সোমবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
রুমায় সোনালী ব্যাংক থেকে টাকা লুট হয়নি : সিআইডি

রুমার পর এবার থানচির দুই ব্যাংকে ডাকাতি

বান্দরবান প্রতিনিধি
  ০৪ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
রুমার পর এবার থানচির দুই ব্যাংকে ডাকাতি

বান্দরবানের রুমায় সোনালী ব্যাংকে হামলা ও লুটের চেষ্টার পর এবার থানচি উপজেলার দুটি ব্যাংকে সশস্ত্র ব্যক্তিরা হামলা চালিয়েছে। এ সময় তারা টাকা লুট করেছে। বুধবার বেলা সাড়ে ১২টায় একদল সশস্ত্র লোক দুটি গাড়িতে করে এসে পাশাপাশি থাকা কৃষি ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংক শাখায় হামলা চালায়। তবে সিআইডি জানিয়েছে, রুমায় সোনালী ব্যাংক থেকে টাকা লুট করতে পারেনি হামলাকারীরা। ওই ব্যাংকের ভল্টে থাকা সব টাকা অক্ষত আছে।

এদিকে, রুমায় সোনালী ব্যাংকে সশস্ত্র হামলা ও লুটের চেষ্টার ঘটনায় এখনো খোঁজ মেলেনি 'অপহৃত' শাখা ব্যবস্থাপক নেজাম উদ্দিনের। পুলিশ জানিয়েছে, অস্ত্র ও গুলি লুটের ঘটনায় তদন্ত চলছে। এসব ঘটনায় পাহাড়ে সশস্ত্র গোষ্ঠী কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) জড়িত থাকতে পারে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছেন স্থানীয়রা। অবশ্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও বুধবার একই কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, 'এ ঘটনায় কুকি চিং নামে একটি সংগঠন জড়িত বলে জানা গেছে। তবে এ বিষয়ে এখনো

বিস্তারিত তথ্য জানা যায়নি।'

ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বান্দরবানের থানচিতে বুধবার দুপুর সাড়ে ১২টায় একটি জিপে করে ৩০ জনের একটি সশস্ত্র গ্রম্নপ সীমান্ত সড়ক দিয়ে এসে সোনালী ব্যাংক ও কৃষি ব্যাংকে অতর্কিত হামলা চালায়। এ সময় কৃষি ব্যাংক থেকে আড়াই লাখ টাকা এবং সোনালী ব্যাংক থেকে ১৪ থেকে ১৫ লাখ টাকা নিয়ে যায়।

কৃষি ব্যাংকের থানচি উপজেলার শাখার ব্যবস্থাপক হ্লা সুই থোয়াই জানান, 'তারা (ডাকাত দল) এসে চোখের পলকে আমাদের ব্যাংকে ঢুকে সবাইকে জিম্মি করে ফেলল। তারপর সবাইকে একটি কক্ষে নিয়ে বাইরে থেকে আটকে দিল।'

একই সময় পাশের সোনালী ব্যাংকেও হামলা হয় বলে কৃষি ব্যাংকের ব্যবস্থাপকের ভাষ্য। তবে এ বিষয়ে সোনালী ব্যাংকের কারও বক্তব্য জানা যায়নি।

থানচির ঘটনা নিয়ে জানতে চাইলে বান্দরবানের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম) আব্দুল করিম বলেন, 'থানচিতে ব্যাংকে হামলা হয়েছে বলে আমরা খবর পেয়েছি। আমাদের ধারণা, গতকালের (মঙ্গলবারের) গ্রম্নপটিই এটা করেছে।'

থানচি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ মামুন বলেন, 'থানচি বাজারে এসে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা সোনালী ব্যাংক ও কৃষি ব্যাংকে প্রবেশ করে টাকা লুট করে নিয়ে গেছে বলে জেনেছি। সোনালী ব্যাংক থেকে ১৪-১৫ লাখ টাকা নিয়ে গেছে বলে শুনেছি। তবে কৃষি ব্যাংক থেকে কত টাকা নিয়েছে জানা যায়নি। সেখান থেকে কাউকে অপহরণ করার সংবাদও পাওয়া যায়নি।'

স্থানীয়রা বলেন, ব্যাংকে যারা ডাকাতির জন্য প্রবেশ করেছিলেন তার বাইরেও তাদের আরও লোকজন সশস্ত্র অবস্থায় ছিলেন। তারা বাজারের বিভিন্ন পয়েন্টে অস্ত্র নিয়ে অবস্থান নেন।

থানচি বাজারের এক ব্যবসায়ী বলেন, 'বুধবার থানাচিতে সাপ্তাহিক বাজার। উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন থেকে লোকজন মালামাল নিতে এখানে এসেছিলেন। বেলা সোয়া ১২টা থেকে সাড়ে ১২টার মধ্যে তিনটি জিপে কয়েকশ লোক আসে। আমরা তিনটি গাড়িতে করে লোকজন আসতে দেখেছি। তার মধ্যে দুটি গাড়ি থেকে নেমে তারা দুই ব্যাংকে যায়। একটি গাড়ি ব্যাংকের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল।'

বুধবার সাপ্তাহিক বাজার থাকায় দুই ব্যাংকেই অনেক গ্রাহক ছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, 'সোনালী ব্যাংকে প্রবেশ করে দলটির সদস্যরা ম্যানেজারকে খুঁজতে থাকে। না পেয়ে ক্যাশ বাক্সে থাকা টাকা নিয়ে যেতে দেখা গেছে।'

সশস্ত্র দলটির সঙ্গে কয়েকজন নারীও ছিলেন জানিয়ে ওই ব্যবসায়ী বলেন, 'দলটির লোকজন খাকি পোশাক পরে ছিলেন। আমাদের ধারণা, তারা কুকি-চিন পার্টির সদস্য।'

ব্যাংক লুট শেষে সশস্ত্র দলটি থানচি বাজারে প্রকাশ্যে ব্রাশফায়ার করে আতঙ্ক তৈরি করে এবং তিনটি জিপে চড়ে চাঁদাপাড়া এলাকার সড়কের দিকে চলে যায় বলে জানান ওই ব্যবসায়ী।

তিনি বলেন, সিনেমায় যেভাবে প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে ব্যাংক লুটের দৃশ্য দেখা যায় এ দৃশ্যটাও এমন মনে হয়েছে তার কাছে।

এর আগে মঙ্গলবার রাত ৯টায় শতাধিক সশস্ত্র ব্যক্তি রুমা উপজেলা সদরে সোনালী ব্যাংকের শাখায় একযোগে হামলা চালায়। এ সময় ব্যাংকের কর্মকর্তা, নিরাপত্তা রক্ষীসহ অন্তত ২০ জনকে মারধর করা হয়। অপহরণ করা হয় এ শাখার ব্যবস্থাপক নেজাম উদ্দিনকে। এ ছাড়া ১৪টি অস্ত্র ও ৪১৫ রাউন্ড গুলিও লুট করে নিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। রুমার ঘটনার রেশ কাটতে-না কাটতেই থানচিতে দুটি ব্যাংকে হামলা ও টাকা লুটের ঘটনা ঘটল।

এদিকে, রুমা শাখার সোনালী ব্যাংক লুটের চেষ্টার ঘটনাস্থলে পরিদর্শন করেছেন জেলা প্রশাসন, পুলিশ সুপার ও সোনালী ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। ব্যাংক লুটের ঘটনার খবর পেয়ে বুধবার সকালে পরিদর্শন করতে যান তারা। এসময় রুমা শাখার সোনালী ব্যাংকটির বিভিন্ন কক্ষ ঘুরে দেখেন জেলা প্রশাসন ও পুলিশের কর্মকর্তারা। পরে ব্যাংকের ভল্টটি পর্যবেক্ষণ করেন তারা।

বুধবার বিকাল সাড়ে ৪টায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিশেষ পুলিশ সুপার শাহনেওয়াজ খালেদ বলেন, সিআইডির চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার ইউনিটের দুটি দল রুমায় গিয়ে বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করেছে। পরে ব্যাংকের ভল্ট খুলে সব টাকা গুণে দেখা হয়। দেখা যায়, মঙ্গলবার রাখা ১ কোটি ৫৯ লাখ ৪৬ হাজার টাকার পুরোটা রয়েছে। তিনি আরও বলেন, দুটি চাবি একসঙ্গে দিয়ে ভল্ট খুলতে হয়। কোনো কারণে অস্ত্রধারীরা হয়তো ভল্ট খুলতে পারেনি।

বুধবার সকালে রুমা শাখার সোনালী ব্যাংকে গিয়ে দেখা যায়, উপজেলা প্রশাসনের লাগোয়া সোনালী ব্যাংকটি দ্বিতল ভবন। প্রতিটি কক্ষে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে কাগজপত্র। টেবিলের ওপর থাকা কাচগুলো ভাঙা। কম্পিউটারগুলো ভাঙাচোরা হয়ে এলোমেলো পড়ে রয়েছে। বিভিন্ন ইলেকট্রিক্যাল পয়েন্টগুলোও ভাঙা হয়েছে। এমনকি রুমের দরজা-জানালাও ভাঙা অবস্থায় রয়েছে।

ব্যাংকটি ক্যাশিয়ার উথোয়াইচিং মারমা সাংকাদিকদের ঘটনার বর্ণনা করে বলেন, মঙ্গলবার রাতে বাইরে একটা দোকানে চা খেতে যান তিনি। তখন হঠাৎ তিনজন সশস্ত্র ব্যক্তি তাকে ঘিরে ফেলে। তাকে বন্দুক তাক করে পকেটে তলস্নাশি করে চাবি কেড়ে নিয়ে যায়। তখন শতাধিক ব্যক্তি ব্যাংকে ঘিরে রাখতে দেখা যায়। ভেতরে সবকিছু তছনছ করে ফেলে সন্ত্রাসীরা।

তিনি বলেন, আমার কাছ থেকে নিয়ে যাওয়া চাবি দিয়ে তারা ভল্ট খোলার চেষ্টা করেছে। ম্যানেজার থেকে চাবি না পেয়ে হয়তো তাকে তুলে নিয়ে গেছে। সামনে পাহাড়িদের বর্ষবরণ উৎসব এবং ঈদের জন্য বেতনভাতা দেওয়ার জন্য মোট এক কোটি ৫৯ লাখ টাকা ছিল বলেও জানান তিনি।

ব্যাংক লুটের ঘটনায় পুলিশ ও আনসারে অস্ত্র বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা পুলিশ সুপার সৈকত শাহীন বলেন, কে বা কারা করেছে এটা তদন্ত চলছে। তদন্ত সাপেক্ষে এটা বলতে পারব, কে বা কারা এ ঘটনায় জড়িত। ক্রাইম সিনের দল ফিঙ্গার প্রিন্ট নেবে। অলরেডি তদন্ত শুরু হয়েছে। সিসিটিভি ফুটেজ রয়েছে। এটা জব্দ করা হয়েছে। তদন্তে যে বা যারা জড়িত থাকুক কঠোরভাবে আইনগতভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পর্যবেক্ষণ শেষে জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। ডিআরবি জব্দ করা আছে। তদন্ত ব্যতীত স্পষ্টভাবে বলা কঠিন বিষয়। তদন্ত সাপেক্ষে যদি সঠিক তথ্য পায় তখন অবহিত করা হবে।

পরিদর্শনের সময় আরও উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম উত্তর বিভাগীয় কার্যালয়ে জেনারেল ম্যানেজার মো. মুসা খান ও বান্দরবান শাখার ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার ওসমান গণি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে