জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে দেশের দক্ষিণের খুলনা, বরিশাল, ঝালকাঠি, পিরোজপুরসহ উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ সুপেয় পানির তীব্র সংকটে পড়েছেন। সবখানেই লবণজলের আগ্রাসন। শুধু দেশের উপকূলীয় অঞ্চল নয়, লবণপানির আগ্রাসন ভবিষ্যতে ঢাকা-শহরের চারপাশের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। এদিকে, ২০৫০ সালের মধ্যে দেশের বেশিরভাগ এলাকা লবণাক্ত হয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। জলবায়ুর প্রভাবে দেশের উপকূল, পাহাড়ি, চরাঞ্চল, হাওড় ও বরেন্দ্র অঞ্চলের প্রায় তিন কোটির বেশি মানুষ বিশুদ্ধ খাবার পানি থেকে বঞ্চিত। দিনের পর দিন সারাদেশে লবণপানির আগ্রাসন বাড়বে। এতে কমে আসবে সুপেয় পানির আধার।
ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জের (আইপিসিসি) এক মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি শতকের মধ্যে বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ এলাকা ডুবে যেতে পারে। দেশের উপকূলের ১৯টি জেলার প্রায় ৬০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকার মানুষ লবণপানির ঝুঁকিতে পড়বে। এতে প্রায় তিন কোটি মানুষ লবণাক্ততায় ক্ষতিগ্রস্ত হবে। লবণাক্ততা, আর্সেনিক দূষণ আর ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় সুপেয় পানীয়জলের সংকটে ভুগছে বাংলাদেশ। লবণাক্ততার কারণে এসব এলাকায় ফসল উৎপাদন কম হয়। চলতি শতকের মধ্যে বঙ্গোপসাগরের পানির উচ্চতা এক মিটার বাড়লে দেশের তিন হাজার ৯৩০ বর্গকিলোমিটার এলাকা ডুবে যেতে পারে। এসব এলাকার প্রায় ৬০ লাখ মানুষ নতুন করে জলবায়ু উদ্বাস্তু হতে পারে।
বাংলাদেশ পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপের অন্যতম। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভয়াবহ পানির সংকটে পড়েছে বাংলাদেশ। উপকূলের চারপাশে সাগরে শুধু লবণপানি। অথচ এক ফোঁটা খাবার পানি জোগাড় করতে ঘাম ঝরাতে হয়। উপকূলের মানুষকে ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে গিয়ে এক কলসি পানি কিনে আনতে হয়। উপকূলীয় এলাকায় এক কলসি পানির দাম পঞ্চাশ থেকে আশি টাকা। উপকূলের নারীদের পানির সন্ধানে পাড়ি দিতে হয় দীর্ঘপথ। বিশুদ্ধ যাচাই-বাছাই তো দূরের কথা, কোনোমতে খাওয়া যায় এমন খাবার পানি জোগাড় করতেই উপকূলের নারীদের দিন কেটে যায়।
এ বিষয়ে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত দৈনিক যায়যায়দিনকে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দিনের পর দিন দেশের উপকূল অঞ্চলে লবণাক্ততার আগ্রাসন বাড়ছে। মিষ্টি পানির আধারগুলো লবণপানিতে ভরে যাচ্ছে। দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে লবণাক্ততা আরও ভেতরে প্রবেশ করবে। এমনকি ঢাকা শহরের কাছে পৌঁছে যাবে। আগামীতে খুলনা-সাতক্ষীরা সমুদ্রের অংশ হবে। রাজশাহী থেকে সিরাজগঞ্জ হয়ে আশুগঞ্জ পর্যন্ত লবণপানি চলে
\হআসবে। এমনকি ঢাকা-শহরের চারপাশও লবণাক্ত হয়ে যাবে। ঢাকা-শহর অনেক উঁচু। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ঢাকা-শহরের উচ্চতা ২৫ ফুট। কিন্তু ঢাকা-শহরের পাশে কামরাঙ্গীরচর ও জিঞ্জিরার উচ্চতা ৪ থেকে ৫ ফুট। ফলে এসব এলাকায় আগামীতে লবণপানিতে পস্নাবিত হবে, যা আমাদের সংকটকে বাড়িয়ে দেবে। আষাঢ়েও এখন বৃষ্টির দেখা পাওয়া যায় না। কয়েক বছর ধরে খরা পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে। এতে ফসল উৎপাদন বিঘ্ন ঘটছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বাংলাদেশের প্রায় ২৫ শতাংশ উপকূলীয় এলাকা। এ এলাকার ১৯টি জেলার ১৫ লাখ হেক্টরের বেশি জমি বিভিন্ন মাত্রায় লবণাক্ত হয়ে পড়েছে। এই লবণাক্ততার কারণে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির প্রধান অন্তরায়। জলবায়ু বিজ্ঞানীরা বলছেন, বাংলাদেশের সাড়ে চার কোটি মানুষ ২০৫০ সালের মধ্যেই সমুদ্রের নোনাপানি ঝুঁকিতে পড়বে। আর চলতি শতাব্দীর মধ্যে ক্ষতির শিকার হওয়া মানুষের সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় সাত কোটি।
বিশ্বের প্রভাবশালী বিজ্ঞান সাময়িকী নেচার কমিউনিকেশনে এ বিষয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বাংলাদেশ নিয়ে এ ভয়াবহ খবর তুলে ধরা হয়েছে। 'ক্লাইমেট সেন্ট্রাল' নামে জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার ফলে বিশ্বের উপকূলীয় অঞ্চল ও দ্বীপরাষ্ট্রগুলো পানিতে তলিয়ে যাবে। ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জের (আইপিসিসি) বরাত দিয়ে চলতি শতাব্দীর শেষ নাগাদ বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের নিম্নাঞ্চলীয় এলাকার ১৩ কোটি মানুষ বাস্তুচু্যত হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
জলবায়ু পরিবর্তন জীবন ও অর্থনীতির অস্তিত্বের জন্য একটি হুমকি। জলবায়ু পরিবর্তন জীবন ও অর্থনীতির অস্তিত্বের জন্য একটি হুমকি। লবণাক্ততা এখন ঘরের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে। সাগরে লবণাক্ততা বৃদ্ধি বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষের জীবন ও জীবিকার ওপর মারাত্মক নৈতিবাচক প্রভাব ফেলছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি, নদীভাঙন, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, বন্যা ও খরার মতো প্রাকৃতিক ঘটনায় বাস্তুচু্যত হওয়া মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশে এরই মধ্যে জলবায়ু অভিবাসীদের সংখ্যা ৬০ লাখ ছাড়িয়েছে। নারীদের ওপর লবণাক্ততার প্রভাব বেশি। বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে যে হারে তাপমাত্রা বাড়ছে সেই ধারা অব্যাহত থাকলে রাজধানী ঢাকাসহ পাঁচটি বড় শহর বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে।
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার তথ্যমতে, জলবায়ু শরণার্থীদের একটি বড় অংশই শহরমুখী হচ্ছে অর্থনৈতিক কারণে। গবেষণা সংস্থা গ্রাউন্ডশেল আশঙ্কা প্রকাশ করে জানায়, ২০৫০ সালের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় চার কোটি, লাতিন আমেরিকায় এক কোটি ৭০ লাখ এবং সাব-সাহারান অঞ্চলে আট কোটি ৬০ লাখ মানুষ জলবায়ু শরণার্থীতে পরিণত হবে।
গবেষকদের মতে, ২০৫০ সালের মধ্যে এক কোটি ৩৩ লাখ বাংলাদেশি জলবায়ু শরণার্থীতে পরিণত হবে, যা মোট জনসংখ্যার ৮ শতাংশ। ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের প্রতি সাতজনে একজন জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে উদ্বাস্তু হবে। এ হিসাবে ২০৫০ সালের মধ্যে উদ্বাস্তু মানুষের সংখ্যা দাঁড়াবে এক কোটি ৩০ লাখ। এ তথ্য কম্প্রিহেনসিভ ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রামের।
বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশের মানুষ অনেকটা অযাচিতভাবেই জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট নানাবিধ দুর্যোগের শিকার। জলবায়ুর প্রভাবে নিয়মিত বড় বন্যা হচ্ছে। কৃষির ক্ষতি হচ্ছে। নদীভাঙন বেড়ে গেছে। উপকূলীয় মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে শহরমুখী হচ্ছে। বরেন্দ্র অঞ্চলে পানি সংকট দেখা দিয়েছে। লবণাক্ত হচ্ছে কৃষিজমি। বায়ুদূষণ ও বজ্রপাত বেড়ে যাচ্ছে। দক্ষিণাঞ্চলে পানিস্বল্পতায় খরা পরিস্থিতি হয়েছে।
আইপিসিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের দক্ষিণের খুলনা, বরিশাল, ঝালকাঠি, পিরোজপুরসহ ১৬ জেলায় সুপেয় পানি নেই। সবখানেই লবণজলের আগ্রাসন। পার্বত্য জেলাগুলোতে শুষ্ক মৌসুমে তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। ফলে অধিক তাপে সেখানকার মাটির বুনন আলগা হয়ে যাচ্ছে। আবার বর্ষায় বৃষ্টি বেড়ে সেখানে পাহাড়ধস বাড়ছে।
শিল্পোন্নত দেশগুলোর লাগামহীন আচরণে পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়ছে। উন্নত দেশগুলোর শিল্পকারখানা ও ব্যক্তিগত ভোগ-বিলাসের ফলে গ্রিনহাউস গ্যাসের ব্যাপক নির্গমন ঘটছে। কার্বন ডাইঅক্সাইড পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। পৃথিবী উষ্ণ হওয়ার কারণেই জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে। বাড়ছে জলবায়ুর অস্বাভাবিক আচরণ। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এ পরিবর্তনের মাশুল দিতে হচ্ছে উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোকে। তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।