মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

ঈদযাত্রায় দায়সারা প্রস্তুতি

সাখাওয়াত হোসেন
  ২৮ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
ঈদযাত্রায় দায়সারা প্রস্তুতি

দেশে প্রতি বছর ঈদের আগে-পরে বিপুল সংখ্যক সড়ক দুর্ঘটনায় দীর্ঘ হচ্ছে মৃতু্যর মিছিল। শত শত পরিবারের ঈদ আনন্দ মুছে যাচ্ছে চিরতরে। অথচ তারপরও বাড়ছে না জনসচেতনতা; ফিরছে না শৃঙ্খলা সড়ক-মহাসড়কে। দক্ষ চালক, ত্রম্নটিহীন যানবাহন, নিয়ন্ত্রিত গতি, ট্রিপের সংখ্যা হ্রাস ও চালকদের বিশ্রামের সুযোগ দেওয়াসহ দুর্ঘটনা রোধের কোনো ইসু্যই মানতে চাইছে না কেউই। ঈদ পরবর্তীতে প্রতি বছরই নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত সংগঠনগুলো প্রাণঘাতী সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে নানা পর্যবেক্ষণ-পর্যালোচনা শেষে একগুচ্ছ সুপারিশ করলেও বছরের পর বছর তা ফাইল বন্দিই হয়ে আছে।

সড়ক পরিবহণ খাতের বিশেষজ্ঞরা জানান, সারাদেশে বছরে সড়ক দুঘর্টনায় যে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে তার প্রায় ১৫ শতাংশ হয় দুই ঈদের আগে পরে ১৩ থেকে ১৫ দিনে। এর প্রধান কারণ এই সময়ে প্রায় সাড়ে ৪ কোটি যাত্রী চলাচল করায় সড়কের গতি ও যানবাহনে বিশৃঙ্খলা বেড়ে যায়। গণপরিবহণের তুলনায় দক্ষ চালকের সংখ্যা কম হওয়ায় এ সময় গাড়ি মালিকরা বিপুল সংখ্যক ড্রাইভিং লাইসেন্সবিহীন অদক্ষ মানুষের হাতে 'স্টিয়ারিং' তুলে দেয়। অতিরিক্ত মুনাফার লোভে লোকাল ট্রিপের লক্কড়-ঝক্কড় যানবাহন মেরামত করে নামানো হয় সড়ক-মহাসড়কে। ফলে ঈদের আগে-পরে দুর্ঘটনার লাগাম টানা দুষ্কর হয়ে পড়ে।

সংশ্লিষ্টদের দাবি, এসব বিষয়ে সবাই অবগত থাকলেও প্রতি বছরই ঈদের আগে দায়সাড়া প্রস্তুতি নেয় প্রশাসন। যার এবারও কোনো ব্যতিক্রম হয়নি। ঈদের আগে-পরে সড়কে দুর্ঘটনা এড়াতে অতি সম্প্রতি থ্রি-হুইলার ও মোটর সাইকেল চলাচলে নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছে সড়ক পরিবহণ ও সেতু মন্ত্রী। ঈদুল ফিতর উপলক্ষে যাত্রী সাধারণের যাতায়াত নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন করতে অংশীজনদের নিয়ে আয়োজিত এক সভায় তিনি এই নির্দেশনা দেন। দুর্ঘটনা নিয়ে দুর্ভাবনার কথা উলেস্নখ করে তিনি বলেন, থ্রি হুইলার ও মোটর সাইকেলের বেপরোয়া ড্রাইভিং সবকিছু মিলিয়ে এই এক্সিডেন্ট হচ্ছে। এজন্য নিরাপদ সড়ক প্রকল্প দ্রম্নত বাস্তবায়ন করা জরুরি। ২২টি সড়ক মহাসড়কে তিন চাকার গাড়ি চলাচল নিষিদ্ধ করা হলেও তা কার্যকর করা যায়নি। হাইওয়ে পুলিশ ও বিআরটিএ'র সক্ষমতা না বাড়ালে যত সিদ্ধান্ত নেওয়া হোক না কেন- তা বাস্তবায়ন করা কঠিন বলেও স্বীকার করেন তিনি। এছাড়া লক্কড়-ঝক্কড় গাড়ি চলাচল বন্ধে প্রশাসনের অসহায়ত্বের বিষয়টিও মন্ত্রীর বক্তব্যে উঠে আসে।

এদিকে ঈদযাত্রা নিরাপদ করতে হাইওয়ে পুলিশ নানা প্রস্তুতি নিচ্ছে দাবি করলেও বাস্তবতা অনেকটাই ভিন্ন।

যা খোদ হাইওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি মো. শাহাবুদ্দিন খানের বক্তব্যে উঠে এসেছে। গত ১৯ মার্চ বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ মালিক সমিতির সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় তিনি বলেন, 'থ্রি-হুইলার মহাসড়কের একটা বড় সমস্যা। যানজট ও দুর্ঘটনার বড় কারণ। উচ্চ আদালত কর্তৃক এসব নছিমন, করিমন, ভটভটি মহাসড়কে চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অনেক ধরনের চেষ্টা সত্ত্বেও আমরা মহাসড়ক থেকে এসব প্রত্যাশিত মাত্রায় কমাতে পারিনি। এর মধ্যে যদি এসব ঈদযাত্রায় মহাসড়কে নামে তবে তা হবে ঝুঁকির কারণ।'

এ জন্য প্রত্যেক জেলার পুলিশ সুপার ও পরিবহণ মালিক শ্রমিকদের দায়িত্ব নেওয়ার কথা জানালেও ঈদযাত্রায় মহাসড়কে থ্রি-হুইলার বন্ধে আগাম কোনো তৎপরতা এখনও চোখে পড়েনি। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কারো সুস্পষ্ট কোনো বক্তব্যও পাওয়া যায়নি।

অথচ এ বাস্তবতাতে আর মাত্র সপ্তাহ দেড়েক পরই সারাদেশে ঈদযাত্রা শুরু হচ্ছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে থ্রি-হুইলার ও মোটর সাইকেল চলাচলে নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হলেও কারা কীভাবে এ দায়িত্ব পালন করবে তা অস্পষ্টই রয়ে গেছে। হাইওয়ে পুলিশ ও বিআরটিএর একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে জানতে চেয়েও এ ব্যাপারে তাদের সুস্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বিআরটিএ কর্মকর্তা বলেন, মন্ত্রীর নির্দেশনার বিষয়টি তিনি শুনেছেন। কিন্তু এখনো কোনো লিখিত কিছু পাননি। অনেকটা একই জবাব, হাইওয়ে পুলিশেরও।

সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রধানত ছয়টি কারণে ঈদের সময় সড়ক দুর্ঘটনা বেড়ে যায়। এগুলো হচ্ছে, যাত্রী চাপ কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ায় ট্রিপ বৃদ্ধি, অতিরিক্ত ট্রিপ দিতে গিয়ে বেপরোয়া গতিতে যানবাহন চালনা, সড়ক-মহাসড়কে অবৈধ চালক, টানা দীর্ঘ সময় গাড়ি চালানোর কারণে চালকের শারীরিক ও মানসিক ক্লান্তি-অবসাদ এবং যানবাহন বৃদ্ধি, সড়কে ত্রম্নটি ও অসচেতন যাত্রীদের তাড়াহুড়ো।

সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ, এই ছয় বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়ার পাশাপাশি ঈদযাত্রায় যাত্রীসহ সব পক্ষকে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। হাইওয়ে পুলিশকে অনেক বেশি কার্যকর ও তৎপর হতে হবে। এসব করা গেলে ঈদের আগে পরে সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা যাবে।

সড়ক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এবার সড়ক পরিস্থিতি যথেষ্ট ভালো। বেশ কিছু সড়ক মহাসড়ক দুই লেন ও চার লেন হয়েছে। ফলে সড়কে ডিভাইডার হয়েছে। এতে যানবাহনের মুখোমুখি সংঘর্ষ কমেছে। ফলে মুখোমুখি সংঘর্ষ কমবে, এতে প্রাণহানির ঘটনা কমার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া ওভারপাস, আন্ডারপাস হয়েছে নতুন, ফুটপাতও বেড়েছে। এ পরিস্থিতিতে সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণগুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় রেখে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের মনিটরিং বাড়ানো গেলে ঈদযাত্রা নিরাপদ রাখা সম্ভব হবে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা সেন্টার- এআরআই'র সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ঈদের সময় বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার হার এবং মৃতু্য দুই থেকে চারগুণ বেড়ে যায়। আর এটা কোনোভাবেই কমানো যাচ্ছে না। কারণ এসময় অবৈধ যানবাহন এবং অদক্ষ ও বেআইনি চালক বেড়ে যায়। চাহিদা বাড়ায় ট্রিপের সংখ্যা বাড়ে। যার সুযোগ নেয় বাস মালিক-শ্রমিকরা।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী জানান, দুর্ঘটনার দিকে খেয়াল করলে দেখা যাবে চলাচল অনুপযোগী এবং মহাসড়কে চলাচল নিষিদ্ধ থ্রি হুইলার, হিউম্যান হলারে দুর্ঘটনা বেশি ঘটে। ঈদের সময় এগুলো মহাসড়কে নেমে পড়ে। এছাড়া যাত্রীদের অসতর্কতা ও সড়ক মহাড়কের ত্রম্নটিও এই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী বলে মনে করেন তিনি।

এদিকে বাংলাদেশের সড়ক পরিবহণ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বছরের পর বছর এই খাতে বেশ কয়েকটি সমস্যা বিরাজমান থাকায় একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে। আইন হলেও তার শক্ত প্রয়োগ না থাকায় বাস্তব পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। তাই ঈদের আগে পরে যাত্রীর চাপে গাড়ি চলাচল বৃদ্ধির সঙ্গে পালস্না দিয়ে দুর্ঘটনাও বাড়ে।

বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের গবেষণাতেও দেখা গেছে, মহাসড়কে যেসব দুর্ঘটনা ঘটে, তার বড় একটি কারণ বেপরোয়াভাবে বা অতিরিক্ত গতিতে চালানোর প্রতিযোগিতা। বিপজ্জনকভাবে ওভারটেকিং, চলন্ত অবস্থায় মুঠোফোন ব্যবহার, মাদক সেবন, চালকের বেপরোয়া মনোভাব- ইত্যাদিকেও দায়ী করা হয়েছে এসব দুর্ঘটনার জন্য।

বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের সাবেক পরিচালক মাহবুবুল আলম তালুকদার বলেন, বাস একটা গণপরিবহণ হলেও এটা হয়ে গেছে প্রাইভেট পরিবহণ। এটা উচিত ছিল সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা, নজরদারিতে থাকা। কিন্তু এটা ব্যক্তি মালিকানায় থাকায় সবাই তাদের স্বার্থের বিষয়টি চিন্তা করে। এ কারণে মালিকরাও চেষ্টা করে, কত কম খরচ করে, পরিবহণ শ্রমিকদের বেশি খাটিয়ে বেশি লাভ করা যায়। ফলে তারা বাসের মেইনটেন্যান্সের দিকে নজর দেয় না, শ্রমিকদের সুবিধা দেখে না। বেশি লাভ করার প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে মহাসড়কে দুর্ঘটনা ঘটে। যা ঈদের আগে-পরে যা ভয়াবহ রূপ নেয়।

এই বিশেষজ্ঞের ভাষ্য, সড়ক পরিবহণ খাত জুড়ে নানারকম চক্র তৈরি হয়েছে। ফলে এখানে একটা চরম বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে। যে যার মতো করে বাস চালাচ্ছে, সেটার কোনো তদারকি নেই, নিয়ম শৃঙ্খলা নেই, কারও কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এ পরিস্থিতির লাগাম টেনে ধরা না গেলে দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব।

হাইওয়ে পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, ঈদের সময় সড়ক-মহাসড়কে ভয়াবহ যেসব দুর্ঘটনা ঘটে, ওইসব পরিবহণের বেশিরভাগ চালক টানা দুই-তিন দিন না ঘুমিয়ে একের পর এক বাসের ট্রিপ দিয়েছেন। দুর্ঘটনার সময় চালক হয়তো মনের অজান্তের তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন। যে কারণে আকস্মিক দ্রম্নত গতির গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। এছাড়া দুর্ঘটনায় পড়া বেশিরভাগ গাড়ি ফিটনেসবিহীন। ড্রাইভিং লাইসেন্সবিহীন অদক্ষ চালকের হাতেই অধিকাংশ দুর্ঘটনা ঘটে।

ঢাকা-খুলনা রুটের একজন বাস চালক এ প্রতিবেদককে জানান, তাদের ফিক্সড কোনো বেতন নেই। তারা ট্রিপ হিসাবে টাকা পান। প্রতিদিন যতগুলো ট্রিপ দিতে পারবে, সে হিসাবে তাদের ইনকাম হবে। তাই অনেকেই চেষ্টা করে একটু বেশি ট্রিপ দিয়ে বেশি ইনকাম করতে। আর বেশি ট্রিপ দিতে তারা গাড়িও বেশি জোরে চালায়। আর এতেই ঘটে দুর্ঘটনা।

ওই বাসচালকের ভাষ্য, সাধারণ সময় তারা খুব বেশি অতিরিক্ত ট্রিপ দেওয়ার সুযোগ পান না। তাই তারা ঈদসহ নানা উৎসবের অপেক্ষায় থাকেন। উৎসবে যাত্রীর চাপ বাড়লে তারা টানা তিন-চারদিন, এমনকি অনেক সময় সপ্তাহব্যাপী গাড়ি চালিয়ে বাড়তি উপার্জন করেন।

যদিও সোহাগ, গ্রীন লাইন ও এস আলমসহ বেশ কয়েকটি পরিবহণের ব্যবস্থাপক এ অভিযোগ অস্বীকার করেন। তাদের দাবি, তাদের কোনো চালককেই টানা ৮/১০ ঘণ্টার বেশি গাড়ি চালাতে দেন না। তাদের প্রতিটি গাড়ির জন্য পরিবর্তিত চালক নির্ধারণ করা থাকে। একজন চালক দূরপালস্নার ট্রিপ নিয়ে কাউন্টারে পৌঁছানোর পর পর তাকে বিশ্রামে পাঠানো হয়।

তবে এ ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। জানা গেছে, অনেক পরিবহণেই চালকদের টানা গাড়ি চালানোর সুযোগ দেওয়া হয় না। কিন্তু চালকরা বিশ্রামে না গিয়ে ফাঁকে এক-দু'দিন অন্য পরিবহণের গাড়ি চালান। ড্রাইভিং লাইসেন্সধারী দক্ষ চালকের সংকট থাকায় তারা এ সুযোগ সহজেই পেয়ে যান। ফলে তাদের পক্ষে টানা কয়েকদিন সতর্কতার সঙ্গে গাড়ি চালানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। আর এ কারণেই অনেক সময় দক্ষ চালকের হাতেও ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে