বিআইডবিস্নউটিএ'র তথ্য
নৌ ট্রাফিক আইন না মানায় সদরঘাটে ৫ জনের মৃতু্য
প্রকাশ | ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
গাফফার খান চৌধুরী
এমভি ফারহানের সারেং লঞ্চটি ঘাটে ভিড়ানোর সময় নৌ ট্রাফিক আইন না মানায় ঈদের দিন সদরঘাটে মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় একই পরিবারের তিনজনসহ পাঁচজনের মৃতু্য হয়েছে। এছাড়া ঘাটে লঞ্চ ভেড়ানোর ক্ষেত্রে নৌ ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা দেখভাল করার দায়িত্বে থাকা সার্ভেয়ারদের দায়িত্ব পালনে গাফিলতিও এ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীন নৌ পরিবহণ কর্তৃপক্ষের তদন্তে প্রাথমিকভাবে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীন নৌ পরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআইডবিস্নউটিএ) সূত্রে জানা গেছে, নৌ পথে ট্রাফিক আইন আছে। সেই আইন মানা নৌ পথে চলাচলকারী প্রতিটি জলযানের মেনে চলা বাধ্যতামূলক। শুধু নৌ পথে নয়, প্রতিটি লঞ্চ টার্মিনালও রয়েছে নৌ ট্রাফিক আইনের মধ্যে। আইন অনুযায়ী কোনো লঞ্চ পন্টুনে ভিড়ানোর আগে অবশ্যই লঞ্চ কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে বা সারেংয়ের নির্দেশে বার বার মাইকিং করতে হবে। মাইকে লঞ্চের নাম বলা হবে। লঞ্চের আকার ও কত তলাবিশিষ্ট লঞ্চ তা ঘোষণা দিতে হবে। লঞ্চের প্রকৃত যাত্রী ধারণ সক্ষমতা সম্পর্কেও মাইকিং করতে হবে। লঞ্চটি কোথা থেকে কয়টার সময় ছেড়ে কোথায় যাবে- তাও জানাতে হবে মাইকে। লঞ্চটি বা জলযানটি কত নম্বর পন্টুনে ভিড়বে তা মাইকে আগাম ঘোষণা দিতে হবে। লঞ্চটি ঘাটে ভিড়ানোর আগে পন্টুনে কোনো জলযান থাকলে, ওইসব জলযানকে নিরাপদ জায়গায় সরে গিয়ে লঞ্চটি ঘাটে ভিড়ানোর সুযোগ করে দিতে হবে। কারণ প্রতিটি লঞ্চ কত সময় আগে ঘাটে ভিড়বে তা আগ থেকেই নির্ধারণ করে দেয়
\হবিআইডবিস্নউটিএ- কর্তৃপক্ষের ট্রাফিক বিভাগ।
সূত্রটি বলছে, সাধারণত যাত্রীর চাপ কম থাকলে অনেক সময় আধা ঘণ্টা পরেও লঞ্চ ঘাট ছাড়লেও কোনো সমস্যা হয় না। কিন্তু ঘটনার দিন ছিল ঈদ। স্বাভাবিক কারণেই যাত্রীদের চাপ ছিল বেশি। এজন্য প্রতিটি জলযানকে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অবশ্যই ঘাট ছাড়তে হবে। লঞ্চ নির্ধারিত সময়ে ঘাটে ভিড়ানো এবং ছেড়ে যাওয়ার বিষয়টি দেখভাল করেন সেখানে কর্মরত বিআইডবিস্নউটিএ'র সার্ভেয়াররা।
বিআইডবিস্নউটিএ'র একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে যায়যায়দিনকে বলেন, ঘটনার দিন এমভি তাসরিফ-৪ ও এমভি পূবালী-১ নামের বহুতল লঞ্চ দুটি মোটা ও ভারী রশি দিয়ে সদরঘাটের ১১ নম্বর পন্টুনে বাঁধা ছিল। নির্ধারিত সময়ে লঞ্চ দুটির ঘাট ত্যাগ করার কথা ছিল। কিন্তু বেশি যাত্রীর আশায় সার্ভেয়ারদের হয়তো ম্যানেজ করে লঞ্চ দুটি কিছুটা বেশি সময় পন্টুনে অবস্থান করছিল, যা সম্পূর্ণ বেআইনি।
ওই কর্মকর্তা বলছেন, এছাড়া একই পন্টুনে ভিড়ানোর ক্ষেত্রে এমভি ফারহান-৬ নামের লঞ্চটিও ট্রাফিক আইন অমান্য করেছে। ঘাটে ভিড়ানোর আগে বার বার মাইকে ঘোষণা দেওয়ার কথা থাকলেও লঞ্চের দায়িত্বরত সারেংসহ অন্যরা সেটি মানেননি। মাইকে পন্টুন থেকে লঞ্চ সরিয়ে অন্য এমভি ফারহানকে জায়গা ছেড়ে দেওয়ার কথা মাইকে বার বার ঘোষণা করার কথা ছিল। কিন্তু তা যথাযথভাবে পালিত হয়নি। এছাড়া লঞ্চ খুবই আস্তে আস্তে বা ধীরগতিতে ঘাটে ভিড়ানোর কথা। সেটিও মানেননি এমভি ফারহান-৬ নামের জলযানটি। লঞ্চটি অত্যন্ত তাড়াহুড়ো করে দ্রম্নতগতিতে ঘাটে ভিড়ানোর চেষ্টা করেছেন সারেং। সারেং এমভি ফারহান-৬ নামের লঞ্চটি এমভি-তাফরিক-৪ ও এমভি পূবালী-১ লঞ্চের মাঝে থাকা অল্প পরিমাণ জায়গা দিয়েই ভেতরে প্রবেশ করিয়ে দেয়। লঞ্চে প্রচুর গতি থাকা পূবালী লঞ্চ একটি দিকে জায়গা থাকায় স্বাভাবিক কারণেই চেপে গেছে বা সরে গেছে। কিন্তু এমভি-তাফরিফ-৪ নামের লঞ্চটি ঘেষা অন্য ভারী ও ভিড় জলযান থাকা তা আর চাপতে পারেনি। এমভি-ফারহান লঞ্চের প্রচন্ড গতির কারণে তাফরিফ লঞ্চটি চাপতে না পেরে মোটা রশি প্রচন্ড গতিতে ছিঁড়ে যায়। ছিঁড়ে যাওয়া রশি গিয়ে আঘাত হানে পন্টুনে থাকা যাত্রীদের। আর তাতেই পাঁচজনের মৃতু্য হয়।
ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া কর্মকর্তা শাহজাহান শিকদার যায়যায়দিনকে বলেন, খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকারীরা ঘটনাস্থলে গিয়ে নিহতদের লাশ উদ্ধার করে। মূলত দুটি লঞ্চের মাঝ বরাবর প্রচন্ড গতিতে এমভি ফারহান নামের লঞ্চটি জোরপূর্বক প্রবেশ করিয়ে দেওয়ার কারণেই হতাহতের ঘটনাটি ঘটেছে বলে সার্বিক পর্যালোচনায় মনে হয়েছে।
এ ঘটনায় বিআইডবিস্নউটিএ'র ঢাকা নদী বন্দরের নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের যুগ্ম পরিচালক মো. ইসমাইল হোসেন বাদি হয়ে ঈদের দিন অর্থাৎ গত ১১ এপ্রিল ঢাকা জেলার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ মডেল থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় পাঁচজনকে এজাহারনামীয় এবং অজ্ঞাত আরও ৪/৫ জনকে আসামি করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে বিআইডবিস্নউটিএ'র যুগ্ম পরিচালক ইসমাইল হোসেন যায়যায়দিনকে বলেন, নৌ ট্রাফিক আইন অমান্য করার সূত্র ধরেই দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। বেপরোয়া গতিতে লঞ্চ চালিয়ে দেওয়ার কারণেই রশি ছিঁড়ে তা প্রচন্ড গতিতে পন্টুনে থাকা যাত্রীদের আঘাত করে। আর তাতেই পাঁচজনের মৃতু্যর ঘটনাটি ঘটে বলে প্রাথমিক তদন্তে মনে হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আইন না মানায় এমভি ফারহান-৬ ও এমভি তাসরিফ-৪ নামের লঞ্চ দুটি রুট পারমিট বাতিল করা হয়েছে। অর্থাৎ অনুমতি না পাওয়া পর্যন্ত লঞ্চ দুটি আর যাত্রী আনা-নেওয়ার কাজে ব্যবহৃত হতে পারবে না। ঘটনা তদন্তে বিআইডবিস্নউটিএ'র পরিচালক (ক্রয় ও সংরক্ষণ) মো. রফিকুল ইসলামকে প্রধান করে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠিত হয়েছে। কমিটির অপর দুই সদস্য হচ্ছেন, নৌ সংরক্ষণ ও পরিচালন বিভাগের যুগ্ম পরিচালক মো. আজগর আলী ও ঢাকা নদী বন্দর শাখার যুগ্ম পরিচালক মো. কবীর হোসেন।
নৌ পরিবহণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলম খান জানান, কমিটিকে পাঁচ কার্য দিবসের মধ্যে বিআইডবিস্নউটিএ'র চেয়ারম্যান বরাবর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
বিআইডবিস্নউটিএ'র দায়ের করা মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা সদরঘাট নৌ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) নকীব অয়জুল হক যায়যায়দিনকে বলেন, ঘটনার পর মামলার আসামি হিসাবে ওইদিনই গ্রেপ্তার দেখানো হয় এমভি ফারহান-৬ লঞ্চের মাস্টার আব্দুর রউফ হাওলাদার (৫৪), দ্বিতীয় মাস্টার সেলিম হাওলাদার (৫৪) ও ম্যানেজার ফারুক খান (৭০) এবং এমভি তাসরিফ-৪ লঞ্চের মাস্টার মিজানুর রহমান (৪৮) ও দ্বিতীয় মাস্টার মনিরুজ্জামানকে (২৮)। গত ১২ আসামিদের ঢাকার মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে সোপর্দ করে ১০ দিনের করে রিমান্ডের আবেদন করা হয়। বিচারক আরিফা চৌধুরী হিমেল জামিনের আবেদন নাকচ করে আসামিদের তিন দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
তদন্তকারী কর্মকর্তা যায়যায়দিনকে আরও জানান, তদন্তে এবং আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে নৌ ট্রাফিক আইন অমান্য করার কারণেই দুর্ঘটনাটি ঘটেছে বলে জানা গেছে। এছাড়া ঘটনাস্থল থেকে সংগৃহীত আলামতও এমনটাই সাক্ষ্য দিচ্ছে। বেআইনিভাবে ঘাটে এমভি ফারহান-৬ নামের লঞ্চটি বেপরোয়া গতিতে ভিড়ানোর চেষ্টা করলে এমভি তাসরিফ-৪ লঞ্চের মোটা ও ভারী রশি ছিঁড়ে তা পন্টুনে থাকা যাত্রীদের সজোরে আঘাত করে। আর তাতেই প্রাণ যায় পাঁচজনের।
তিনি আরও বলেন, এর বাইরে আরও কোনো কারণ আছে কিনা তা জানতে গভীর তদন্ত অব্যাহত আছে। রিমান্ড শেষে সোমবার বিকালে আসামিদের ঢাকার আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে। তবে দ্বিতীয় দফায় কোনো রিমান্ডের আবেদন করা হয়নি। প্রয়োজন হলে পরবর্তীতে আসামিদের আবার রিমান্ডে আনা হবে।
দুর্ঘটনার সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে যোগাযোগ করা হলে নৌ পরিবহণ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী যায়যায়দিনকে বলেন, ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিটি কাজ করছে। সদরঘাটে দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে ঘাটে দায়িত্বরত সার্ভেয়ারদের কোনো দুর্বলতা বা দোষ প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট সার্ভেয়ার বা সার্ভেয়ারদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ঈদ মানের আনন্দ-খুশি। এমন দিনে কারো দুর্বলতার কারণে প্রাণহানি ঘটনা, কোনোভাবেই তা মেনে নেওয়া যায় না। ঘটনাটি ঈদের আনন্দকে মস্নান করে দিয়েছে। যেটি আমি ব্যক্তিগতভাবে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না।
মন্ত্রী আরও বলেন, লঞ্চের মালিক বা সংশ্লিষ্ট যেই যতবড় ক্ষমতাধর হোক না কেন, তা দেখা হবে না। এসব ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স দেখানোর স্পষ্ট ও কড়া নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। রুট পারমিট বাতিল করা লঞ্চ দুটি ঢাকা-বেতুয়া (চরফ্যাশন) রুটে চলাচল করত। নিহতদের পরিবারগুলোকে তাৎক্ষণিকভাবে বিআইডবিস্নউটিএ কর্তৃপক্ষ যাত্রী কল্যাণ তহবিল থেকে ২৫ হাজার টাকা করে দিয়েছে।
লঞ্চ মালিক সমিতির সদরঘাট শাখার কর্মকর্তা প্রদীপ বাড়ৈ যায়যায়দিনকে বলেন, যাত্রী কল্যাণ তহবিলের টাকা মূলত লঞ্চ মালিকদের টাকা। তবে আইনগতভাবে এই তহবিল দেখভাল করার দায়িত্ব পালন করে থাকে বিআইডবিস্নউটিএ কর্তৃপক্ষ। সেই তহবিল থেকেই নিহত যাত্রীদের জনপ্রতি ২৫ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে।
নিহত যাত্রীদের ক্ষতিপূরণ প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম হয়েছে উলেস্নখ করে এই কর্মকর্তা বলেন, যাত্রী কল্যাণ তহবিলে প্রচুর অর্থ জমা আছে। তাই নিহত যাত্রীদের আরও বেশি অর্থ সহায়তা পাওয়া উচিত ছিল। এমনকি বিআইডবিস্নটিএ- কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল আরও বেশি টাকা অনুদান দেওয়া।
প্রসঙ্গত, ঈদের দিন ঢাকার সদরঘাটে নৌ দুর্ঘটনায় নিহত হন পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া থানাধীন মাটিচোরা গ্রামের মৃত আব্দুল মালেকের ছেলে বিলস্নাল (৩০), বিলস্নালের স্ত্রী মুক্তা (২৬) ও এই দম্পতির মেয়ে মাইশা (৩)। এছাড়া অপর দু'জন হচ্ছেন পটুয়াখালী সদরের জয়নাল আবেদিনের ছেলে রিপন হাওলাদার (৩৮) ও ঠাকুরগাঁও সদরের নিশ্চিতপুর এলাকার আব্দুলস্নাহ কাফীর ছেলে রবিউল (১৯)।