ঈদের এখনো সপ্তাহখানেক বাকি, শুরু হয়নি এ উৎসবকেন্দ্রিক ছুটিও। তবে ঈদযাত্রায় পদে পদে ভোগান্তি এবং সড়ক-মহাসড়কে দীর্ঘ যানজটের দুর্ভোগ এড়াতে আগেভাগেই শেকড়ের টানে ঘরমুখো হচ্ছে মানুষ। বিশেষ করে শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার যেসব মানুষের কর্মস্থল থেকে ছুটি নেওয়ার ঝক্কি-ঝামেলা নেই, তারা এখুনি গ্রামের পথে পা বাড়িয়েছেন। ফলে বাস-লঞ্চ-ট্রেনে ঘরমুখো মানুষের চাপ বাড়ছে। এ পরিস্থিতিতে ঈদের ছুটি শুরুর আগেই যাত্রাপথে ভোগান্তি বাড়বে- এমন আশঙ্কা অনেকের।
পরিবহণ সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ) মহাসড়কের ১৫৫ স্থানকে ঈদযাত্রায় যানজটপ্রবণ হিসেবে চিহ্নিত করলেও বাস্তবে এ সংখ্যা ৭শ' ছাড়িয়ে যেতে পারে। এ ছাড়া রাজধানী ঢাকা থেকে বেরোনোর পথে গণপরিবহণের যাত্রীরা যানজটের চরম ভোগান্তিতে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। মহাসড়কের অবস্থা ভালো হলেও একসঙ্গে ঘরমুখো মানুষের চাপে বাড়তে পারে ছোট-বড় দুর্ঘটনাও।
এদিকে যাত্রীকল্যাণ সমিতির দেওয়া তথ্যানুযায়ী, এবারের ঈদে ঢাকা থেকে ১ কোটি, গাজীপুর থেকে ৪০ লাখ, নারায়ণগঞ্জ থেকে ১২ লাখসহ মোট ১ কোটি ৬০ লাখ যাত্রী দেশের বিভিন্ন জেলায় যাতায়াত করতে পারেন। গণপরিবহণে সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা না গেলে এবারের ঈদযাত্রায় হ-য-ব-র-ল পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।
গণপরিবহণে ঘরমুখো মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব আশঙ্কা মাথায় রেখে আগেভাগেই গন্তব্যে ছুটছেন তারা। কর্মজীবীরা নিজে যেতে না পারলেও পরিবারের অন্য সদস্যদের আগেই বাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছেন। কেউ কেউ শবেকদরের আগের তিন-চারদিনের অতিরিক্ত ছুটি নিয়ে পরিবারের সঙ্গে আগাম ঈদযাত্রায় শামিল হয়েছেন।
ঢাকা থেকে সন্তানদের নিয়ে খুলনার পথে রওনা দিয়েছেন গৃহবধূ নুসরাত শামীমা। সোহাগ পরিবহণ বাসের এই যাত্রী বলেন, 'ঈদের ছুটির সময় যাত্রীদের চাপ বেশি থাকে। যানজটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা
বসে থাকতে হয়। তাই সন্তানদের নিয়ে আগেই বাড়ি যাচ্ছি।' ঈদের ছুটি শুরু হওয়ার পর তার চিকিৎসক স্বামী ও চাকরিজীবী ছোটভাই বাড়ি ফিরবেন বলে জানান তিনি।
যশোরগামী হানিফ পরিবহণের যাত্রী আব্দুস সাত্তার জানান, তিনি ঢাকা থেকে ছেলের বউ আর নাতিদের নিয়ে মনিরামপুরে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছেন। রেডিমেড গার্মেন্টস ব্যবসায়ী ছেলে ঈদের আগের দিন রাতে গ্রামে রওনা দেবে।
বেনাপোলগামী যাত্রী সোহানা পারভীন জানান, তিনি স্বামীর সঙ্গে মালিবাগে থাকেন। তার স্বামীর বনানীতে ছোট একটি বুটিক শপ রয়েছে। ঈদের আগে এ ক'দিন ক্রেতার ভিড় থাকবে। তাই ঈদযাত্রার ভোগান্তি এড়াতে তিনি দুই সন্তান ও শাশুড়িকে নিয়ে বাড়িমুখো হয়েছেন। ঈদের আগের দিন নাইটকোচে তার স্বামী গ্রামে ফিরবেন।
ঢাকার বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষিকা মেহজাবিন সুলতানা জানান, খুলনার দাকোপে গ্রামের বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা-মা আর ছোট দুই ভাই আছে। স্কুল ছুটি হয়ে যাওয়ায় তিনি আগেভাগেই বাড়ি ফিরছেন। যানজটের আশঙ্কায় ভোরের গাড়ির টিকিট কেটেছেন। কিন্তু শহর থেকে গাড়ি বের হতেই প্রায় দেড় ঘণ্টা কেটে গেছে। বাকি পথে কতটা ভোগান্তি পোহাতে হবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা রাজীব আহমেদ ঢাকায় চাকরির প্রস্তুতির পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সিং করেন। ঈদযাত্রায় গণপরিবহণের ভোগান্তি এড়াতে আগেভাগেই ঢাকা ছাড়ছেন তিনি। রাজীবের ভাষ্য, ৯ এপ্রিল অফিস খোলা থাকলেও ৪ এপ্রিল থেকেই বাস, ট্রেন, লঞ্চে চাপ বাড়বে। এ সময় পথে পথে যানজটসহ নানা ভোগান্তিতে পড়তে হবে। এ ছাড়া বেপরোয়া গতির যানবাহনের আধিক্য সড়ক দুর্ঘটনাও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ঢাকায় যেহেতু তার ধারাবাধা কোনো কাজ নেই তাই আগেভাগেই নির্বিঘ্নে-নিরাপদে গ্রামের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন।
একই কারণে ঈদের এখনো সপ্তাহখানেক বাকি থাকলেও বাড়ির পথে রওনা হয়েছেন তিতুমীর কলেজের ছাত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস। তিনি জানান, ঈদের ছুটি শুরু হলে দিনাজপুরে গ্রামের বাড়ি যেতে নানা ভোগান্তি পোহাতে হয়। এ ছাড়া বাস-ট্রেনের টিকিট পাওয়াও কষ্টকর হয়ে পড়ে। তাই এবার আগেভাগেই গ্রামে ফিরছেন।
এদিকে শুধু সড়ক পথেই নয়, রেলপথেও ঘরমুখো মানুষের চাপ বেড়েছে। ঈদের আগাম টিকিট জোগাড় করতে না পেরে অনেকে আগেভাগেই বাড়ির পথ ধরেছেন।
মঙ্গলবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কমলাপুর স্টেশন ঘুরে দেখা গেছে, আগাম ঈদযাত্রায় শিক্ষার্থী এবং চাকরিজীবীদের পরিবারের সদস্যরাই বেশি। এ ছাড়া ঈদকে সামনে রেখে নির্মাণ শ্রমিকসহ যেসব শ্রমজীবী মানুষের কাজ কমে গেছে তারাও গ্রামের দিকে ছুটছেন।
কমলাপুর রেলস্টেশনে ট্রেনের জন্য অপেক্ষায় থাকা রাজমিস্ত্রি মোজাম্মেল হোসেন জানান, ঈদের আগে বেশিরভাগ নির্মাণকাজ বন্ধ হয়ে গেছে। একদিন কাজ পেলে আরেক দিন বসে থাকতে হচ্ছে। তাই তিনি আগেভাগেই গ্রামে ফিরে যাচ্ছেন। ঈদের ছুটিতে বাস-ট্রেনে টিকিট পেতে যুদ্ধ করতে হয়। এ ছাড়া বাড়তি ভাড়াও দেওয়া লাগে। তাই ঈদের সপ্তাহখানেক বাকি থাকলেও আগেই লালমনিরহাটে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছেন।
ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে যাওয়ার জন্য ট্রেনের টিকিট কেটে পস্নাটফর্মে অপেক্ষা করছিলেন রং মিস্ত্রি সোহরাব মিয়া। তার ভাষ্য, ১৫ রোজার পর থেকে ঢাকায় কাজ কমে গেছে। তাই ঈদযাত্রার ভোগান্তি এড়াতে আগেভাগেই গ্রামে চলে যাচ্ছেন।
মিরাজ হোসেন নামে এক চাকরিজীবী জানান, অফিস থেকে তিনি ছুটি পাবেন ঈদের একদিন আগে। তখন স্ত্রী-সন্তান গিয়ে বাড়ি যেতে পথে পথে নানা ভোগান্তিতে পড়ার শঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া এক সঙ্গে এতোগুলো টিকিট জোগাড় করা কষ্ট হবে। তাই তাদের আগেই সীতাকুন্ড গ্রামের বাড়িতে রেখে তিনি ঢাকায় ফিরে আসবেন। ঈদের একদিন আগে প্রয়োজনে তিনি বাসে কিংবা ট্রেনে ঝুলেও বাড়ি যেতে পারবেন।
গত ২৪ মার্চ থেকে এবার ঈদযাত্রার টিকিট বিক্রি শুরু হয়। প্রথম দিন দেওয়া হয় ৩ এপ্রিলের টিকিট। রোজার শুরু থেকে ট্রেনের টিকিট সহজলভ্য হলেও ঈদের আগের টিকিট সোনার হরিণ হয়ে ওঠে। এই বাস্তবতায় এর আগের দিনগুলোর টিকিট কেটে নেন অনেকে।
রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে বেলা সাড়ে ১১টায় সিলেটের উদ্দেশে ছেড়ে গেছে জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস। ট্রেনটির পরিচালক হাসান সিকদার বলেন, ঈদের আগামযাত্রা শুরু হলেও যাত্রীদের চাপ নেই। স্বাভাবিক সময়ের চেয়েও আজ যাত্রী কম। সরকারি ছুটি শুরু না হওয়ায় যাত্রীর চাপ নেই উলেস্নখ করে হাসান সিকদার বলেন, বৃহস্পতিবার (আজ) বিকাল থেকে যাত্রীর চাপ কিছুটা বাড়তে পারে।
এদিকে নৌপথে আগাম ঈদযাত্রার চিত্র একেবারেই ভিন্ন। বুধবার সরেজমিন সদরঘাট টার্মিনালে দেখা গেছে, অনেকটাই ফাঁকা পড়ে আছে সদরঘাট টার্মিনাল, অলস সময় কাটাচ্ছেন লঞ্চের কর্মীরা।
লঞ্চের মালিক ও কর্মীদের ভাষ্য, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর দক্ষিণাঞ্চলের যাত্রীরা সড়কপথকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। তাই আগের মতো আর লঞ্চে যাত্রী পাওয়া যাচ্ছে না। ঈদ উপলক্ষেও অগ্রিম টিকিটের তেমন চাহিদা নেই। আগে সাধারণত ২০ রোজার পর থেকে আগাম ঈদযাত্রা শুরু হতো। সেই টিকিট কিনতে ভিড় হতো প্রচুর। অনেকে কাঙ্ক্ষিত টিকিট পেতেন না। তবে গত কয়েক বছরে সে চিত্র পুরোপুরি পাল্টে গেছে।
এ সম্পর্কে অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল (যাপ) সংস্থার ঢাকা নদীবন্দরের আহ্বায়ক মামুন অর রশিদ বলেন, আগে যাত্রীরা সশরীর এসে, কেউবা মুঠোফোনে, কেউবা অনলাইনে লঞ্চের অগ্রিম টিকিট বুকিং দিতেন। এখন আর আগের মতো লঞ্চের টিকিটের চাহিদা ও প্রতিযোগিতা নেই। আগাম ঈদযাত্রার অবস্থা আরও নাজুক। লঞ্চ ভরে যাত্রী পাওয়াই এখন দায় হয়ে পড়েছে।
বুধবার দুপুর সাড়ে ১২টায় মুলাদীগামী এমভি মিতালী লঞ্চে গিয়ে দেখা যায়, লঞ্চের তিনজন কর্মচারী মুঠোফোনে গেমস খেলছেন। তাদের মধ্যে শাহজাহান নামে এক কর্মচারী বলেন, 'আগে ঈদের ১৪-১৫ দিন আগে থেইক্যা দক্ষিণাঞ্চলের যাত্রীরা অগ্রিম টিকিটের লাইগ্যা লঞ্চে লঞ্চে ভিড় জমাইত। ২০ রোজার পর অনেকে স্ত্রী-সন্তানদের বাড়ি পাডাইয়্যা দিত। ঈদের আর মাত্র ৬-৭ দিন বাকি এখনো টার্মিনালে ভিড় জমে নাই। কবে জমব হ্যারও ঠিক নাই।'
সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে দেখা হয় ৫ এপ্রিলের টিকিট কিনতে আসা বীমা কর্মকর্তা আবু জাফরের সঙ্গে। তিনি জানান, লঞ্চে এখন ভিড় না থাকলেও দুই-একদিনের পর এ অবস্থার পরিবর্তন হবে। তখন অধিকাংশ লঞ্চই ধারণ ক্ষমতার কয়েকগুণ বেশি যাত্রী নিয়ে গন্তব্যে রওনা দেবে। এতে দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা থাকে। তাই পরিবার-পরিজন নিয়ে কয়েকদিন আগেই বরগুনার আমতলীতে গ্রামের বাড়ি ফিরতে চান তিনি।