ফাঁকা সড়কে বেপরোয়া গতিতে মোটর সাইকেল চালাতে গিয়ে ঈদ ও এর আগের দিন মারা গেছেন ৩১ জন। এর মধ্যে রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে ৬ জনের মৃতু্য হয়েছে। বিভিন্ন জেলায় নিহত হয়েছে আরও ২৫ জন। এ ছাড়া ঈদযাত্রায় সড়ক-মহাসড়কে নিয়ন্ত্রণহীন গতির বাস-মিনিবাস, মাইক্রো, প্রাইভেটকার ও থ্রি-হুইলারসহ বিভিন্ন যানবাহনের মুখোমুখি সংঘর্ষে কেড়ে নিয়েছে শতাধিক প্রাণ। সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে মৃতু্যর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন দুই শতাধিক নারী-পুরুষ ও শিশু। পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন দেড় শতাধিক মানুষ।
সড়ক পথের নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যানবাহনের বেপরোয়া গতি নিয়ন্ত্রণে এবারও ঈদযাত্রায় মহাসড়কে গতিসীমার সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে এবং স্পিডগানের মতো মান্দাতার আমলের পদ্ধতি ব্যবহার করে দায় সেরেছে প্রশাসন। ফলে সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির ঘটনা কোনোটাই কমেনি। উন্নত দেশে মহাসড়কের সঙ্গেই প্রযুক্তি সমন্বয় করা হয়। অনেক দেশে রাস্তার সঙ্গে ম্যাগনেটিক সেন্সর থাকে। এটা গাড়ির সংখ্যা, ধরন ও এদের গতি নির্ণয় করতে পারে। এর মাধ্যমে যানবহনের রিয়েলটাইম মনিটরিং করা সম্ভব হয়। বেপরোয়া গতি নিয়ন্ত্রণে রাস্তায় রাম্বল স্ট্রিপ দেওয়া হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন উৎসবে সড়ক-মহাসড়কে গাড়ির চাপ বাড়লে চালকরা যাতে বেপরোয়া গতিতে যানবাহন চালাতে না পারে এজন্য নানা উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। অথচ প্রতিবছর ঈদে সড়ক-মহাসড়কে মৃতু্যর মিছিল দীর্ঘ হলেও এবারও যানবাহনের বেপরোয়া গতি নিয়ন্ত্রণে কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি।
সড়ক ও পরিবহণ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেপরোয়া গতিতে যানবাহন চালনার কারণেই দেশে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। বিশেষ করে ঈদসহ বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসবের ছুটিতে এ সংখ্যা উচ্চ লাফে বাড়ে। এরই ধারাবাহিকতায় এবারের ঈদযাত্রা শুরুর পর থেকে সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির ঘটনা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে শুরু করে। অথচ বেপরোয়া গতি তদারকিতে লোকবল ও কারিগরি সক্ষমতার ঘাটতির কাটা বছরের পর বছর একই জায়গায় আটকে আছে। ফলে সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে
আনার উদ্যোগ বরাবরের মতো এবারও ব্যর্থ হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশের মহাসড়কগুলোতে সর্বোচ্চ গতিসীমা কত তার নির্দেশক চিহ্ন দেওয়া থাকে। যানবাহন গতিসীমা অতিক্রম করছে কি না তা দেখার দায়িত্বে থাকে হাইওয়ে পুলিশ। এরপরও মহাসড়কে কমছে না দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, গতিসীমা নজরদারির ব্যবস্থাপনা আধুনিকায়ন না করা ও সনাতনী পদ্ধতিতে চলায় এ অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের প্রথম তিন মাসের তুলনায় চলতি বছর সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে ৪৩ দশমিক ৯৫ শতাংশ এবং মৃতু্য বেড়েছে ৩০ শতাংশ। এর পেছনে দুর্ঘটনা প্রতিরোধে উদ্যোগ বাস্তবায়নে কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতাকে দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত এক হাজার ৪৬৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় এক হাজার ৩৬৭ জন নিহত ও এক হাজার ৭৭৮ জন আহত হয়েছেন। ২০২৩ সালের প্রথম তিন মাসে দুর্ঘটনার সংখ্যা ছিল এক হাজার ১৭টি এবং এতে এক হাজার ৫১ জন নিহত ও এক হাজার ৪৪০ জন আহত হন।
এদিকে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে ২০২৩ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ৬ হাজার ৫২৪ জন। ২০২২ সালে ৬ হাজার ৮২৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন ৭ হাজার ৭১৩ জন। ২০২১ সালে তিন হাজার ২০৪টি দুর্ঘটনায় তিন হাজার ৭৭৬ জন এবং ২০২০ সালে দুই হাজার ৬৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় তিন হাজার ৩৫৮ জন প্রাণ হারান। এসব দুর্ঘটনার বেশিরভাগই সংঘটিত হয়েছে বেপরোয়া গতিতে পরিবহণ চালনার কারণে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এআই মাহবুব উদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশে মোট মোটরযানের ৭১ শতাংশ মোটর সাইকেল। এর চালকদের বিরাট অংশ কিশোর ও যুবক। এর মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা প্রবল। দেশে দুর্বাত্তায়িত রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতায় কিশোর-যুবকরা বেপরোয়া মোটর সাইকেল চালিয়ে নিজেরাই দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হচ্ছে এবং অন্যদের আক্রান্ত করছে। মোটর সাইকেলের ধাক্কায় পথচারী নিহতের ঘটনাও দিন দিন বাড়ছে।
জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত রয়েছে, মহাসড়কে সর্বোচ্চ গতিসীমা হবে ৮০ কিলোমিটার। মহাসড়কের সব জায়গায় এই গতি ওঠানো যাবে না। কারণ কিছু জায়গায় বাজার, পথচারী পারাপারের জায়গা আছে। আর শহরের মধ্যে সর্বোচ্চ গতিসীমা হচ্ছে ৪০। কিন্তু এটা মানা হচ্ছে না।
পুলিশের সূত্র জানিয়েছে, মহাসড়কে গতিসীমা নিয়ন্ত্রণে সড়কের পাশে অবস্থানরত পুলিশ সদস্যরা একটি যন্ত্র ব্যবহার করেন, যেটি গাড়ির টায়ারের দিকে তাক করিয়ে রেখে গাড়ির গতি মাপা হয়। কোনো গাড়ি গতিসীমা অতিক্রম করলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা সামনের চেকপোস্টকে গাড়িটির বিষয়ে নির্দেশনা দেন। পরে অপরাধ অনুযায়ী মামলা দেওয়া হয়।
হাইওয়ে পুলিশ জানায়, মহাসড়কে বেপরোয়া গতি নিয়ন্ত্রণে স্পিড গানের ব্যবহার করা হয়। এটি ব্যবহার করে গতি তদারকিতে কার্যকর ভূমিকা রাখা সম্ভব। স্পিডগান ব্যবহার করে বেশি গতিতে গাড়ি চলাচলের বিষয়টি নজরদারি করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে অতিরিক্ত গতিতে চালানোর অভিযোগে মামলা এবং জরিমানা করা হচ্ছে।
কিন্তু বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মহাসড়কে গতিসীমার সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রাখা ও স্পিডগানের মতো সনাতনী পদ্ধতি ব্যবহার করে গাড়ির বেপরোয়া গতি ও প্রাণহানির কোনোটাই কমানো সম্ভব হয় না।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডক্টর মো. হাদিউজ্জামান মনে করেন, হাইওয়ে পুলিশের বেপরোয়া গতি নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা আসলে নেই। তিনি বলেন, সক্ষমতা না থাকার কারণ হচ্ছে লোকবলের ঘাটতি যেমন, তেমন কারিগরিভাবে তাদের সক্ষমতারও ঘাটতি আছে। পৃথিবীর কোনো দেশেই একেবারে ম্যানুয়ালি এভাবে গতির তদারকি করা হয় না। কারণ সড়ক বাড়ছে, যানবাহন বাড়ছে। এর সঙ্গে পালস্না জনবল বাড়ানো সম্ভব নয়। এজন্য পৃথিবীর সবদেশে কারিগরি সহায়তা নেয়।
তিনি জানান, রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে হাতে রাডার গান ধরে রেখে সনাতনী পদ্ধতিতে গতি নির্ণয় এগুলো এখন আর চলে না। এখন আসলে মহাসড়কের সঙ্গেই প্রযুক্তি সমন্বয় করা থাকে। অনেক দেশে সড়কে রাস্তার সঙ্গে ম্যাগনেটিক সেন্সর থাকে। এটা গাড়ির সংখ্যা, ধরন ও এদের গতি নির্ণয় করতে পারে। এটা দিয়ে যানবাহন রিয়েলটাইম মনিটরিং করা সম্ভব। অনেক ধরনের সেন্সর দিয়ে এখন রিয়েল টাইম মনিটরিং হয়। রিয়েল টাইম সেন্স করার পর ব্যবস্থাপনায় যেতে হবে। এর মাধ্যমে চালককেও এই সময়ের মধ্যে সতর্ক করা যায়।
তিনি জানান, আমাদের দেশে সাইনবোর্ডে গতির সীমা থাকে। কিন্তু অনেক চালক নিরক্ষর বা অসচেতন হওয়ায় তারা তা বুঝতে পারেন না। এজন্য তারা যাতে গতি কমাতে বাধ্য হন এরকম ব্যবস্থাপনা গ্রহণ জরুরি। সেক্ষেত্রে সড়কের নকশা এমনভাবে প্রণয়ন করতে হবে যাতে চালক চাইলেও গতি বাড়াতে পারবেন না।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বেপরোয়া গতি নিয়ন্ত্রণে রাস্তায় রাম্বল স্ট্রিপ দেওয়া যেতে পারে। চালক যখন এটার ওপর দিয়ে চালাবে তখন ঝাঁকি লাগবে। এটা রাস্তায় কিছুদূর পর পর দেওয়া হলে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি পরিচালনাকারী চালকরা সতর্ক হবেন। তারা বুঝতে পারবেন তিনি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় আছেন বা ডানে-বায়ে স্কুল আছে ইত্যাদি। আর ভারী যানবাহনের ক্ষেত্রে স্পিড গভর্নর লাগাতে হবে। একটা সুয়ো মোটো রুলের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের ও এরকম একটি নির্দেশনা ছিল। স্পিড গভর্নর হচ্ছে গাড়ির জ্বালানি ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে গাড়ির সর্বোচ্চ গতি নিয়ন্ত্রণ।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এ আই মাহবুব উদ্দিন আহমেদ বলেন, বেপরোয়া গতি এবং চালকদের অনিরাপদ জীবনযাপন দুর্ঘটনার অন্যতম বড় কারণ। ফিটনেস ছাড়া যানবাহন সড়কে চললেও প্রশাসনের নজরদারি নেই। বাংলাদেশে অকার্যকর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা চলে আসছে বছরের বছর ধরে। ফলে সড়কে প্রাণহানি কমার আশা করার কারণ নেই।
এদিকে বরাবরের মতো এবারও ঈদযাত্রায় সড়কে বেপরোয়া গতি নিয়ন্ত্রণে স্পিডগানের ব্যবহার বাড়ানো হচ্ছে জানিয়ে হাইওয়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, ঈদযাত্রা নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন এবং দুর্ঘটনায় মৃতু্য কমাতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হচ্ছে। মহাসড়কের ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হচ্ছে। বেপরোয়া গতি নিয়ন্ত্রণে স্পিডগান নিয়ে পুলিশ সদস্যরা মাঠে রয়েছে। যদিও এতে বড় কোনো সুফল বয়ে আনবে বলে মনে করছেন না সড়ক ও পরিবহণ বিশেষজ্ঞরা।
সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিরা বলছেন, বেপরোয়া গতির কারণে ঈদযাত্রায় দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বেশি ঘটে। ঈদকে কেন্দ্র করে স্বল্প সময়ে অনেক বেশি মানুষ যাতায়াত করায় গণপরিবহণের ওপর চাপ বাড়ে। দূরের যাত্রায় মোটর সাইকেল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এরপরও অনেকেই মোটর সাইকেলে গ্রামের বাড়ি যান। এ ছাড়া মহাসড়কে ধীরগতির যানবাহন চলাচল, চালকদের বিরতিহীন গাড়ি চালানো, বেপরোয়া গতি দুর্ঘটনার বড় কারণ। ঈদের ছুটির সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরও আইন প্রয়োগেও দুর্বলতা থাকে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশন জানায়, ঈদের সময় মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যাতায়াত করেন। সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ বেপরোয়া গতি। যানবাহনের ৬০ কিলোমিটার গতির পর প্রতি ৫ কিলোমিটার গতি বৃদ্ধির কারণে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ে ২ থেকে ৪ গুণ।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, নিরাপদ সড়ক নিয়ে নানা সময় যে আলোচনা হয়েছে, সেগুলোর বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে। ঈদযাত্রায় দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি কমানোর মূল বিষয় গতি নিয়ন্ত্রণ। গতিসীমা নিয়ন্ত্রণে রাখা গেলে দুর্ঘটনা অনেকটা কমানো সম্ভব।