শনিবার সকাল ১০টা থেকে বেলা সাড়ে ৩টা পর্যন্ত রাজধানী ঢাকার তাপমাত্রা ছিল ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু তখন গরম অনুভূত হয়েছে ৩৯ ডিগ্রির মতো। বিকালের দিকে তাপমাত্রা সামান্য কমে ৩৪ ডিগ্রিতে নামলেও অসহনীয় গরমে ফুল স্পিডে চলা ফ্যানের নিচে দাঁড়িয়েও মানুষ দর দর করে ঘেমে-নেয়ে উঠেছে। এর সঙ্গে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে ঘন ঘন লোডশেডিং। এ অবস্থায় খুবই স্বল্প সংখ্যক মানুষ পরিবার-পরিজন নিয়ে ঈদ কেনাকাটা করতে মার্কেটগুলোতে ঢুঁ মেরেছে। ফলে বেশির ভাগ মার্কেটে সারাদিন ক্রেতার দেখা তেমন মেলেনি। সন্ধ্যার পর অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হলেও লোডশেডিংয়ের কারণে ঈদ কেনাকাটার পিক-টাইম অনুযায়ী আশানুরূপভাবে জমছে না। গত কয়েক দিন ধরেই একই অবস্থা চলছে।
শুধু অভিজাত মার্কেট, বিপণিবিতান কিংবা শপিংমলই নয়, তীব্র গরমের কারণে ফুটপাতের বেচাকেনাতেও চরম মন্দার ধাক্কা লেগেছে। সেখানকার বেশির ভাগ দোকানিই বিকাল পর্যন্ত তুলতে পারছে না দোকান খরচের টাকা। ইফতারির পর ফুটপাতে ক্রেতার ভিড় কিছুটা বাড়লেও তা খুব বেশি সময় স্থায়ী হচ্ছে না।
এদিকে ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে ঢাকার চেয়ে দেশের বিভিন্ন জেলা ও মফস্বল শহরের ব্যবসায়ীদের বেশি কপাল পুড়েছে। গত কয়েক দিন ধরে তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে পালস্না দিয়ে সেখানে লোডশেডিং বাড়ায় ক্রেতারা মার্কেটবিমুখ হয়ে পড়েছেন। ব্যবসায়ীদের ভাষ্য, গরমের কারণে দিনে ক্রেতার আনাগোনা কম হলেও রাতে কিছুটা ভিড় হতো। কিন্তু সন্ধ্যার পর কয়েক দফা লোডশেডিংয়ের কারণে ঈদ বেচাকেনায় বড় ধস নেমেছে।
বিদু্যৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত কয়েক দিন ধরে গরম বাড়ায় বিদু্যতের চাহিদা বেড়েছে। সে অনুযায়ী উৎপাদন না হওয়ায় প্রতিদিন নূ্যনতম ২ হাজার মেগাওয়াট বিদু্যতের ঘাটতি হচ্ছে। যা সামাল দিতে সারা দেশে অন্তত দুই ঘণ্টা লোডশেডিং করা প্রয়োজন। কিন্তু ঢাকাসহ গুরুত্বপূর্ণ বিভাগীয় শহরগুলোতে লোডশেডিং কিছুটা কম করায় এর চাপ পড়ছে মফস্বল শহরগুলোতে। এ কারণে সেখানে দিনরাত মিলিয়ে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা লোডশেডিং করতে হচ্ছে। এমনকি কোনো কোনো এলাকায় ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা লোডশেডিং করতে হচ্ছে।
সিলেটের ব্যবসায়ীরা
জানান, গরম বাড়ার পর সেখানে দিনেরাতে কয়েক দফা দীর্ঘমেয়াদে লোডশেডিং হচ্ছে। তাই ভোগান্তির ভয়ে ক্রেতারা খুববেশি মার্কেটমুখী হচ্ছেন না। যারা মার্কেটে আসছেন তারা লোডশেডিং হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মার্কেট থেকে বের হয়ে যাচ্ছেন। বিশেষ করে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত মার্কেটগুলোতে বিদু্যৎ চলে যাওয়ার পর ক্রেতা ধরে রাখা যাচ্ছে না। দু'একদিনের মধ্যে গরম ও লোডশেডিং না কমলে ভয়াবহ বিপাকে পড়তে হবে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেন ব্যবসায়ীরা।
গত কয়েক দিন ধরে একই অবস্থা লক্ষ্ণীপুর, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, যশোর ও খুলনার ব্যবসায়ীদেরও। সেখানেও তীব্র গরম ও লোডশেডিংয়ের কারণে ঈদ কেনাকাটায় মন্দা দেখা দিয়েছে। ওইসব এলাকার ব্যবসায়ীদের ভাষ্য, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে এমনিতেই উৎসবকেন্দ্রিক বেচাকেনা কম। এর ওপর তীব্র গরম ও লোডশেডিংয়ের ক্রেতার সংখ্যা অর্ধেক কমে যাওয়ায় ব্যবসার পুঁজি তোলা কঠিন হয়ে পড়বে অনেকেই এমন আশঙ্কা করছেন।
গরম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পালস্না দিয়ে লোডশেডিং বাড়ায় ব্যবসায়ীরা অনেকে উষ্মা প্রকাশ করেছেন। তাদের ভাষ্য, এমনিতেই সারা বছর তাদের বেচাকেনায় মন্দা লেগেই থাকে। ঈদ ও বৈশাখী উৎসব উপলক্ষে এ সংকট কাটবে এমন আশায় তারা পর্যাপ্ত পণ্য মজুত করেছেন। সরকার রোজায় নিরবিচ্ছিন্ন বিদু্যৎ সরবরাহের নিশ্চয়তা দিয়েছে। অথচ ঈদের ঠিক আগমুহূর্তে বেচাকেনার পিক সিজনে ঘন ঘন লোডশেডিং করা হচ্ছে। এ পরিস্থিতি চলমান থাকলে তাদের ব্যবসা পুরোপুরি শিকেয় উঠবে। সারা বছর বিদু্যতের বিল পরিশোধ করলেও এখন তাদের প্রকৃতির কৃপার ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে।
বেলা আড়াইটার দিকে রাজধানীর মালিবাগের ফরচুন মার্কেট ঘুরে দেখা গেছে, সেখানকার বেশির ভাগ দোকানই ক্রেতাশূন্য। সেলসম্যানরা অনেকটা অলস সময় পার করছেন। কেউবা মোবাইল ফোনে ইউটিউব, ফেসবুক ঘাঁটাঘাঁটি করে কিংবা গেম খেলে সময় কাটাচ্ছেন। বেশির ভাগ দোকানের কর্মচারী নিজেদের মধ্যে খোশগল্পে মত্ত। শ'খানেক তরুণ-তরুণী মার্কেটের বিভিন্ন ফ্লোরে ঘোরাঘুরি করলেও দোকানে ঢুঁ মারছেন খুবই কম। ঈদ বাণিজ্যের এ ভর মৌসুমে বেচা-বিক্রির এ দুর্দশা দেখে বেশির ভাগ দোকান মালিক ভীষণ দুশ্চিন্তায়।
দোকানিরা জানান, করোনা মহামারির সময় ছাড়া আর কখনই ঈদের আগে কোনো মার্কেটেই ক্রেতার এত হাহাকার দেখেননি। এ অবস্থা চলতে থাকলে এবারও তাদের বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়তে হবে। ফরচুন মার্কেটের তৈরি পোশাক বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান উইমেন্স ওয়ার্ল্ডের মালিক শবনম রহমান বলেন, 'প্রতি বছর রমজানের শুরুর পর থেকেই ঈদ কেনাকাটা বাড়তে থাকে। ১৫ রোজা পার হতেই রাজধানীর ছোট-বড় প্রতিটি মার্কেট, শপিংমল, বিপণিবিতানে ক্রেতার ঢল নামে। এবার আগের মতো ঈদ ও বৈশাখকেন্দ্রিক বেচাকেনা জমে না উঠলেও ১০ রোজার পর থেকে ক্রেতা সমাগম খুব একটা খারাপ ছিল না। ২০ রমজান পর্যন্ত মোটামুটি বেচাকেনা হয়েছে। সবার আশা ছিল এপ্রিলের শুরুতে চাকরিজীবীরা বেতন পেতে শুরু করলে ঈদ কেনাকাটা জমে উঠবে। কিন্তু বাস্তবে হয়েছে এর উল্টোটা। কয়েক দিন ধরে গরমের মাত্র ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকায় ক্রেতারা যেন ভোজবাজির মতো উধাও হয়ে গেছে।
এদিকে শুধু ফরচুন মার্কেটই নয়, মৌচাক, গাউছিয়া, নিউমার্কেট, চাঁদনী চক, বেনারশি পলস্নী, ধানমন্ডি হকার্স, ইস্টার্ণ মলিস্নকা, ইস্টার্ণ পস্নাজা, বসুন্ধরা শপিং কমপেস্নক্স ও যমুনা ফিউচার পার্কসহ রাজধানীর ছোট-বড় প্রায় দুই ডজন মার্কেট ঘুরে দেখা গেছে, সব জায়গাতেই ক্রেতার আকাল পড়েছে। আর ফুটপাতের ঈদের বেচাকেনা দেখে মনে হয়েছে, সেখানকার ক্রেতারাও যেন হঠাৎ ধর্মঘট ডেকে বসেছে।
ব্যবসায়ী নেতারা জানান, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে এমনিতেই নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের হাতে উদ্বৃত্ত টাকা নেই। এর ওপর চৈত্রের খরতাপে রাস্তাঘাটের বাতাসে আগুনের হল্কা বয়ে যাওয়ায় বেশিরভাগ মানুষ ঈদ কেনাকাটার জন্য ঘর থেকে বের হতে রীতিমতো ভয় পাচ্ছেন। সব মিলিয়ে ঈদ ও বৈশাখকেন্দ্রিক বেচাকেনায় মন্দাভাব দেখা দিয়েছে।
এদিকে করোনার সময় মার্কেট, বিপণিবিতান ও শপিংমলগুলোতে বেচাকেনা ততটা না জমলেও অনলাইন কেনাকাটা যথেষ্ট জমেছিল। কিন্তু গত কয়েক দিনের দাবদাহে মার্কেটে বিক্রি যতটা কমেছে, সে তুলনায় অনলাইন শপিং বাড়েনি। বরং এ খাতেও কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। গরমের কারণে ডেলিভারিম্যানরাও সময়মতো পণ্য ক্রেতার কাছে পৌঁছে দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। তবে অনলাইনে বিক্রেতাদের অনেকের ধারণা, যারা মার্কেটে ঘুরে ঈদ কেনাকাটা করেন, তাদের খুবই কমসংখ্যক অনলাইন ক্রেতা। তারা উৎসবকেন্দ্রিক কেনাকাটাতেও ভিন্ন আনন্দ পান। তাই গরমের কারণে মার্কেটে ক্রেতার ভিড় কমলেও অনলাইনে কেনাকাটা বাড়বে- সেটি হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। এক মার্কেট থেকে আরেক মার্কেট ঘুরে দেখেশুনে পছন্দ করে উৎসবের পোশাক কেনা ক্রেতারা হয়তো গরম কমে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন। ঈদের আগে বৃষ্টি হলে কিংবা স্বাভাবিকভাবে তাপমাত্রা কিছুটা কমলে তারা হয়তো কেনাকাটায় নামবেন।
নূরজাহান মার্কেটে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় আইইউটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক আশরাফুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি জানান, নিজ ও পরিবারের জন্য বৈশাখী এবং ঈদের কিছু কেনাকাটার জন্য মার্কেটে এসেছিলেন। কিন্তু দুর্বিষহ গরমে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাই কেনাকাটা না করেই বাসায় ফিরে যাচ্ছেন। আগামী দুই-একদিন পর গরম কমলে মার্কেটে আসবেন।
দুই শিশু সন্তান ও বৃদ্ধ বাবাকে নিয়ে বসুন্ধরা শপিং মলের ঈদ কেনাকাটা করতে আসা এনজিও কর্মকর্তা রওশন আরা রেখা জানান, মোহাম্মদপুরের বাসা থেকে রিকশায় মার্কেট পর্যন্ত আসতে তীব্র গরমে ঘেমে নেয়ে তারা ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। এ অবস্থায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মার্কেটে ঢুকে কেনাকাটা করলে ঘামে ভেজা শরীরে ঠান্ডা লেগে জ্বর-কাশি হতে পারে। তাই তারা কেনাকাটা না করেই বাসায় ফিরে যাচ্ছেন।
রেখা জানান, এর আগে গত মঙ্গলবারও অফিস থেকে ছুটি নিয়ে ঈদ কেনাকাটা করতে মার্কেটে যাওয়ার টার্গেট নিয়েছিলেন। কিন্তু গরমের কারণে তার বৃদ্ধ বাবা বাসা থেকে বের হতে সাহস পাননি। তবে ঈদ দোরগোড়ায় চলে আসায় তাই ঝুঁকি নিয়েই আজ (শনিবার) মার্কেটে এসেছিলেন। তাপমাত্রা না কমলে আগামী ৩/৪ দিন আর এ ধরনের ঝুঁকি নেবেন না বলে জানান তিনি।
এদিকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অভিজাত মার্কেটগুলোতে কিছু ক্রেতা থাকলেও যেসব মার্কেটে সে ব্যবস্থা নেই, সেখানকার বেচাকেনায় আরও বড় ধস নেমেছে। সেখানকার দোকানিরা জানান, ফ্যানের বাতাসেও শরীর ঘামছে। দোকানে বসে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। সেখানে ক্রেতারা ঘুরে ঘুরে কেনাকাটা করবে কীভাবে? এর ওপর আকস্মিক লোডশেডিংয়ে দম বন্ধ হওয়ার জোগাড় হচ্ছে।
গাউছিয়া, চাঁদনীচক, নিউ সুপার, নূরজাহান, হক সুপার, আজিজ সুপার, আনারকলি, নাহার পস্নাজা, সোনার বাংলা, শাহআলী ও মৌচাকসহ প্রায় এক ডজন সেন্টাল নন-এসি মার্কেটের দোকানিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৫ রোজার পর ঈদ ও বৈশাখী বেচাকেনা কিছুটা বাড়লেও চৈত্রের গরম তেতে ওঠার পর তাদের ব্যবসায় মন্দা দেখা দিয়েছে। গরমের সঙ্গে পালস্না দিয়ে বেচা-বিক্রিতে ভাটার টান আরও জোরালো হচ্ছে।
বিভিন্ন বিপণিবিতান ও শপিংমলে কেনাকাটা করতে আসা ক্রেতারা জানান, তীব্র গরমে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মার্কেটে যেতেও তারা সাহস পাচ্ছেন না। কারণ বাসা থেকে বের হয়ে রিকশায় চড়তে গেলেই আগের চেয়ে দেড় থেকে দ্বিগুণ ভাড়া গুনতে হচ্ছে। প্রচন্ড গরমে বাসে গাদাগাদি করে মার্কেটে যাওয়া রীতিমতো দুঃসাহসিক ব্যাপার। বিশেষ করে ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে ঈদ শপিংয়ের যাওয়ার কথা কেউ চিন্তাই করতে পারছেন না।
এদিকে ব্যবসায়ী নেতাদের আশা, তাপমাত্রা স্বস্তিদায়ক পর্যায়ে না আসলেও লোডশেডিং বন্ধ হলে রাতের বেচাকেনা বাড়বে। ঈদ ঘনিয়ে আসায় গরমের দুর্ভোগ উপেক্ষা করেই ক্রেতারা মার্কেটে আসবে। তবে লোডশেডিং না কমলে তাদের কপাল পুড়বে বলেও আশঙ্কায় রয়েছেন তারা।