স্ত্রী শামীমা আক্তার ওরফে সুমি (২৩) ও আরেক সন্তানের লাশ বাড়িতে আনা হয়। এ সময় এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। খবর পেয়ে গ্রামবাসী এবং আত্মীয়স্বজন ছুটে আসেন।
রাকিবুলের ভাবি মরিয়ম হুসাইন বলেন, 'আজ সকাল ছয়টার দিকে রাকিবুল একটি পিকআপ ভ্যান নিয়ে এলাকার লোকজনের সঙ্গে ফরিদপুরের উদ্দেশে রওনা হন। পথে কানাইপুর এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় সপরিবার নিহত হন তিনি। এই পিকআপ ভ্যানের চালক ছিলেন আলফাডাঙ্গার কুসুমদী গ্রামের মো. নজরুল (৩২)। তিনিও দুর্ঘটনায় নিহত হন।'
প্রত্যক্ষদর্শীরা যা বললেন
দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী কানাইপুরের দিগনগর গ্রামের বাসিন্দা সাহানা বেগম বলেন, 'ঘটনাস্থলে আসার পর বাসটির একটি চাকা রাস্তার গর্তে পড়ে যায়। গাড়িটি আড়াআড়িভাবে সড়কের ওপর দাঁড়িয়ে যায়। এ সময় পিকআপ ভ্যানটি বাসটির মাঝামাঝি এসে আঘাত করলে এই দুর্ঘটনা ঘটে। পিকআপ ভ্যানটি দুমড়ে-মুচড়ে যায়।'
আরেক বাসিন্দা জানান, ঈদের আগের থেকে এ পর্যন্ত কমপক্ষে ১৫-২০টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। রাস্তা উঁচুনিচু হওয়ার কারণে এসব দুর্ঘটনা ঘটে।
লাল মিয়া নামে আরেকজন বলেন, 'ফরেস্ট অফিস থেকে তেঁতুলতলা পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার সড়ক দুর্ঘটনাপ্রবণ। রাস্তা দূর থেকে মসৃণ মনে হয়, কিন্তু কাছে এলে উঁচুনিচু ও ভাঙাচোরা বোঝা যায়। গত এক বছরে প্রায় ১৫০-এর বেশি ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে।
দুর্ঘটনাস্থল দিকনগর এলাকার বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলেন, 'এটা একটা দুর্ঘটনাকবলিত এলাকা। প্রতিদিনই ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটে। ঈদের আগে-পরে দুর্ঘটনা আরও বেড়েছে। আজ সকালে বিকট শব্দে ঘুম ভাঙে। রাস্তায় গিয়ে দুর্ঘটনার মর্মান্তিক দৃশ্যটি দেখি। সম্ভবত রাস্তা আঁকাবাঁকা ও রাস্তার বিভিন্ন স্থান ফুলে ওঠার কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে।'
তবে কারণগুলো অস্বীকার করে সড়ক ও জনপদ বিভাগের (গোপালগঞ্জ জোন) অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সাদেকুল ইসলাম বলেন, 'অভিযোগগুলো সঠিক নয়। সড়কের অবস্থা ভালো আছে। তবে কী কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে এ মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়। তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্তের পর বিস্তারিত তথ্য জানানো সম্ভব হবে।'
হাইওয়ে মাদারীপুর রিজিওনের পুলিশ সুপার শাহিনুল আলম খান বলেন, 'ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা হয়েছে। পাঁচজনের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্তপূর্বক বিস্তারিত তথ্য পরে জানানো যাবে।'
নিহত ও আহতদের আর্থিক সহায়তা ঘোষণা
জানা গেছে, ইউনিক পরিবহণের বাসটি ফিটনেস ছাড়পত্র ও ট্যাক্স টোকেন ছাড়াই চলাচল করছিল। এমনকি যে সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে, সেই রুটে চলাচলের অনুমোদনও ছিল না বাসটির।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) একটি সূত্রের বরাত দিয়ে দেশের একটি জাতীয় দৈনিকের অনলাইন জানিয়েছে, বাসটির চট্টগ্রাম-বগুড়া রুটে চালানোর অনুমোদন (রুট পারমিট) থাকলেও ২০২১ সালের ডিসেম্বরের পর থেকে তা আর হালনাগাদ করা হয়নি। সর্বশেষ ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ট্যাক্স টোকেন হালনাগাদ করেছিল বাসটি, যার মেয়াদ শেষ হয় ২০২০ সালের নভেম্বরে।
অন্যদিকে যে পিকআপের সঙ্গে বাসটির সংঘর্ষ হয়, পণ্য পরিবহণের সেই পিকআপটিও বিধি লঙ্ঘন করে যাত্রী পরিবহণ করছিল। পুলিশ জানিয়েছে, হতাহতরা সবাই পিকআপের যাত্রী ছিলেন।
দুর্ঘটনার পরপরই ফরিদপুর জেলা প্রশাসক কামরুল আহসান তালুকদার জানান, দুর্ঘটনায় নিহতদের স্বজনদের ৫ লাখ, আহতদের ৩ লাখ এবং মরদেহ দাফনের জন্য আরও ২০ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে।
এদিকে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে ঘটে যাওয়া এ প্রাণহানির ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছে নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটি। সংগঠনের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, ট্রাক-পিকআপসহ পণ্যবাহী যানবাহনে যাত্রী পরিবহণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তা সত্ত্বেও দুর্ঘটনাকবলিত গাড়িটি প্রশাসনের নাকের ডগায় প্রায় ২৫-৩০ জন যাত্রী নিয়ে ফরিদপুরের বোয়ালমারী থেকে ঢাকায় আসছিল। নিহত সবাই পিকআপের যাত্রী ছিলেন। সুতরাং পুলিশ, হাইওয়ে পুলিশ ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) এই দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির দায় এড়াতে পারে না।
নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির নেতারা নিহত পরিবারগুলোকে উপযুক্ত আর্থিক ক্ষতিপূরণ প্রদান এবং আহতদের উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণ ও চিকিৎসা শেষে পুনর্বাসনের জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবি জানান। এ ছাড়া বিবৃতিতে নিহতদের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা, শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে আহতদের দ্রম্নত সুস্থতা কামনা করা হয়।
নিহত ২, আহত ৩৫
তারাকান্দা (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি জানান, মঙ্গলবার সকাল আটটার দিকে শেরপুর-হালুয়াঘাট সড়কে উপজেলার রামচন্দ্রপুর নামক স্থানে দুই যাত্রীবাহী বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে দুজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অন্তত পঁয়ত্রিশ জন।
তারাকান্দা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী বলেন, 'দুটি বাসের সংঘর্ষে অজ্ঞাত দুজন ঘটনাস্থলেই নিহত হয়েছেন। একজন মহিলার লাশ উদ্ধার করে থানায় নেওয়া হয়েছে। আরেকজনের লাশ বাসের নিচে চাপা পড়ে আছে। তার লাশটি উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। ঘটনাস্থলে ফুলপুর ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা উদ্ধার তৎপরতা চালাচ্ছেন। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। নিহতদের পরিচয় এখনো জানা সম্ভব হয়নি।'
একজন নিহত, আহত ৩
নাটোর প্রতিনিধি জানান, বড়াইগ্রামে মোটর সাইকেল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাছের সঙ্গে ধাক্কা লেগে আকিব হাসান (১৪) নামে এক স্কুলছাত্রের মৃতু্য হয়েছে। এ সময় মোটর সাইকেলের অপর দুই আরোহী গুরুতর আহত হন। সোমবার সন্ধার পরে উপজেলার বড়াইগ্রাম কালিবাড়ী এলাকায় ওই দুর্ঘটনা ঘটে।
বড়াইগ্রাম থানার অফিসার ইনচার্জ শফিউল আযম ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
ইজিবাইক উল্টে শিশু নিহত
মেলান্দহ (জামালপুর) প্রতিনিধি জানান, মঙ্গলবার দুপুরে মেলান্দহে সড়ক দুর্ঘটনায় আয়াত (৬) নামে এক শিশুর মৃতু্য হয়েছে। উপজেলার মালঞ্চ বাজারে এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত আয়াত মালঞ্চ গ্রামের দক্ষিণ পাড়ার মো. আমির হামজার ছেলে।
স্থানীয়রা জানান, দুপুরে আমির হামজা ও তার পরিবারের লোকজন আয়াতের চাচার বিয়ের পাত্রী দেখতে বাড়ি থেকে বের হয়ে স্থানীয় মালঞ্চ বাজার মোড়ে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। এ সময় একটি ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উল্টে শিশু আয়াতের ওপর পড়ে। এতে আয়াত মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত হয়। তাকে উদ্ধার করে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে তার মৃতু্য হয়।
মেলান্দহ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. রাজু আহাম্মদ জানান, দুর্ঘটনায় একজন শিশু নিহত হয়েছে। এখনো কোনো অভিযোগ পাইনি। পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত ২
গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, শহরতলী ও কোটালীপাড়ায় পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় ২ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে মঙ্গলবার সকালে গোপালগঞ্জ-কোটালীপাড়া সড়কে মাঝবাড়ি এলাকায় মোটর সাইকেলের ধাক্কায় আলিম বিশ্বাস (৬২) নামে এক বৃদ্ধ নিহত হন। এ ছাড়া এর আগের দিন রাতে শহরতলীর রেলস্টেশন এলাকায় গোপালগঞ্জে মোটর সাইকেল ও ইজিবাইকের মুখোমুখি সংঘর্ষে আহত মোটর সাইকেল চালক ও কলেজ শিক্ষার্থী ছাত্র রায়হান মোলস্না (১৮) নিহত হন।