'তারা তাদের মুখের ফুৎকারে আলস্নাহর নূরকে নিভিয়ে দিতে চায়, কিন্তু আলস্নাহ তার নূরকে পূর্ণতাদানকারী। যদিও কাফিররা তা অপছন্দ করে। তিনিই তার রসুলকে হিদায়াত ও সত্যদ্বীন সহকারে প্রেরণ করেছেন, যাতে তিনি সব দ্বীনের ওপর তা বিজয়ী করে দেন। যদিও মুশরিকরা তা অপছন্দ করে।' (সূরা ছফ- আয়াত ৮-৯)
এ আয়াতটি ৩ হিজরী সনে ওহুদ যুদ্ধের পরে নাযিল হয়েছিল। সে সময় ইসলাম কেবল মদিনা শহরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, মুসলমানদের সংখ্যা কয়েক হাজারের বেশি ছিল না এবং গোটা আরবভূমি দ্বীন ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার জন্য পুরোপুরি সংকল্পবদ্ধ ছিল। ওহুদের যুদ্ধে মুসলমানদের সাময়িক পরাজয় হয়েছিল, হযরত আমীর হামজার মতো বীর সেনানীসহ ৭০ জন সাহাবী শাহাদত বরণ করেন। এ যুদ্ধের ফলে মুসলমানদের প্রভাব-প্রতিপত্তি একদিকে যেমন ক্ষুণ্ন্ন হয়েছিল, অন্যদিকে ইসলাম বিরোধীগোষ্ঠী ও আশপাশের গোত্রসমূহ তাদের বিরুদ্ধে অত্যন্ত সাহসী হয়ে উঠেছিল। এরূপ পরিস্থিতিতে মুসলমানদেরকে আলস্নাহ বলে দিলেন, আলস্নাহর এই 'নূর' কারো নিভিয়ে দেয়াতে নিভবে না, বরং পূর্ণরূপে উদ্ভাসিত হবে এবং সারা পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়বে। এটা স্পষ্ট ভবিষ্যদ্বাণী, যা অক্ষরে অক্ষরে সত্যে প্রমাণিত হয়েছে।
হযরত ওমর (রা.) এর খেলাফতকালে আরবের গন্ডি পেরিয়ে অর্ধপৃথিবী আলস্নাহর নূরের আলোয় আলোকিত করে। তবে যারা ইসলামের পতাকাবাহী ছিলেন তাদেরকে নানা কঠিন অবস্থায় ঈমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়েছে। যার মাধ্যমে আলস্নাহ তা'আলা মু'মিনদের ঈমানের পরীক্ষা গ্রহণ করেছেন। আল-কুরআনে বর্ণিত
হয়েছে, 'আর আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং জান-মাল ও ফল-ফলাদির স্বল্পতার মাধ্যমে। আর তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও। তাদের ওপর যখন বিপদ-মুসিবত আসে তখন বলে, নিশ্চয় আমরা আলস্নাহর জন্য এবং তার দিকে প্রত্যাবর্তনকারী। (সূরা আল-বাকারা, ১৫৫-১৫৬)
আলস্নাহ তা'আলা যুগে যুগে সব নবী-রাসূল এবং তাদের ওপরে যারা ঈমান এনেছিলেন তাদেরকে এই পরীক্ষার মাধ্যমে তাদের ঈমানকে যাচাই-বাছাই করে নিয়েছেন। আলস্নাহ বলেছেন, 'মানুষ কি মনে করে যে, 'আমরা ঈমান এনেছি' বললেই তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে, আর তাদের পরীক্ষা করা হবে না? আর আমি তো তাদের পূর্ববর্তীদের পরীক্ষা করেছি। ফলে আলস্নাহ অবশ্যই জেনে নেবেন, কারা (ঈমানের দাবিতে) সত্যবাদী এবং কারা মিথ্যাবাদী।' (সূরা আন কাবুত, ২-৩)
সূরা আল-বাকারার মধ্যে আলস্নাহ আরও স্পষ্ট করে বলেছেন, 'তোমরা কি ভেবেছ যে, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে অথচ এখনো তোমাদের নিকট তাদের মতো কিছু আসেনি, যারা তোমাদের পূর্বে বিগত হয়েছে। তাদেরকে স্পর্শ করেছিল কষ্ট ও দুর্দশা এবং তারা কম্পিত হয়েছিল। এমনকি রসুল ও তার সাথী মু'মিনগণ বলেছিল, 'কখন আলস্নাহর সাহায্য (আসবে)'? জেনে রাখ, নিশ্চয় আলস্নাহর সাহায্য নিকটবর্তী।' (সূরা আল-বাকারা, ২১৪)
এ আয়াতের মাধ্যমে দ্বীন ইসলামের আলো নিশ্চিত প্রজ্বলিত থাকার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। কেননা ইসলামের পতাকাবাহীদের কখনো মৃতু্যর ভয় দেখিয়ে হকের রাস্তা থেকে দূরে সরানো যায় না। তারা জানে, এ রাস্তায় প্রাণ গেলেও তা মৃতু্য নয়। তার অপর নাম জীবন। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, 'যারা আলস্নাহর রাস্তায় নিহত হয়, তাদেরকে মৃত বলো না। বরং তারা জীবিত, কিন্তু তোমরা অনুভব করতে পার না।' (সূরা আল-বাকারা, ১৫৪)
আলস্নাহ জান্নাতের বিনিময়ে মু'মিনদের কাছ থেকে তাদের জীবন ও মাল ক্রয় করে নিয়েছেন। আলস্নাহ বলেন, 'নিশ্চয় আলস্নাহ মু'মিনদের থেকে তাদের জান ও মাল ক্রয় করে নিয়েছেন (এর বিনিময়ে) যে, তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত।' (সূরা আত-তাওবা, ১১১)
ঈমানদাররা বিশ্বাস করেন, মৃতু্যর ফয়সালা আলস্নাহর খাতায় লেখা না থাকলে কখনো তার মৃতু্য হবে না। আর মৃতু্য লেখা থাকলে কেউ তাকে বাঁচাতে পারবে না। আলস্নাহ বলেন, 'প্রত্যেক উম্মতের রয়েছে নির্দিষ্ট একটি সময়। যখন এসে যায় তাদের সময়, তখন এক মুহূর্ত পিছাতে পারে না এবং এগোতেও পারে না।' (সূরা ইউনূচ, ৪৯)
'আর আলস্নাহ কখনো কোনো প্রাণকেই অবকাশ দেবেন না, যখন তার নির্ধারিত সময় এসে যাবে।' (সূরা মুনাফিকুন, ১১) সূরা আলে-ইমরানে এ ব্যাপারে আরও স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, 'বল, তোমরা যদি তোমাদের ঘরে থাকতে তাহলেও যাদের ব্যাপারে নিহত হওয়া অবধারিত রয়েছে, অবশ্যই তারা তাদের নিহত হওয়ার স্থলের দিকে বের হয়ে যাবে।' (সূরা আলে-ইমরান, ১৫৪)
এ জন্য মু'মিন ব্যক্তি ইসলামের স্বার্থে যে কোনো পরিণতি ভোগ করতে প্রস্তুত থাকে। এহেন মুত্তাকি অবস্থায় যদি তার মৃতু্য হয় তাহলে তার জন্য আলস্নাহর পক্ষ থেকে লাল গালিচা সংবর্ধনা অপেক্ষা করছে। এ সম্পর্কে আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, 'আর যারা তাদের রবকে ভয় করেছে তাদেরকে দলে দলে জান্নাতের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। অবশেষে তারা যখন সেখানে এসে পৌঁছবে এবং এর দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হবে তখন জান্নাতের রক্ষীরা তাদেরকে বলবে, তোমাদের প্রতি সালাম, তোমরা ভালো ছিলে। অতএব স্থায়ীভাবে থাকার জন্য এখানে প্রবেশ কর।' (সূরা যুমার, ৭৩)
আলস্নাহ তা'আলা উপরোক্ত আয়াতে আলস্নাহর নূর বা দ্বীন ইসলামকে পৃথিবীর কেউ নিভিয়ে দিতে পারবে না বলে ঘোষণা দেওয়ার পর পরবর্তী আয়াতে আলস্নাহ বলেন, সে দ্বীনকে পৃথিবীতে বিদ্যমান সব দ্বীনের ওপরে বিজয়ী করার জন্য নবী মুহাম্মদ (সা.)কে পাঠানো হয়েছে। আলস্নাহর বাণী, 'তিনিই সেই মহান সত্তা যিনি তার রসুলকে হিদায়াত এবং 'দ্বীনে হক' দিয়ে পাঠিয়েছেন যাতে তিনি এ দ্বীনকে অন্য সব দ্বীনের ওপর বিজয়ী করেন, চাই তা মুশরিকদের কাছে যতই অসহনীয় হোক না কেন।'
এ আয়াতে বলা হয়েছে, যারা আলস্নাহর দাসত্বের সঙ্গে অন্যদের দাসত্বও করে থাকে এবং আলস্নাহর দ্বীনের সঙ্গে অন্য সব দ্বীন ও বিধানকে সংমিশ্রিত করে, শুধু এক আলস্নাহর আনুগত্য ও হিদায়াতের ওপর গোটা জীবনব্যবস্থা কায়েম হোক তারা তা চায় না। যারা ইচ্ছামতো যে কোনো প্রভু ও উপাস্যের দাসত্ব করতে সংকল্পবদ্ধ এবং যে কোনো দর্শন ও মতবাদের ওপর নিজেদের আকীদা-বিশ্বাস, নৈতিকতা এবং তাহযীব-তামুদ্দুনের ভিত্তিস্থাপন করতে চায় তাদের সঙ্গে আপস করার জন্য আলস্নাহর রসুলকে পাঠানো হয়নি। বরং তাকে পাঠানো হয়েছে এ জন্য যে, তিনি আলস্নাহর পক্ষ থেকে যে হিদায়াত ও জীবনব্যবস্থা এনেছেন তাকে গোটা জীবনের সব দিক ও বিভাগের ওপর বিজয়ী করে দেবেন।
সেখানে এমন দ্বীন প্রতিষ্ঠিত হবে যার গোটা সমাজ তাওহীদের ওপর প্রতিষ্ঠিত। সেখানে নৈতিক চরিত্র, সভ্যতা, সংস্কৃতি, শিক্ষা, আইন-কানুন, রীতি-নীতি, রাজনীতি, অর্থনীতি মোটকথা জীবনের প্রতিটি বিভাগের জন্য আকীদা-বিশ্বাস হিসেবে সে সব মূলনীতি মেনে নেওয়া বা চালু করা যা মহান আলস্নাহ তার কিতাব ও রসুল (সা.) এর মাধ্যমে দিয়েছেন।