হাইকোর্টের আদেশ
বুয়েটে ছাত্র রাজনীতির বাধা অবশেষে কাটল
'জরুরি বিজ্ঞপ্তি'র কার্যক্রম স্থগিত আদালতের রায় শিরোধার্য :উপাচার্য
প্রকাশ | ০২ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি রিপোর্ট
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) সব রাজনৈতিক সংগঠন ও এর কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণার 'জরুরি বিজ্ঞপ্তির' কার্যক্রম স্থগিত করেছেন হাইকোর্ট। সোমবার বিচারপতি মো. খসরুজ্জামান ও বিচারপতি কেএম জাহিদ সারওয়ারের হাইকোর্ট বেঞ্চ এক রিট আবেদনের শুনানি নিয়ে এই আদেশ দেন। এর ফলে দেশে প্রকৌশল শিক্ষার শীর্ষ এ বিদ্যাপীঠে ছাত্র রাজনীতি চর্চায় আর কোনো বাধা থাকছে না বলে আইনজীবীরা জানিয়েছেন।
২০১৯ সালের ১১ অক্টোবর বুয়েট কর্তৃপক্ষের দেওয়া 'জরুরি বিজ্ঞপ্তি'র বৈধতা চ্যালেঞ্জ করেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ হোসেন। সোমবার রিটটি করেন। ইমতিয়াজ বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের ছাত্র। তিনি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য।
আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হক, সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী এম হারুনুর রশীদ খান। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সমরেন্দ্র নাথ বিশ্বাস।
হাইকোর্টের আদেশের পর জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হক সাংবাদিকদের বলেন, 'আদালত রুল দিয়ে জরুরি বিজ্ঞপ্তি স্থগিত করে দিয়েছেন। এর ফলে বুয়েটে এখন থেকে ছাত্র রাজনীতি করায় আর কোনো বাধা থাকল না।'
২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদকে শেরেবাংলা হলে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় করা মামলায় আদালত ২০ জনকে মৃতু্যদন্ড দেন। পাঁচজনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড। সাজাপ্রাপ্ত আসামিরা ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। আবরার ফাহাদ হত্যার পর বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়।
গত ২৭ মার্চ মধ্যরাতের পর ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মী বুয়েট ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেন এবং রাজনৈতিক কার্যক্রম চালান, এমনটি উলেস্নখ করে ২৯ মার্চ আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনের অংশ হিসেবে তারা টার্ম ফাইনাল পরীক্ষাসহ সব ধরনের একাডেমিক কার্যক্রম বর্জন করছেন।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ভাষ্য, ২৭ মার্চ মধ্যরাতের পর ক্যাম্পাসে 'বহিরাগতদের' প্রবেশ ও রাজনৈতিক সমাগমের মূল সংগঠক ইমতিয়াজ। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে বুয়েটের হল থেকে ইমতিয়াজের সিট (আসন) বাতিল করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনের মধ্যে বুয়েটে নিয়মতান্ত্রিক ছাত্র রাজনীতি চালুর দাবিতে রোববার দুপুরে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশ করেন ছাত্রলীগ। সমাবেশে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতারা বলেন, বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করার বিষয়টি একটি কালো আইন। এই আইন সংবিধানবিরোধী।
এদিকে, বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের বিরুদ্ধে হাইকোর্টের শুনানি শেষে সাংবাদিকদের উদ্দেশে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বলেন, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) সংবিধান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশ অনুযায়ী নিয়মতান্ত্রিক ছাত্ররাজনীতি প্রতিষ্ঠায় কাজ করবেন। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা, শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব বিকাশ এবং অধিকার আদায়ের জন্য বুয়েট ক্যাম্পাসে নিয়মতান্ত্রিক ছাত্ররাজনীতি প্রতিষ্ঠা করতে শিক্ষার্থীদের আহ্বান জানান তিনি।
আদালতের রায় শিরোধার্য: উপাচার্য
এদিকে, বুয়েটের উপাচার্য প্রফেসর ড. সত্য প্রসাদ মজুমদার বলেছেন, 'আদালতের রায় শিরোধার্য, আদালতের রায়ের ওপরে কিছু নেই। আদালত যদি সিদ্ধান্ত দেয় আমাদের সেটি মেনে নিতে হবে। আবার আমরা অনেক সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি যেটি আদালতে গেলে আর টেকে না। তবে সিন্ডিকেট বৈঠকেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে।'
সোমবার দুপুরে উপাচার্যের কার্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের জারি করা প্রজ্ঞাপন স্থগিত করে হাইকোর্টের দেওয়া নির্দেশনার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, এখনো রায়ের কপি পাননি। পেলে আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়ার কথাও বলেন তিনি।
এর আগে দেশের সবচেয়ে প্রাচীন পেশাজীবী প্রতিষ্ঠান ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশের (আইইবি) প্রেসিডেন্ট ও আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক প্রকৌশলী মো. আবদুস সবুর ও সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী এসএম মঞ্জুরুল হক মঞ্জু আইইবি'র কয়েকজন সদস্য বুয়েটে উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করেন। তারা সবাই বুয়েটের সাবেক শিক্ষার্থী।?
বুয়েট উপাচার্য বলেন, ইঞ্জিনিয়ার ইনস্টিটিউশনের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক এবং কমিটির নেতারা এসেছিলেন। বুয়েটের সাবেক ছাত্ররাও ছিলেন। তারা বুয়েট সম্পর্কে সবসময় ওয়াকিবহাল। তারা তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বুয়েটের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করেন। বিশেষ করে প্রকৌশলীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করেন তাদের কথা হলো বুয়েট থেকে পাস করে যেন শিক্ষার্থীরা দেশের জন্য কাজ করেন, মুক্তিযুদ্ধ চেতনায় উদ্বুদ্ধ থাকেন এবং এখান থেকে পাস করে যেন দেশের বাইরে চলে না যান। উপাচার্য বলেন, উনারা চাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা শুধু পড়ালেখা শিখবে না- মুক্ত চিন্তা করবে, সাহিত্য শিখবে, রাজনীতি শিখবে, দেশের প্রতি যাদের করণীয় কিছু সম্পর্কে তারা জানবে। তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সেভাবেই হবে, দেশে থেকে দেশের জন্য কাজ করে যাওয়া না হলে সে কিন্তু চিন্তা করবে যে আমি দেশকে চিনি না শুধু বুয়েট ক্যাম্পাসকেই চিনি। ওনারা বলতে চাচ্ছেন এ বিষয়ে একটা পরিকল্পনা করা দরকার।?যেখানে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার পাশাপাশি মুক্ত চিন্তার রাজনীতিও করতে পারে।?আমরা এসব বিষয়ে আমাদের শিক্ষক, ছাত্র একাডেমিক কাউন্সিল এবং সিন্ডিকেট সভায় আলোচনা করব।
উপাচার্য বলেন, একটি প্রেক্ষাপটে ২০১৯ সালে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি থাকবে না। এই সিদ্ধান্ত থেকে যদি সরে আসতে হয় তাহলে শিক্ষক-ছাত্র সবাইকে বসে কিন্তু চিন্তা করতে হবে। উনারা বলেছেন এ বিষয়ে উনারা সহায়তা করবেন। তবে কীভাবে করব সে বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
বুয়েট শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ রাব্বির হলের সিট বাতিলের বিষয়ে উপাচার্য বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে রুলস অ্যান্ড রেগুলেশন আছে। অর্থাৎ ২০১৯ সালে যে সিদ্ধান্তটা নেওয়া হয়েছিল সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যদি কেউ সম্পৃক্ত (রাজনৈতিক কর্মকান্ডে) থাকে তাহলে ফর গুড (চিরতরে) বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার হয়ে যাওয়ার কথা।? রাব্বিকে কিন্তু এখনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়নি। তদন্ত হবে সে পুরোপুরি ইনভল্ব কি না। সে কিন্তু বলেছিল যে কমিটিতে তার নাম আছে। তাকে বলা হয়েছিল যে তোমার নাম আছে তুমি নামটা উইড্রো কর, সে কিন্তু পদত্যাগপত্র দিয়েছে সেটি এখনো ফাইনাল হয়নি। এজন্য তাকে হল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু আইন অনুযায়ী সে কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার হতে পারত।? ২০১৯ সালে যে আইন হয়েছে সেটি আমাকে ফলো করতেই হবে। আমি একজনের জন্য ফলো করব আরেকজনের জন্য করব না সেটা তো হয় না। যদি ভবিষ্যতে নতুন কোনো আইন আসে তাহলে সেটা ফলো করা হবে। আমার যদি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হয় তাহলে আমি আইনটা দেখে দেখে নেব। কারণ আমাকে যখন কোর্টে যেতে হবে তখন আমি এই আইনটা দেখাব।?
তৃতীয় দিনের মতো
ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন
এদিকে, ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি পুরোপুরি বন্ধসহ ৬ দফা দাবিতে তৃতীয় দিনের মতো ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন কর্মসূচি পালন করছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থীরা।?
সোমবার বেলা সাড়ে ১১টায় সরেজমিন বুয়েট ক্যাম্পাসে দেখা যায়, পুরো ক্যাম্পাস একেবারেই ফাঁকা। নেই শিক্ষার্থীদের আনাগোনা। দু-একজন শিক্ষার্থীকে দেখা গেলেও তারা ব্যক্তিগত কাজে এসেছেন বলে জানান। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিস খোলা রয়েছে। দাপ্তরিক কাজসমূহ যথারীতি চলছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নিরাপত্তা প্রহরী বলেন, সকাল থেকে ক্লাসে কোনো শিক্ষার্থী আসে নাই। ক্যাম্পাস একেবারেই ফাঁকা গত তিনদিন ধরে এ অবস্থা।