কেএনএফের ডাকাতির ফর্মুলা জঙ্গিদের
দেশের স্বার্থে নেপথ্যের কুশীলবদের সন্ধান জরুরি
প্রকাশ | ০৮ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
গাফফার খান চৌধুরী
কেএনএফের ব্যাংক ডাকাতির ফর্মুলা জঙ্গিদের বলে ধারণা করছে গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। তাদের ধারণা, নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারকীয়াকে পাহাড়ে প্রশিক্ষণ দেয় কেএনএফ। প্রশিক্ষণকালীন সময়ে দুটি গ্রম্নপের মধ্যে নানা কৌশল আদান প্রদান হয়, যেটি খুবই একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। সেই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে জঙ্গিদের কাছ থেকে কেএনএফ ডাকাতির কলাকৌশল বা ফর্মুলা দিয়েছে।
রাষ্ট্রের একটি উচ্চ পর্যায়ের গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালের ২১ এপ্রিল বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ঢাকা জেলার আশুলিয়ার জনবহুল কাঠগড়া বাজার শাখায় ডাকাতির সঙ্গে সম্প্রতি কেএনএফের ডাকাতির ঘটনার বহুলাংশে মিল আছে। বিশেষ করে ব্যাংকের ভেতরের তান্ডব ছিল জঙ্গিদের মতো। আশুলিয়ার ব্যাংক ডাকাতির ঘটনায় ১০ জঙ্গি গ্রেপ্তার হয়। সূত্রটি বলছে, দলীয় ফান্ডের টাকা কমে যাওয়ায় দল চালানো কঠিন হয়ে পড়েছিল। এজন্য দলের হাইকমান্ড থেকে সংগঠনের সদস্যদের ডাকাতি করে দলের ফান্ড জোগানোর নির্দেশ দেয়। নির্দেশনা মোতাবেক আশুলিয়ায় ব্যাংক ডাকাতি
\হছাড়াও ওই বছরই গাজীপুরে এক বিকাশ এজেন্টকে গুলি করে ১২ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয় জঙ্গিরা। ডাকাতি করা টাকায় অস্ত্র-গোলাবারুদ কেনার পাশাপাশি সাংগঠনিক কার্যক্রমও পরিচালিত হতো। আশুলিয়ার ডাকাতির ঘটনার সময় জেএমবির শীর্ষ পর্যায়ের নেতা ছিলেন শামিন মাহফুজ।
সূত্রটি বলছে, পরবর্তীকালে শামিন মাহফুজ নতুন জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারকীয়া গঠন করেন। এমনকি তিনিই দলের শীর্ষ নেতা হিসাবে নির্বাচিত হন। জেএমবির ডাকাতি ও মোটা অঙ্কের টাকা ছিনতাইয়ের অনেক ঘটনাই শামিন মাহফুজ জানেন। এমনকি ডাকাতির কলাকৌশলও ছিল তার নখদর্পনে। শামিন মাহফুজসহ জেএমবির শীর্ষ নেতাদের নির্দেশেই জেএমবি সদস্যরা ডাকাতি করে দলীয় ফান্ডে অর্থের জোগান দিয়েছিলেন।
কেএনএফের সাম্প্রতিক কর্মকান্ড নিয়ে বিশিষ্ট নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আব্দুর রশীদ যায়যায়দিনকে বলেন, ডাকাতির ঘটনাটি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ডাকাতির সময় কেএনএফ সদস্যরা দুই ধরনের স্টাইল ফলো করেছে। পুরো ডাকাতির ঘটনা ঘটিয়েছে তারা জঙ্গি স্টাইলে। বিশেষ করে ব্যাংকের ভেতরে চালানো তান্ডবের ঘটনাটি জঙ্গিদের স্টাইলের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। আর ব্যাংক ম্যানেজারকে মসজিদ থেকে ধরে নিয়ে অপহরণ করার ঘটনাটির মিল রয়েছে বিভিন্ন দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোর স্টাইলের সঙ্গে। ব্যাংক ম্যানেজারকে খুঁজে বের করে ধরে এনে অপহরণ করার ঘটনাটি ঘটিয়েছে কেএনএফ তাদের নিজস্ব স্টাইলে। পুরো ডাকাতির ঘটনায় দুটি স্টাইলই ফলো করা হয়েছে। তাতে একটি বিষয় স্পষ্ট, তা হচ্ছে 'কেএনএফের ব্যাংক ডাকাতির ফর্মুলা জঙ্গিদের বলে অনেকটাই নিশ্চিত করে বলা যায়'।
তিনি বলেন, 'কারণ ইতোপূর্বে কেএনএফের সঙ্গে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারকীয়াকে পাহাড়ে সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়েছে কেএনএফ। যেকোনো প্রশিক্ষণের সময়ই, দুই পক্ষের মধ্যে নানা কৌশল বিনিময় হয়। যেটি প্রশিক্ষণের একটি স্বাভাবিক নিয়ম বা প্রক্রিয়া। সেই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই কেএনএফে জঙ্গি সংগঠনটির কাছ থেকে ডাকাতির কৌশল রপ্ত করেছে বা কৌশল সম্পর্কে পুরোপুরি জেনে নিয়েছে।'
তিনি বলেন, 'কেএনএফ প্রধান নাথান বম ও জঙ্গি সংগঠনটির শীর্ষ নেতা শামিন মাহফুজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী ও বন্ধু। তাদের টার্গেটও মোটামুটি একই ধরনের। শামিন মাহফুজ দেশে ইসলামি শাসন ব্যবস্থা কায়েম করতে চায়। আর নাথান বম পার্বত্য জেলাগুলোর একচ্ছত্র স্বাধীনতা চায়। নানাভাবে সেই ঘনিষ্ঠতা এখনো বজায় থাকার সম্ভাবনাই বেশি।'
তিনি বলছেন, শামিন মাহফুজ এক সময় জেএমবির শীর্ষ পর্যায়ের নেতা ছিলেন। পরবর্তীকালে পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে তিনি দল বদল করেছেন। তবে জঙ্গিবাদ থেকে সরে যাননি। ত্রিশাল ও ঢাকার সিএমএম আদালত চত্বর থেকে জঙ্গি ছিনতাই এবং অতীতে ব্যাংক ডাকাতির পুরো ঘটনা সম্পর্কেই শামিন মাহফুজ জানতেন। যা পরবর্তীকালে বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তরফ থেকে জানানো হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতাই শামিন মাহফুজ কেএনএফের সঙ্গে শেয়ার করেছেন। কেএনএফও আপদকালীন মুহূর্ত মোকাবিলা করতে সেই কৌশল শিখে নিয়েছে। যেটি খুবই স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া।'
তিনি আরও বলেন, ডাকাতির মাধ্যমে কেএনএফ এক ঢিলে তিন পাখি মেরেছে। অস্ত্র ও অর্থ লুটের পাশাপাশি নিজেদের শক্তিমত্তারও জানান দিয়েছে। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করে দেশের স্বার্থে নেপথ্যের কুশীলবদের সম্পর্কে জানা জরুরি। ঘটনাটির সঙ্গে ভূরাজনীতি জড়িত থাকার সম্ভাবনা বেশি। এজন্য প্রয়োজন আন্তঃদেশীয় সমন্বয় ও সহযোগিতা।
এছাড়া কেএনএফ সদস্যরা সীমান্ত পার হয়ে মিয়ানমারে গিয়ে যুদ্ধ করেছে। যেটি দেশের জন্য মোটেই কোনো সুখের খবর নয়। এছাড়া কেএনএফকে আর্থিক বা অস্ত্র দিয়ে অন্য কোনো দেশ বা গোষ্ঠী সহায়তা করছে কিনা সেটি গুরুত্বের সঙ্গে দেশের স্বার্থেই তদন্ত করা জরুরি।
বিশিষ্ট নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল অবসরপ্রাপ্ত আব্দুর রশীদ বলছেন, যে ধরনের ভারী অস্ত্র কেএনএফের হাতে দেখা গেছে, এ ধরনের ভারী অস্ত্র স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর পক্ষে পাওয়া অসম্ভব ব্যাপার। কোনো বহিঃশক্তি বা গোষ্ঠী হয়তো পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে চাইছে। তারই ধারাবাহিকতায় কেএনএফের মাধ্যমে এমন ঘটনা ঘটানো হতে পারে। আবার একই সঙ্গে ভারতকেও চাপে রাখার চেষ্টার অংশ হিসেবেও ঘটানো হতে এমন ঘটনা। কারণ দুই দেশের সীমান্ত একসঙ্গে লাগোয়া। তাই সরকারের উচিত আন্তঃদেশীয় সমন্বয় ও সহযোগিতা। যাতে করে প্রকৃত তথ্য বেরিয়ে আসে। অন্যথায় ভবিষ্যতে আরও বড় ধরনের অঘটন ঘটতে পারে।
এই নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলেন, 'কেএনএফের সঙ্গে আলোচনা চলাকালীন এমন ঘটনা নানা রহস্যের জন্ম দিয়েছে। তাই দেরি না করে সরকারের উচিত এর শেকড় সন্ধান করা। এমন ঘটনার নেপথ্যে বড় কোনো অন্তর্নিহিত কোনো কারণ থাকাটাই স্বাভাবিক বলে আমি মনে করছি।'
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, শামিন মাহফুজ ২০১১ সালে স্থল সীমান্তে প্রথম খুবই উচ্চমাত্রার আইইডিসহ (ইম্প্রোভাইজড এক্সপেস্নাসিভ ডিভাইস) বিজিবির হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। জামিনে ছাড়া পাওয়ার পর ২০১৪ সালে আবার পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। আবারও জামিনে ছাড়া পেয়ে তিনি যোগাযোগ করেন তার বন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের ছাত্র নাথান বমের সঙ্গে। শামিন মাহফুজ একই বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ছিলেন। নাথান লনচেও বম ওরফে নাথান বম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে চলে যান নিজ এলাকায়। আর শামিন মাহফুজ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ওপর ডক্টরেট ডিগ্রি করছিলেন। ডক্টরেট ডিগ্রি করার সুবাদে ফিল্ড ওয়ার্কের সুযোগ নিয়ে তিনি প্রায়ই পাহাড়ে গিয়ে জঙ্গি প্রশিক্ষণের স্থান দেখতেন। একাধিকবার শামিন মাহফুজ নাথান বমের সঙ্গে বান্দরবানে তার বাড়িতে গেছেন। মূলত শামিন মাহফুজ ফিল্ড ওয়ার্কের আড়ালে জঙ্গিদের সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য পাহাড়ে নিরাপদ জায়গা খুঁজছিলেন। পরবর্তীকালে তাদের মধ্যে কেএনএফকে মাসিক ৩ লাখ টাকা দেওয়ার শর্তে সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়ার বিষয়ে চুক্তি হয়। চুক্তি মোতাবেক শামিন মাহফুজের নতুন জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারকীয়ার সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছিল কেএনএফ।
গোয়েন্দা সূত্র বলছে, পরবর্তীকালে পাহাড়ে অভিযান শুরু হলে বম পার্টির প্রতিষ্ঠাতা প্রধান নাথান বম ভারতের মিজোরাম রাজ্যে অবস্থান নেন। নাথান বম রাঙামাটি ও বান্দরবানের ৯ উপজেলায় বমসহ ৬টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জন্য 'কুকি-চিন রাজ্য' প্রতিষ্ঠা করে সশস্ত্র সন্ত্রাসী তৎপরতা শুরু করে। সংগঠনের শতাধিক সদস্য মিয়ানমারের কাচিন ও কারেন প্রদেশ এবং ভারতের মণিপুর রাজ্যে প্রশিক্ষণ নিয়ে সশস্ত্র অবস্থায় ২০১৯ সালে দেশে ফেরে। বান্দরবানের রুমা সীমান্ত ও মিজোরাম সীমান্তের জাম্পুই পাহাড়ে সংগঠনটির ৬ শতাধিক সদস্য আছে। তারা চাঁদাবাজি, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, হত্যাকান্ডসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ড করত। তারা সবচেয়ে বেশি তৎপর ছিল রুমা ও থানচিতে। তবে তাদের ইতোপূর্বে ডাকাতি করার কোনো রেকর্ড পাওয়া যায়নি।
র্
যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার আল মইন জানান, ২০২২ সালে কুমিলস্না থেকে একযোগে ৮ তরুণ নিখোঁজের ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দার শারকীয়া ও কেএনএফের পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয়টি। কেএনএফে সদস্যদের সঙ্গে 'জামায়াতে আরাকান' নামে একটি ইসলামি জঙ্গি সংগঠনের সশস্ত্র গোষ্ঠীর যোগাযোগ আছে। শামিন মাহফুজ তার জঙ্গি সংগঠনটির জন্য অস্ত্র কিনে দিতে নাথান বমকে ১৭ লাখ টাকা দিয়েছেন।
ঢাকার মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সনাল ক্রাইম বিভাগের প্রধান ডিআইজি আসাদুজ্জামান জানান, ২০২৩ সালের ২৩ জুন ঢাকার ডেমরা থেকে শামিন মাহফুজকে স্ত্রীসহ গ্রেপ্তারের পর এমন বহু তথ্য পাওয়া গেছে শামিন মাহফুজের কাছ থেকে।
প্রসঙ্গত, গত ২ এপ্রিল মঙ্গলবার রাতে ও পরদিন বুধবার দুপুরে বান্দরবানের রুমা ও থানচি উপজেলার কৃষি ও সোনালী ব্যাংকের তিনটি শাখায় হামলা চালায় সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কেএনএফ। তারা গুলি চালিয়ে টাকা লুট করে, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মারধর করে, একজন ব্যাংক ব্যবস্থাপককে অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছিল। পুলিশ ও আনসারের ১৪টি অস্ত্র ও গুলি লুট করে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় মোট ৪টি মামলা হয়েছে। মামলায় আসামি করা হয়েছে অন্তত ৪০ জনকে। ব্যাংক ম্যানেজারকে উদ্ধার করেছের্ যাব। তবে উদ্ধার হয়নি অস্ত্র-গোলাবারুদ। এ ঘটনার পর পাহাড়ে যৌথ বাহিনীর অভিযান চলছে।