ব্যাংকের নিরাপত্তায় বাড়তি সতর্কতা
প্রকাশ | ০৫ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
সাখাওয়াত হোসেন
বান্দরবানের রুমা ও থানচিতে মাত্র ১৬ ঘণ্টায় একজন ব্যবস্থাপককে অপহরণ ও অস্ত্র লুটসহ তিনটি ব্যাংকে ডাকাতি এবং কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে ইসলামী ব্যাংকের ভল্ট ভেঙে অর্থ চুরির ঘটনায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। উদ্বিগ্ন এই পরিস্থিতিতে সারাদেশের ব্যাংকের নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে নির্জন ও দুর্গম এলাকার ব্যাংকগুলোর নিরাপত্তায় বাড়তি সতর্কতা নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি পার্বত্য এলাকার গহিন জঙ্গলে আস্তানা গড়ে তোলা কুকিচিনসহ দেশি-বিদেশি জঙ্গি সংগঠনগুলোর ওপর কঠোর নজরদারির নির্দেশ দিয়েছে সরকার।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বান্দরবানের রুমা ও থানচিতে তিন ব্যাংকে ডাকাতি, অস্ত্র লুট এবং ব্যাংক ম্যানেজারকে অপহরণের ঘটনায় প্রাথমিকভাবে জঙ্গি সংগঠন কুকিচিনকে সন্দেহ করা হচ্ছে। তাই তাদের অবস্থান ও গতিবিধি পর্যবেক্ষণে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সেনাবাহিনীও এ ব্যাপারে তৎপরতা চালাচ্ছে।
এদিকে প্রতিটি জেলার পুলিশ সুপারকে (এসপি) অবহিত করে বিশেষ বার্তা পাঠানো হয়েছে। বিশেষ করে ঈদের ছুটির আগে-পরে ব্যাংকে মোটা অংকের অর্থ গচ্ছিত থাকাকালীন সময় যাতে কোনো ধরনের ডাকাতি বা চুরির ঘটনা ঘটতে না পারে, সে ব্যাপারে নিরাপত্তা জোরদার ও গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানোর জন্য তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
গোয়েন্দা সূত্রগুলো জানায়, দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বেশিরভাগ দুর্গম ও
নির্জন অঞ্চলের শাখা নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে। পর্যাপ্ত নিরাপত্তাকর্মীর অভাব, আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারে অক্ষমতা, পুলিশ টহলের ব্যবস্থা না থাকা এবং সিসিটিভি ও স্পাই ক্যামেরার অভাবে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেওয়া নির্দেশনাগুলোও যথাযথভাবে মানছে না ব্যাংকগুলো। কারণ, এতে তাদের খরচের পরিমাণ বেড়ে যায়। অথচ ব্যাংকগুলোতে চলছে ব্যয় সংকোচন নীতি।
এ ছাড়া গ্রামীণ এলাকার এটিএম বুথ ও এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রমেও ঝুঁকির মাত্রা বেড়েছে। বিভিন্ন এলাকায় এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের আউটলেট থেকে টাকা খোয়া যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে। বিভিন্ন এলাকায় এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের টাকা ছিনতাই হচ্ছে।
সূত্র জানায়, গত ২৫ জানুয়ারি বগুড়া সদরে এনআরবিসি ব্যাংকের উপশাখায় ডাকাতির ঘটনা ঘটে। দুর্বৃত্তরা ভল্ট ভেঙে ব্যাংক থেকে প্রায় ১০ লাখ টাকা লুট নিয়ে যায়। এ ঘটনার পর নতুন করে নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। ব্যাংকের শাখাগুলোর নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি পর্যালোচনা প্রতিবেদন তৈরি করে। ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগ থেকে পরিদর্শক দল বিভিন্ন শাখায় গিয়ে শাখার সার্বিক নিরাপত্তার পাশাপাশি ভল্টের নিরাপত্তার মান নিয়েও প্রতিবেদন তৈরি করে। এ ছাড়া ব্যাংকগুলোও নিজস্ব নিরাপত্তাব্যবস্থা পর্যালোচনা করে ঘাটতি থাকলে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। তবে এ নিয়ে প্রাথমিক পর্যায়ে যথেষ্ট তোড়জোর থাকলেও কদিন যেতে না যেতেই, নিরাপত্তাব্যবস্থায় ঢিলেমি দেখা দেয়। যে কারণে দুর্বৃত্তরা স্বল্প সময়ের ব্যবধানে একাধিক ব্যাংকে ডাকাতির ঘটনা ঘটিয়ে নির্বিঘ্নে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে।
যদিও একাধিক ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এই অভিযোগ অস্বীকার করে সম্প্রতি রুমা, থানচি ও কুমারখালীতে ঘটে যাওয়া ডাকাতি-চুরিকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে দাবি করেছেন। তাদের ভাষ্য, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে যথাযথ নিরাপত্তাব্যবস্থা রয়েছে। যে কারণে ব্যাংকের শাখায় চুরি-ডাকাতি কমে এসেছে। সরকার ও স্থানীয় প্রশাসন থেকেও ব্যাংকের নিরাপত্তায়ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনাগুলো পারস্পরিক স্বার্থের দ্বন্দ্বে কারণে সংঘটিত হয়েছে বলে তারা দাবি করেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এর আগে গত বছরের নভেম্বরের শেষভাগে ব্যাংকের স্থাপনায় অধিকতর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংক শাখার প্রবেশপথে, অভ্যন্তরে, শাখার বাইরে চতুর্দিকে এবং সব ধরনের আইটি রুমে প্রয়োজনীয় সংখ্যক সিসিটিভি বা আইপি ক্যামেরা বা স্পাই ক্যামেরা স্থাপন ও ধারণকৃত ভিডিও ফুটেজ নূ্যনতম এক বছর সংরক্ষণের নির্দেশ দেয়। পাশাপাশি ক্যামেরায় ধারণকৃত ভিডিও ফুটেজ যাতে প্রয়োজনে নিকটস্থ থানা বা পুলিশ পেতে পারে, সে বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়। ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১-এর ৪৫ ধারার প্রদত্ত ক্ষমতাবলে ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের পরিপালনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এ সংক্রান্ত এক সার্কুলার লেটার জারি করা হয়।
এতে বলা হয়, দেশের চলমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে ব্যাংক স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদার করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। আর এরই পরিপ্রেক্ষিতেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সার্কুলার জারি করে ব্যাংকগুলোকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে।
এর আগে ২০১৫ সালের ৫ জুলাই কেন্দ্রীয় ব্যাংক একই ধরনের নির্দেশনা জারি করে। সেখানে বলা হয়, ব্যাংকের শাখা, এটিএম বুথ এবং এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের নিরাপত্তার জন্য কখনই ক্যামেরা বন্ধ করা যাবে না।
গোয়েন্দারা জানান, ব্যাংকের শহুরে শাখায় এসব ব্যবস্থা থাকলেও বেশিরভাগ গ্রামীণ শাখায় নেই। কোথাও সিসিটিভি থাকলেও আইপি বা স্পাই ক্যামেরা নেই। এগুলো রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনার জন্য নেই যথাযথ কর্মকর্তা। অনেক ক্ষেত্রেই বাইরের কর্মকর্তা দিয়ে এগুলো পরিচালিত হচ্ছে।
সব শাখায় পর্যায়ক্রমে এন্টি থেফ্ট এলার্ম বসানোর নির্দেশনা থাকলেও বেশিরভাগ দুর্গম-নির্জন ও গ্রামীণ শাখাগুলোতে এটি বসানো হয়নি। শাখায় একাধিক নিরাপত্তাকর্মী নিয়োগের নির্দেশনা থাকলেও সেখানকার বেশিরভাগ ব্যাংকের শাখায় নিরাপত্তাকর্মী আছে একজন। যিনি অনেক ক্ষেত্রে জনবল সংকটে অফিস সহকারী বা পিয়নের কাজও করেন। অনেক ব্যাংকের শাখার নিরাপত্তাকর্মীরা তার ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্র সচল কিনা, তা জানেন না। কেননা, তাদেরকে কখনো বন্দুক দিয়ে গুলি করতে হয়নি।
অন্যদিকে ভল্টের নিরাপত্তায় সার্বক্ষণিক ব্যবস্থা, ভল্টের প্রবেশপথে সিসিটিভি, ভেতরে স্বয়ংক্রিয় অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র থাকার নির্দেশনা দেওয়া হলেও শহরের বাইরে অনেক ব্যাংক তা মানেনি। ব্যাংকে সম্ভাব্য চুরি-ডাকাতি বন্ধে দ্রম্নত পদক্ষেপ হিসেবে প্রতিটি শাখায় স্বয়ংক্রিয় এলার্ম সিস্টেমস স্থাপন করার নির্দেশ থাকলেও অনেক শাখায় তা নেই। ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়, থানা,র্ যাবসহ অন্যান্য ১০টি গুরুত্বপূর্ণ নম্বরে হটলাইন থাকার নির্দেশনা থাকলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি।
এ ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, ব্যাংক শাখার চারপাশের বাসিন্দাদের তথ্য রাখা ও তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগের মাধ্যমে সামাজিক সম্পর্ক রাখার কথা বলা হলেও শহর বা গ্রামীণ শাখার বেশিরভাগ ব্যবস্থাপক এ ধরনের কোনো উদ্যোগ নেননি।
সরকারি ও সাপ্তাহিক ছুটির দিন রাত্রিকালীন ব্যাংক কর্মকর্তা সুনির্দিষ্ট শাখা পরিদর্শন করার নিয়ম থাকলেও অনেকেই তা করেন না। প্রতিটি শাখাকে নিকটস্থ থানার সঙ্গে কথা বলে নিরাপত্তা ও পুলিশি টহলের ব্যবস্থা রাখার নির্দেশনা দেওয়া হলেও এই উদ্যোগও খুবই সামান্য। এ ছাড়া পুলিশও ব্যস্ততার কারণে এ ধরনের টহল বেশিরভাগ সময়ই দিতে পারে না বলে অভিযোগ রয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানান, ব্যাংকের শাখাগুলোর নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার ও মনিটরিং করার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। এ ব্যাপারে তাদের কোনো ধরনের প্রয়োজন হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সহযোগিতা করে থাকে। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকেও এ ব্যাপারে তৎপর হওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এর প্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী শাখা ব্যাংকগুলো যথাযথ নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করেছে কিনা, তারা তা খতিয়ে দেখবে। নিরাপত্তাব্যবস্থায় কোনো ঘাটতি পেলে তারা এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করবে। একই সঙ্গে ব্যাংককেন্দ্রিক যে নিরাপত্তা পুলিশ প্রশাসনকে দেওয়ার কথা রয়েছে, তা যথাযথভাবে পালন করা হচ্ছে কিনা, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তা মনিটরিং করবে।
এদিকে কুকিচিনসহ পার্বত্য এলাকায় আস্তানা গড়ে তোলা জঙ্গি সংগঠনগুলোর ওপর বিশেষ নজরদারির বিষয়টি নিশ্চিত করেছে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি পদমর্যদার একজন কর্মকর্তা। তিনি জানান, সৌন্দর্যের লীলাভূমি, সবুজেঘেরা পাহাড়ি অঞ্চলে আতঙ্কের নাম হয়ে উঠেছে কুকিচিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)। পার্বত্য অঞ্চলের ৯টি উপজেলায় স্বায়ত্তশাসন চাওয়া সশস্ত্র সংগঠনটি একের পর এক হত্যা, হামলা, অপহরণ, চাঁদাবাজির মতো অপরাধ করে চলেছে। এর আগে বান্দরবানের রুমায় অভিযানে গিয়ে গুলি ও আইইডি বিস্ফোরণে দুই সেনাসদস্য নিহত এবং দুই সেনা কর্মকর্তা আহত হন। কেএনএফের সশস্ত্র শাখা কুকিচিন এই হামলা চালায়। এর আগে বিভিন্ন সময় তাদের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে আতঙ্কিত হয়ে বাড়িঘর ছেড়েছেন পাহাড়ের বাসিন্দারা। এবার মাত্র ১৬ ঘণ্টার ব্যবধানে তিনটি ব্যাংক ডাকাতির ঘটনার পর নতুন আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও এসব ডাকাতির সঙ্গে কুকিচিনের সম্পৃক্ততা থাকার বিষয়ে ইঙ্গিত করেছেন।