রাজধানীর রামপুরার মহানগর প্রকল্প থেকে ঈদ শপিং করতে রিকশায় গাউছিয়া মার্কেটে এসেছেন প্রকৌশলী নূরুন নাহার। বাসা থেকে ২০ মিনিটে শাহবাগ মোড় পর্যন্ত আসলেও বাকি পথে সময় লেগেছে আধা ঘণ্টারও বেশি। অথচ শাহবাগ মোড় থেকে গাউছিয়া মার্কেটের দূরত্ব মাত্র ১.১ কিলোমিটার। এ পথ হেঁটে গেলেও সর্বোচ্চ ১৫ মিনিট সময় লাগার কথা।
একই ধরনের দুর্দশার কথা জানান মোহাম্মদপুরের বাবর রোড থেকে নিউমার্কেটে আসা রওশন আরা রেখা। তার ভাষ্য, বাসা থেকে আসাদ গেট আসার পর রিকশা যেন আর সামনের দিকে এগোয় না। দুপুরের প্রখর রোদে তীব্র যানজটে পড়ে তার প্রায় নাভিশ্বাস।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১০ রোজা পার হওয়ার পর থেকেই মার্কেটকেন্দ্রিক প্রতিটি সড়কে প্রতিদিন সকাল থেকে মধ্যরাত অবধি যানজট লেগেই থাকে। বিশেষ করে যেসব মার্কেট, শপিং মল ও বিপণি বিতানের নিজস্ব পার্কিং ব্যবস্থা নেই, ওইসব ব্যবসাকেন্দ্র ঘিরে যানজট ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। বিপুল সংখ্যক মার্কেটের আশপাশের রাস্তা ও ফুটপাত দখল করে ভ্রাম্যমাণ হকাররা নানা ধরনের পণ্য সাজিয়ে বসায় এসব সড়কে তীব্র যানজটে গণপরিবহণসহ বিভিন্ন যানবাহনের যাত্রীদের জীবন প্রায় ওষ্ঠাগত।
নগর পরিবহণের একাধিক চালক জানান, মার্কেটকেন্দ্রিক সড়কগুলোতে যানজট পরিস্থিতি এতটাই প্রকট হয়ে উঠেছে যে, বেশিরভাগ গণপরিবহণ এসব রুট এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন। তবে ভিন্ন রাস্তায় গাড়ি চালালে যাত্রী কমে যাওয়ার শঙ্কা এবং ট্রাফিক পুলিশের হয়রানির ভয়ে নির্দিষ্ট রুটেই তাদের বাস চালাতে হয়। এতে মার্কেটের আগে-পরে দেড় দুই কিলোমিটার রাস্তা পার হতে আধাঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা বেশি সময় লাগছে। অনেক রুটেই নগর সার্ভিসের বাসের ট্রিপ কমে গেছে।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার সিএনজি অটোরিকশা, রিকশা ও টেম্পো চালকদের সঙ্গে কথা বলেও একই ধরনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাদের ভাষ্য, মৌচাক, মালিবাগ, এলিফ্যান্ট রোড, মিরপুর সড়ক, ধানমন্ডি, মিরপুর, পলস্নবী, গুলশান ও বনানীসহ নগরীর যেসব এলাকাতেই মার্কেট রয়েছে, সেখানেই দিন-রাতে প্রায় সারাক্ষণই যানজট লেগেই থাকে। মার্কেট সংলগ্ন রাস্তা অতিক্রম করে যে কোনো গন্তব্যে পৌঁছাতে তাদের দীর্ঘ সময় অপচয় হচ্ছে। যাত্রীদের কাছ থেকে ন্যায্য ভাড়া নিলে দিন শেষে তাদের উপার্জন অর্ধেকে এসে ঠেকছে। আবার বেশি ভাড়া চাইলে যাত্রীরা ক্ষিপ্ত হয়ে চড়াও হওয়ার চেষ্টা করেন। তাই রিকশা, অটোরিকশা চালকরা অনেকে এখন মার্কেট, শপিং মল ও বিপণি বিতানমুখী সড়কের যাত্রী তোলা বন্ধ করে দিয়েছেন।
বুধবার দুপুর ১২টার দিকে সেগুনবাগিচা এলাকায় এক যুবক নিউমার্কেটে যাওয়ার জন্য রিকশাচালকের কাছে ভাড়া জানতে চাইলে তিনি দেড়শ' টাকা হাঁকেন। তার ভাষ্য, একবার নিউমার্কেটের রাস্তায় ঢুকে গেলে দুই ঘণ্টার আগে বের হওয়া যায় না। তাই এর চেয়ে কম ভাড়া নিলে পোষায় না।
এদিকে এ আক্ষেপ শুধু রিকশা কিংবা গাড়ি চালকদেরই নয়, যাত্রীরাও এ নিয়ে চরম বিরক্ত। এ নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, রমজান মাসে কোনো ব্যবসায়ীকে সড়কে ব্যবসা কার্যক্রম পরিচালনা করতে দেওয়া হবে না বলে ক'দিন আগে হুঙ্কার দিয়েছিলেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার মো. মুনিবুর রহমান। এ জন্য কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছেন বলেও জানিয়েছিলেন তিনি। অথচ গোটা নগরীর অধিকাংশ সড়কে সবজি থেকে শুরু করে শার্ট-প্যান্ট, জুতা-কসমেটিক সব ধরনের পণ্যের শত শত দোকান বসেছে। রোজা শুরুর আগে থেকেই অধিকাংশ ফুটপাত হকারদের দখলে। মার্কেট-শপিং মল, বিপণি বিতানের চেয়ে বেশি দোকান বসে তার আশপাশের সড়কে। পার্কিং না থাকায় বেশিরভাগ মার্কেটে আসা ক্রেতাদের ব্যক্তিগত গাড়ি, মোটর সাইকেল ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার্ক করে রাখা হচ্ছে মার্কেট সংলগ্ন রাস্তার অর্ধেকাংশজুড়ে। এতে রাস্তা সংকীর্ণ হয়ে তীব্র যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। অথচ পুলিশ দু'এক জায়গায় লোকদেখানো অভিযান চালালেও বাকি সবখানেই এ অপতৎপরতা চলছে। এতে মার্কেটকেন্দ্রিক প্রতিটি সড়ক স্থবির হয়ে পড়েছে। প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার কারণেই যানজটে নগরজীবন বিষিয়ে উঠেছে বলে অভিযোগ করেন ঢাবির ওই শিক্ষার্থী।
বুধবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে নিউমার্কেট এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, ধানমন্ডির কলাবাগান থেকে নিউমার্কেট হয়ে কাঁটাবন মোড়, অপরদিকে এলিফ্যান্ট রোড থেকে শাহবাগ মোড় হয়ে মৎস্য ভবন পর্যন্ত যানজট লেগে আছে। এসব সড়কে বাসযাত্রীরা তীব্র গরমে ঘেমে নেয়ে উঠছে। অনেকে রাগে ক্ষোভে বাস থেকে নেমে হেঁটে গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা দিচ্ছেন। এসব সড়কে যানজট নিয়ন্ত্রণে ট্রাফিক পুলিশ প্রাণন্ত চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে এরপরও যান্ত্রিক গাড়িগুলো চলছে শম্বুক গতিতে।
ধানমন্ডি হকার্স মার্কেটের দোকানি সফিকুল ইসলাম বলেন, ইফতারির সময় এবং এরপর ঘণ্টাখানেক জ্যাম একটু কম থাকে। বাকি সময় গোটা সড়ক স্থবির থাকে। ওই দোকানির অভিযোগ, তীব্র যানজটের কারণে ধানমন্ডি হকার্স, গাউছিয়া, নিউমার্কেট, চাঁদনি চক, ইস্টার্ন মলিস্নকা, মাল্টিপস্ন্যান সেন্টার ও এলিফ্যান্ট রোডের মার্কেটগুলোতে ক্রেতারা এখন আসতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। তাই এবারের ঈদের তাদের বেচাকেনা বেশখানিকটা কমেছে।
গাউছিয়া মার্কেটের ব্যবসায়ী সাদেক হোসেনের অভিযোগ, ফুটপাত ও রাস্তা দখল করে শত শত দোকান গড়ে ওঠায় সড়কে শুধু যানজটই বাড়েনি, তাদের ব্যবসাতেও ধস নেমেছে। কারণ অনেকে সেখান থেকেই ঈদপণ্য কিনে ঘরে ফিরছেন। লাখ লাখ টাকা দিয়ে দোকানের পজিশন কিনে, মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করে ডেকোরেশনের পর কোটি টাকার পুঁজি বিনিয়োগ করেছেন। অথচ তারা দিন শেষে দোকানের খরচ তুলতে পারছেন না। কিন্তু ফুটপাত ও রাস্তার ভ্রাম্যমাণ দোকানিরা পুলিশ ও রাজনৈতিক নেতাদের দু'পাঁচশ' টাকা দিয়ে ঠিকই চুটিয়ে ব্যবসা করে যাচ্ছেন।
ঢাকা মহানগর ট্রাফিক বিভাগ সূত্র জানায়, রাজধানীর ৬০ ভাগ বাণিজ্যিক ভবনে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা নেই। এর মধ্যে মার্কেট, শপিং মল ও বিপণি বিতানগুলোর অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। এগুলোর ৮০ ভাগেরই পার্কিং লট দোকান কিংবা গোডাউন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে এসব মার্কেটে কেনাকাটা করতে আসা ক্রেতারা তাদের নিজস্ব ব্যবহৃত গাড়ি আশপাশের রাস্তায় পার্ক করে রাখছে। কোথাও কোথাও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা এসব পার্কিং লট থেকে চাঁদা আদায় করছেন। মার্কেটের সামনের কোনো কোনো রাস্তা আবার খোদ সিটি করপোরেশনই ইজারা দিয়েছে। এতে স্বাভাবিকভাবেই প্রতি বছর ঈদের আগে মার্কেটের আশপাশের রাস্তায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে।
অথচ রাজউকের ইমারত নির্মাণ আইন ও বিধিমালা অনুসারে ছয়তলার ওপরে নির্মিত সব ভবনে নকশা অনুযায়ী নির্দিষ্ট পরিমাণ জায়গায় গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা রাখা বাধ্যতামূলক।
নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, বহুতল মার্কেটগুলোতে পার্কিং না থাকায় সামনের রাস্তায় গাড়ি রাখার কারণে রাজধানীর বেশ কিছু এলাকায় যানজট এখন 'স্থায়ী' রূপ নিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে ট্রাফিক পুলিশ যতই তৎপর হোক না কেন, মার্কেটমুখী সড়কের যানজট নিয়ন্ত্রণ করা অনেকটাই অসম্ভব।
সরেজমিন গুলিস্তান এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সেখানে যতগুলো বহুতল বিপণিকেন্দ্র গড়ে উঠেছে, সেগুলোর কয়েকটিতে পার্কিংয়ের ব্যবস্থা রাখা হলেও ব্যবহার হচ্ছে দোকানঘর হিসেবে। দেশের সর্ববৃহৎ পাইকারি জুতার মার্কেট সুন্দরবন স্কয়ারের বেজমেন্টে দোকানঘর, গুদাম ও পাহারাদারদের থাকার জায়গা করা হয়েছে। গুলিস্তান-ফুলবাড়িয়ার সিটি পস্নাজা, নগর পস্নাজা ও জাকের মার্কেটও যেন একসূত্রে গাঁথা। এসব বহুতল মার্কেটের পার্কিং-বেইজমেন্টে অবৈধভাবে শত শত দোকান বসানো হয়েছে। ফলে এর আশপাশের সড়কে ক্রেতা-বিক্রেতাদের গাড়ি পার্ক করে রাখায় ঈদ মৌসুমে যানজট বেড়েছে।
এদিকে নয়া পল্টনের পলওয়েল ও গাজী সুপার মার্কেটে পার্কিং লটের কোনো অস্তিত্ব নেই। এ দু'টি মার্কেটের ক্রেতারা তাদের নিজস্ব গাড়ি, মোটর সাইকেল সামনের রাস্তায় পার্ক করে রাখছেন। এর বিপরীতে গড়ে ওঠা দু'টি বিশাল মার্কেটেরও একই অবস্থা। ওই মার্কেটের সামনের রাস্তা ও ফুটপাত দখল করেও কয়েকশ' দোকান বসেছে। ফলে দীর্ঘ প্রশস্ত এ রাস্তাও এখন সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে। ঈদের বেচাকেনা জমে ওঠার পর থেকেই এ সড়কে নিত্য যানজট লেগেই থাকছে।