দেশে প্রতি ৫৮৯ জন শিশুর মধ্যে ১ জন অটিজমে আক্রান্ত। অর্থাৎ প্রতি দশ হাজারে ১৭ জন শিশু অটিজমে আক্রান্ত। এমনকি প্রতি ৪২৩ জন ছেলে শিশুর মধ্যে ১ জন এবং ১ হাজার ২৬ মেয়ে শিশুর মধ্যে ১ জন অটিজমে আক্রান্ত হচ্ছে। মেয়ে শিশুর তুলনায় ছেলে আড়াইগুণ বেশি আক্রান্ত হয়। গ্রামের ৭১ শতাংশ এবং শহরের ২৯ শতাংশ বাসাবাড়িতে গিয়ে শহরে সবচেয়ে বেশি প্রতি ১০ হাজারে ২৫ জন এবং গ্রামে প্রতি ১০ হাজারে ১৪ জন অটিজমে আক্রান্ত শিশু পাওয়া যায়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ইনস্টিটিউট অব পেডিয়াট্রিক নিউরোডিজঅর্ডার অ্যান্ড অটিজমের (ইপনা) উদ্যোগে পরিচালিত এক জরিপের সর্বশেষ প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। ওই জরিপটি দেশের আট বিভাগের ৩০ জেলায় ৩৭ হাজার ৯৪২ বাড়িতে গিয়ে ১৬ থেকে ৩০ মাস বয়সি ১ লাখ ৮৬ হাজার ৬৮ জন শিশুর ওপর পরিচালিত হয়।
এ বাস্তবায়তায় বিশ্বের ন্যায় সারাদেশে আজ বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস পালিত হচ্ছে। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে 'সচেতনতা-স্বীকৃতি-মূল্যায়ন : শুধু বেঁচে থাকা থেকে সমৃদ্ধির পথে যাত্রা'।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর জাতীয় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে সর্বশেষ জরিপে (এনএসপিডি) দেখা গেছে, দেশে ৮০ থেকে ৯০ লাখ মানুষের কোনো না কোনো প্রতিবন্ধিতা আছে। এর মধ্যে অটিজম আক্রান্ত শিশু আছে ৭৪ হাজারের উপরে। এমনকি প্রতিবন্ধীদের মধ্যে শূন্য থেকে চার বছর বয়সি শিশুদের ২৪ শতাংশ এবং পাঁচ থেকে ১৭ বছর বয়সিদের ৪৩ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা পায় না।
সুচনা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও ইপনার ট্রেনিং কো-অর্ডিনেটর হ পৃষ্ঠা ২ কলাম ২
ডা. মাজহারুল মান্নান যায়যায়দিনকে বলেন, 'অটিজমে আক্রান্ত শিশুর প্রকৃত শিশুর সংখ্যা বলা খুবই কঠিন। কারণ একটা শিশুর মধ্যে কিছু লক্ষণ দেখা গেলে অভিভাবক শিশুকে হাসপাতালে নিয়ে গেল, চিকিৎসক অটিজম লিখে দিল বিষয়টা এমন না। কারণ এদের অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে, একটি সিদ্ধান্তে আসতে হবে। আর অটিজমে আক্রান্তদের কোনো চিকিৎসা নেই। তাদের সঠিক ব্যবস্থাপনা দিয়ে চিকিৎসা সেবা দিতে হয়।'
সুচনা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান বলেন, 'দেশে গ্রামাঞ্চলে অটিজম রোগী আছে, তবে কম। কারণ গ্রামের সচ্ছল পরিবারে কারও সন্তানের অটিজমের লক্ষণ থাকলে তারা শিশুটিকে নিয়ে শহরে শিফট করে। পরবর্তীকালে যখন কোনো অটিজম শনাক্ত হয় তখন সেটা শহরের রোগী হিসেবে পরিগণিত হয়। সেভাবেই শহরের রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়। গ্রামের রোগী যেন গ্রামেই চিকিৎসা করতে পারে তাই আমরা কমিউনিটি হাসপাতালগুলোতে অটিজমের ওপর ট্রেনিংপ্রাপ্ত জনবল দিয়েছি। আমরা গাইডলাইনও তৈরি করেছি। পর্যায়ক্রমে গ্রামে আরও সুযোগ সুবিধা বাড়ানো হবে।'
ইপনার সেন্টার থেকে প্রতিদিন গড়ে ১২০ রোগী ফিরে যাচ্ছে
সরকারি চাকরিজীবী পিতা-মাতার দ্বিতীয় সন্তান ইভান। ২ বছর বয়স থেকে টুকটাক কথা বলতে পারলেও সাড়ে ৪ বছর বয়সে কথা বলার গতি পাচ্ছিল না। এর সঙ্গে অন্যান্য আরও কিছু সমস্যা দেখা দিল। বিভিন্ন জায়গায় চিকিৎসক দেখিয়ে কোনো লাভ হয়নি। পরে এক চিকিৎসের পরামর্শে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ইনস্টিটিউট অব পেডিয়াট্রিক নিউরোডিজঅর্ডার অ্যান্ড অটিজম (ইপনা) সেন্টারে নিয়ে আসেন। এখানে এসেও চিকিৎসকের সাক্ষাৎ পাননি।
ইভানের পিতা শরিফুল ইসলাম যায়যায়দিনকে বলেন, 'ময়মনসিংহ শহর থেকে এসেছি। এখানে পৌঁছে দেখি পৌনে ১২টা বাজে। এসে আর সিরিয়াল পাইনি। আমার এখন ঘুরে যেতে হচ্ছে।' একইভাবে ঘুরে যেতে হয়েছে নবাবগঞ্জের ৫ বছর বয়সের আরিয়ানকে। প্রবাসী বাবার ছেলেকে দাদা-দাদি নিয়ে এসেছেন। দাদা রাজু আহমেদ বলেন, 'আমার নাতনির সবই ভালো ছিল। কথাবার্তা বলতে পারে। কিন্তু হঠাৎ করেই কান্না শুরু করে। প্রায় সময় অন্যমনস্ক থাকে। এলাকার হাসপাতালে ডাক্তার দেখাইছি, কোনো লাভ হয়নি। এখানে এসে চিকিৎসক পাইনি। এখানকার এক অধ্যাপকের নম্বর নিয়ে যোগাযোগ করলেও সিরিয়াল পাওয়া যায়নি। এখন ঘুরে যাওয়া ছাড়া কোনো গতি নেই।'
সরেজমিন কথা হয় ইভানের বাবা ও আরিয়ানের দাদার সঙ্গে। শুধু ইভান কিংবা আরিয়ান নয় তাদের মতো আর ৮০-১২০ জন রোগী প্রতিদিন ইপনা সেন্টার থেকে ঘুরে যেতে দেখা যায়। ইপনা সেন্টারের কর্মকর্তারা জানান, এ ইনস্টিটিউটের অধীনে ২৬ শয্যা ইনডোর সেবা ও ৫০ আসনের অটিজম স্কুল চালু আছে। আউটডোরে ৭০ জন রোগী দেখার সক্ষমতা আছে। তবে এখানে প্রতিদিন ১১০-১৩০ জন রোগী দেখা হয়। সারাদেশের প্রতিদিন গড়ে ২৫০-২৮০ জনের মতো রোগী আসে। এর মধ্যে বাকি রোগীদের ঘুরে যেতে হয়। এখানে শিশু নিউরোলোজি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট থেরাপিস্ট, সাইকোলোজিস্ট, কাউন্সিলর, নিউট্রিশনিস্ট, অটিজম শিক্ষক, প্রশাসনিক কর্মকাতা- কর্মচারীসহ মাল্টি-ডিসিপিস্ননারি বিশেষজ্ঞ টিম নিয়মিত কাজ করছে।
ইপনার অটিজম স্কুলের প্রধান শিক্ষক সায়েদা আলী সোমা যায়যায়দিনকে বলেন, '২০১১ সাল থেকে এ স্কুলের যাত্রা শুরু হয়। প্রথম ব্যাচে ১৫ জন শিক্ষার্থী ছিল। বর্তমানে ৫০ জন শিক্ষার্থী বয়েছে। সার্বিক ব্যবস্থাপনায় ১ জন প্রধান শিক্ষক, ২ জন অটিজম ইনস্ট্রাক্টর ও ৬ জন অটিজম শিক্ষক, ৮ জন সহকারী শিক্ষক নিয়মিত কাজ করেন। ৬টি গ্রম্নপ করে পাঠদান চলে।'
তিনি বলেন, 'আমাদের এখান থেকে গত বছর ৩ জন শিশু নরমাল স্কুলে ভর্তি হয়েছে। এছাড়া ১৫ বছরের ঊর্ধ্বে ৬ জনকে কারিগরি শিক্ষার জন্য কারিগরি স্কুলে ভর্তি করা হয়েছে। এ স্কুলে অটিজম আক্রান্ত ৪ থেকে ১৮ বছরের শিশু ভর্তি করা হয়। ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় ইপনা সেন্টারের চিকিৎসক, সাইকোলোজিস্ট, থেরাপিস্টদের সমন্বয়ে গঠিত একটি টিমের সুপারিশে।'
ইপনার ট্রেনিং কো-অর্ডিনেটর ডা. মাজহারুল মান্নান যায়যায়দিনকে বলেন, 'আমাদের স্ট্রং টিম আছে। আমাদের সেন্টারে রোগী দেখার সক্ষমতা আছে ৭০ জনের। আমরা রোগী দেখছি ১১০-১৩০ জনের মতো। আমাদের অন স্টপ সার্ভিস চলে। অটিজম রোগী দেখতে অনেক সময় লাগে। একজনের পরামর্শে আমরা কোনো সিদ্ধান্তে যাই না। আমাদের এখান থেকে ৮০-১২০ জন রোগী ফিরে যাচ্ছে। এটা সত্য, তাই বলে আমাদের সেন্টারে সবাই আসবেন না। সরকারি ৩৪টা মেডিকেল হাসপাতালে ৩৪টা শিশু বিকাশ কেন্দ্র রয়েছে। প্রত্যেক সেন্টারে একজন চিকিৎসক, থেরাপিস্ট ও সাইকোলোজিস্ট আছে। সেখানে ভালো চিকিৎসা হয়। তাদের পরামর্শে আমাদের এখানে আসুন। সরকারের পরিকল্পনা আছে আগামীতে আরও ১৫টি শিশু বিকাশ কেন্দ্র তৈরি করা হবে। ২০০৯ সালে ঢাকাতে বেসরকারিভাবে ৯টা স্কুল ছিল। বর্তমানে ১২১টা স্কুল রয়েছে। তার মানে কাজ এগোচ্ছে।'
অটিজমের চিকিৎসা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'আমরা আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে তিনটি ধাপ ফলো করি। মৃদু, মাঝারি ও গুরুতর সমস্যাকে বিবেচনায় করা। চিকিৎসকরা শিশুর মনস্তাত্ত্বিক বিকাশে কাজ করে। স্পিচথেরাপি, সাইকোলোজিক্যাল ম্যানেজমেন্ট থেরাপিসহ বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মাধ্যমে শিশুদের চিকিৎসা দেই। তবে সারাদেশে পর্যাপ্ত চিকিৎসক আছে কিন্তু সাইকোলোজিস্ট, থেরাপিস্ট নাই। আরও অনেক ম্যান পাওয়ার তৈরি করতে হবে।'
ইপনার তথ্য মতে, অটিজমে চিহ্নিত করতে তিনটি ধাপ অনুসরণ করা হয়। এতে প্রথম ধাপে প্রতি দশ হাজারে ২০৬ জন অটিজমে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। এদের রেড ফ্ল্যাগ পজিটিভ কার্ড দেওয়া হয়। দ্বিতীয় ধাপে ২০৬ জনের মধ্যে ১৪৯ জনের মোডিফাইড চেকলিস্ট ফর অটিজম (এম-চার্ট) পজিটিভ শনাক্ত হয়। তৃতীয় ধাপে ১৪৯ জনের মধ্যে ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিক্যাল ম্যানুয়াল (ডিএসএম-৫) পদ্ধতির মাধ্যমে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মাধ্যমে পরীক্ষা করা হয়। এতে ১৭ জন শিশ সম্পূর্ণভাবে অটিজমে আক্রান্ত পাওয়া যায়।
অটিজম কেন হয় এ প্রসঙ্গে ইনস্টিটিউট অব পেডিয়াট্রিক নিউরোডিজঅর্ডার অ্যান্ড অটিজম (ইপনা) সহকারী অধ্যাপক ডা. সানজিদা আহমেদ যায়যায়দিনকে বলেন, 'গর্ভকালীন সময় মায়ের হাইপারটেনশন, ডায়াবেটিস, অ্যাজমা, জ্বর এবং সঙ্গের্ যাশ হলে, শারীরিক ও মানসিক সমস্যা থাকলে শিশু অটিজমের শিকার হতে পারে। বাবা-মায়ের বয়স ৪০ বছরের বেশি হলে। এমনকি পরিবেশগত কারণে শিশু অটিজমের শিকার হতে পারে। এটি কোনো রোগ নয়, জন্মগত স্নায়ুবিক দুর্বলতা। শিশুর জন্মের ২-৩ বছর বয়সের মধ্যে এটির আত্মপ্রকাশ ঘটে।'
তিনি বলেন, 'অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের লক্ষণ ও উপসর্গের মাত্রা বিচিত্র। একজনের সঙ্গে অন্যজনের কোনো মিল নেই। কেউ সবাক, কেউবা বাকশক্তি থাকা সত্ত্বেও কথা বলে না। কারও আচরণ আক্রমণাত্মক আবার কেউ গুটিয়ে থাকা স্বভাবের। তাই অটিজমের সুনির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী তাদের স্পিচথেরাপি, কাউন্সিলিংসহ বিভিন্ন সেবা দেওয়া হচ্ছে। এতে তারা অনেকে সুস্থ হয়ে উঠছে।'
দিবসটি উপলক্ষে মঙ্গলবার সকাল ১০টায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রামাণ্যচিত্র, প্রদর্শনী ও অটিস্টিক শিশুদের পরিবেশনায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।