বান্দরবানে সমন্বিত অভিযান

কেএনএফের 'প্রধান সমন্বয়ক' গ্রেপ্তার

আরও কয়েকজন আটক, অস্ত্র উদ্ধার, কেএনএফ বিশ্বাস রাখেনি :সেনাপ্রধান

প্রকাশ | ০৮ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০

বান্দরবান প্রতিনিধি
চেউসিম বমকে গ্রেপ্তার করের্ যাব-১৫
বান্দরবানে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) অস্ত্রধারীদের গ্রেপ্তার, অস্ত্র উদ্ধার ও এলাকায় শান্তি ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে সমন্বিত অভিযান শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে কেএনএফের 'প্রধান সমন্বয়ক' চেউসিম বমকে তার বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করেছের্ যাব। রোববার বিকাল সাড়ে ৩টায় জেলা পরিষদের অডিটোরিয়ামে সংবাদ সম্মেলনের্ যাব-১৫ এর কমান্ডার এইচএম সাজ্জাদ হোসেন বলেন, 'চেউসিম বমকে তার বাড়ির একটা লোহার লকারে পাওয়া গেছে। তিনি সেখানে লুকিয়ে ছিলেন। সেটা বাইরে থেকে তালা দেওয়া ছিল। তালা ভেঙে তাকে বের করা হয়।' বান্দরবানের রুমা উপজেলায় কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) নামে এই সশস্ত্র সংগঠনের অস্তিত্ব প্রকাশ্যে আসে ২০২২ সালের শুরুর দিকে। বম, পাংখোয়া, লুসাই, খিয়াং, খুমি ও মোদের নিয়ে এ সংগঠন গঠন করার কথা বলা হলেও সেখানে বম জনগোষ্ঠীর কিছু লোক রয়েছে। সে কারণে সংগঠনটি পাহাড়ে 'বম পার্টি' নামে পরিচিতি পায়। কেএনএফ বলছে, রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাইছড়ি বিলাইছড়ি ও বান্দরবান জেলার রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি, লামা ও আলীকদমসহ নয়টি উপজেলা নিয়ে 'কুকি-চিন রাজ্য' গঠন করতে চায় তারা। সশস্ত্র সংগঠনটি অর্থের বিনিময়ে নতুন জঙ্গি সংগঠন 'জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া'র সদস্যদের সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়েছে বলে ২০২২ সালে খবর দেয়র্ যাব। কেএনএফের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষে পাহাড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লে ২০২৩ সালের ৩০ মে বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর সদস্যদের নিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি গঠিত হয়। ওই বছরের জুলাই ও আগস্টে কমিটির সঙ্গে কেএনএফের দুইবার ভার্চুয়াল আলোচনাও হয়। পরে ৫ নভেম্বর রুমা সদর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে মুনলাই পাড়ায় প্রথমবারের মতো কেএনএফের সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির সরাসরি দুটি বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে প্রথমবারের মত প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। 'শান্তি আলোচনা' শুরুর পর পাহাড়ে হত্যা-সহিংসতা থেকে মুক্তির আশা জাগতে শুরু করেছিল পাহাড়ের মানুষের মনে। এরইমধ্যে ২ ও ৩ এপ্রিল বান্দরবানের রুমা এবং থানচি উপজেলার কৃষি ও সোনালী ব্যাংকের তিনটি শাখায় হামলা চালায় সশস্ত্র লোকজন। তারা ব্যাংক থেকে টাকা লুট করে, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মারধর করে এবং এক ব্যাংক ব্যবস্থাপককে অপহরণ করে নিয়ে যায়। লুট করে বেশ কিছু অস্ত্র ও গুলি। দুটি ঘটনাতেই কেএনএফ এর নাম আসার পর ৪ এপ্রিল সংবাদ সম্মেলন করে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয় সশস্ত্র এই গোষ্ঠীর সঙ্গে সংলাপ চালিয়ে যাওয়া আর 'সম্ভব নয়'। এরমধ্যে শনিবার রুমা ও বান্দরবান পরিদর্শন করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, 'কোনো অবস্থায় পার্বত্য এলাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি হতে দেওয়া যাবে না। যেকোনো মূল্যে শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হবে।' রোববার হেলিকপ্টারে বান্দরবানে এসে রুমা ও থানচির পরিস্থিত ঘুরে দেখেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, 'আমরা এখন সরকারের ওভারঅল স্ট্র্যাটেজি, অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে যেভাবে এটা সরকার চিন্তা করেছে, বাংলাদেশ সরকারের সমন্ত অর্গান, আমাদের সেনাবাহিনী, বিজিবি,র্ যাব, পুলিশ, এবং অন্যান্য ইন্টেলিজেন্স অর্গানাইজেশন, সব সমন্বিতভাবে আমরা এই পরিস্থিতির মোকাবেলা করব। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর যে দায়িত্বগুলো পালন করার, বিশেষ করে যৌথ অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া, সেইগুলো আমরা অত্যন্ত পেশাদারিত্বের সঙ্গে করতে পারব বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।' তিনি আরও বলেন, ১ বান্দরবানে ব্যাংক-অস্ত্রলুট, মসজিদে হামলা ও অপহরণের ঘটনায় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে শনিবার রাত থেকে যৌথ অভিযান শুরু করা হয়েছে। এরইমধ্যে দুটি অস্ত্র ও কয়েকজন সন্ত্রাসীকে আটক করা হয়েছে। নিরাপত্তার স্বার্থে ঠিক কতজনকে আটক করা হয়েছে তা না জানালেও তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কড়া নির্দেশে শনিবার রাত থেকে কেএনএফ সশস্ত্র সংগঠনের বিরুদ্ধে কম্বাইন্ড অপারেশন শুরু হয়ে গেছে। এরইমধ্যে দুটি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত যৌথ বাহিনীর অভিযান চলবে। সেনা প্রধান বলেন, শান্তি কমিটির সঙ্গে কেএনএফের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার আলোচনা চলছিল। দুটি মুখোমুখি সংলাপ বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়েছে, তৃতীয় বৈঠকের আগেই তারা সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ঘটালো। বমদের সানডে আয়োজনে ৩১ মার্চ রুমায় বেতেলপাড়াসহ সবগুলো গির্জায় সেনাবাহিনী কেক পাঠিয়েছে, উৎসব আয়োজনে সম্পৃক্ত ছিল। কিন্তু ২ এপ্রিল তারা সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ঘটালো, মনের ভেতরে কী আছে সেটিতো জানা মুশকিল। তবে সরকার তাদের বিশ্বাস করেছিল, কেএনএফ বিশ্বাস রাখেনি। তিনি আরও বলেন, কম্বাইন্ড অপারেশন এবং গোয়েন্দা কার্যক্রমও চলছে। তাই অপারেশনের সবগুলো দৃশ্যমান নয়। কিছু কার্যক্রম অদৃশ্যে চলবে, যা সাধারণ মানুষ দেখবে না, কিন্তু সুফল ভোগ করবে। এ সময় অন্যদের মধ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। ব্যাংক বন্ধ থাকায় ভোগান্তি এদিকে বান্দরবানের রুমা, থানচি ও বোয়াংছড়ি উপজেলার ছয়টি ব্যাংকের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। ঈদ ও নববর্ষ সামনে থাকায় এসব উপজেলার বাসিন্দারা বিপাকে পড়েছে। গত বুধবার সোনালী ব্যাংকের থানচি শাখায় চেক নিয়ে মাসিক বেতনের টাকা তুলতে যান থানচি উপজেলা কেন্দ্রীয় মসজিদের ইমাম আনিসুলস্নাহ মোবারক। তিনি বলেন, চেক নিয়ে ব্যাংকে ঢোকার পর দেখি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আসা লোকজন পুরো ব্যাংক ঘিরে ফেলেছে। তারা অস্ত্র তাক করে রাখে, যাতে কেউ একটু শব্দও করতে না পারে। সেদিন ব্যাংক থেকে আর টাকা তুলতে পারেননি। টাকা দূরে থাক, প্রাণে বেঁচে এসেছেন এটাই তাঁর কাছে বড় সান্ত্বনা। আজ দুপুরে আনিসুলস্নাহ মোবারক বলেন, 'সামনে ঈদ। টাকা তুলতে না পারায় এখনো কিছু করা হয়নি।' থানচি বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জসিম উদ্দিন রোববার বলেন ব্যাংকিং লেনদেন করতে না পারায় ব্যবসায়ীরা খুব কষ্টে আছেন। একই অবস্থা রুমা উপজেলায়। রুমা বাজারের ব্যবসায়ী মোহাম্মদ হানিফ বলেন, লেনদেন করতে না পারায় তারা পঙ্গু হয়ে বসে আছেন। সোনালী ব্যাংক বান্দরবান শাখার প্রিন্সিপাল অফিসার মনিরুল হাসান রোববার সকালে বলেন, রুমা ও থানচি ঘটনার পর সোনালী ব্যাংকের তিনটি শাখার কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। তবে অনলাইনে যেকোনো শাখা থেকে টাকা উত্তোলন করা যাবে। এ ছাড়া নগদ ও বিকাশে ব্যাংক হিসাব থেকে টাকা স্থানান্তর করা যাবে। কৃষি ব্যাংক থানচি উপজেলা শাখার ব্যবস্থাপক হাসুই থোয়াই মারমা জানালেন একই কথা। তবে রুমা উপজেলা বাজার সমিতির সভাপতি অঞ্জন বড়ুয়া বলেন, পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিয়ে ব্যাংকের শাখাগুলোর লেনদেন শুরু করা উচিত। এদিকে কেএনএফের তান্ডবের ঘটনায় রুমা ও থানচিতে রোববারও থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। আতঙ্ক কাটেনি দুই উপজেলাবাসীর। এসব তান্ডবের ঘটনায় মামলার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮টি। তারমধ্যে রুমায় ৪টি এবং থানচিতে ৪টি। সবগুলো মামলায় আসামি অজ্ঞাত। বিষয়টি নিশ্চিত করে বান্দরবানের পুলিশ সুপার সৈকত শাহীন জানান, রুমার ঘটনায় বাদী হয়ে মামলা করেছেন সোনালী ব্যাংক কর্মকর্তা, মসজিদের ইমাম, পুলিশ ও আনসার এবং থানচিতে সোনালী ব্যাংক ও কৃষি ব্যাংক কর্মকর্তা ও দুটির পুলিশ বাদী। তবে এখনো পর্যন্ত মামলায় কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। তবে রুমা ও থানচি কোথাও নতুন করে কেএনএফের গোলাগুলির খবর পাওয়া যায়নি। হামলা লুটকারীদের ধরতে যৌথ বাহিনীর অভিযান চলছে। রুমা-রোয়াংছড়ি, থানচি-আলীকদম সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে চালানো হচ্ছে সাঁড়াশি অভিযান। নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তারা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বলেও জানান তিনি। এছাড়া ব্যাংক ডাকাতির পর থেকে নিরাপত্তার স্বার্থে রুমা-থানচি ও রোয়াংছড়ির সোনালী-কৃষি ব্যাংকের সকল লেনদেন বন্ধ রয়েছে। এই তিন উপজেলার গ্রাহকরা বান্দরবান সদর শাখায় লেনদেন করতে পারবেন বলে জানিয়েছিলেন সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আফজাল করিম।