চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি ছয় শতাংশের মধ্যে রাখার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছিল সরকার। সেখানে জানুয়ারিতে গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১০ ছুঁইছুঁই। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি তথা মূলস্ফীতির কারণে জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। মানুষ সঞ্চয় করার ফুরসত পাচ্ছে না। উল্টো ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়ছে। শহর-গ্রাম সব খানেই একই চিত্র।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, মাথাপিছু সঞ্চয় বেড়েছে ৩.২৯ শতাংশ। আর ঋণ বেড়েছে ৫.৬৮ শতাংশ। অর্থাৎ মানুষের মধ্যে সঞ্চয় থেকে ঋণ নেওয়ার প্রবণতা বেশি। ডিসেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত মাথাপিছু আমানত বেড়েছে মাত্র এক হাজার টাকা। আর মাথাপিছু ঋণ বেড়েছে চার হাজার টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান মতে, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে সার্বিক আমানতের পরিমাণ ১৭ লাখ ৪৯ হাজার ১৩২ কোটি টাকা। মাথাপিছু আমানতের পরিমাণ এক লাখ ৬ হাজার টাকা। আর ৩০ জুন ২০২৩ পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে আমানত ছিল ১৬ লাখ ৮৭ হাজার ২৪ কোটি টাকা, মাথাপিছু ১ লাখ ২ হাজার।
অন্যদিকে ডিসেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত মাথাপিছু ঋণ ১৫ লাখ ৩৮ হাজার ৩৪২ কোটি টাকা। মাথাপিছু ঋণ ৯৩ হাজার টাকা। আর জুন ২০২৩ পর্যন্ত ১৪ লাখ ৪৬ হাজার ৭২ কোটি টাকা ঋণ ছিল। অর্থাৎ মাথাপিছু ঋণ ৮৮ হাজার টাকা।
আয় না বেড়ে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ায় সঞ্চয়ের ওপর এ প্রভাব পড়েছে। সবকিছুর দাম বেড়েছে। মানুষের জীবিকা নির্বাহে অতিরিক্ত খরচ করতে হচ্ছে। কিন্তু সে তুলনায় আয় বাড়ছে না। বিশেষ করে নির্দিষ্ট আয়ে যাদের সংসার চলে তাদের অনেকে এখনো সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন। ফলে তৈরি হচ্ছে খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকি।
এদিকে সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগও উলেস্নখযোগ্য হারে কমেছে। কারণ সঞ্চয়পত্র মেয়াদপূর্তির পর যে হারে ভাঙানো হচ্ছে সেই হারে
\হনতুন বিনিয়োগ বাড়ছে না। গত ছয় মাসে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ না বেড়ে কমেছে অর্থাৎ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। একটা সময় কোনো স্কিমের মেয়াদ শেষ হলে বেশিরভাগ গ্রাহক আবার সেখানেই বিনিয়োগ করতেন।
কিন্তু এখন যাদের সঞ্চয়পত্রের মেয়াদ শেষ হচ্ছে তারা আর নতুন করে এখানে বিনিয়োগ করছেন না। ফলে ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। এখন বিক্রির চেয়ে সঞ্চয়পত্রের সুদাসল পরিশোধ বেশি করা হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুসারে, চলতি বছরের প্রথম মাসে জাতীয় সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি কমেছে ১ হাজার ২৮৭ কোটি টাকা। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ৭ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকার সঞ্চপত্র বিক্রি হয়েছে। আর আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল বাবদ পরিশোধ করতে হয়েছে ৯ হাজার ২৫১ কোটি টাকা। এতে জানুয়ারিতে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক ১ হাজার ২৮৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ সঞ্চয়পত্রে নতুন করে বিনিয়োগ করছেন না গ্রাহক।
ব্যাংকাররা বলছেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে দেশের মানুষ এখন অনেকটাই সঞ্চয়বিমুখ বরং আগের জমানো ডিপোজিট ভেঙে সংসারের খরচ মেটাচ্ছেন তারা।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল ৪৯ হাজার ২৫৭ কোটি টাকার। একই সময়ে এ খাতে সরকারকে সুদ-আসল বাবদ পরিশোধ করতে হয়েছে ৫৬ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা।
অর্থাৎ ৭ মাসে সরকার এই খাত থেকে কোনো ঋণ পায়নি। উল্টো অতিরিক্ত পরিশোধ করতে হয়েছে ৭ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা।
এদিকে সরকারি হিসাব অনুযায়ী, দেশে মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান মনে করছে এ হার ১০ শতাংশের বেশি। মূল্যস্ফীতির সরাসরি প্রভাব পড়েছে সাধারণ মানুষের জীবনে, সৃষ্টি হয়েছে সংকট।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি সূত্র বলছে, মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি ও ব্যাংক খাতের নেতিবাচক খবরের কারণে মানুষের হাতে নগদ অর্থ বেড়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির ফলে মানুষের জিনিসপত্র কিনতে আগের চেয়ে বেশি টাকা লাগছে। তাই মানুষ টাকা হাতে রাখছে, যাতে প্রয়োজনে সহজেই খরচ করা যায়। বাড়তি ঝামেলায় পড়তে না হয়। ব্যাংকের বাইরে নগদ অর্থ বৃদ্ধি অর্থনীতির জন্য ক্ষতি।
তথ্য মতে, গত বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বর মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও ফের বেড়েছে চলতি বছরের জানুয়ারিতে। বিবিএসের হালনাগাদ ভোক্তা মূল্যসূচক (সিপিআই) প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত মাসে দেশে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ। গত মাসে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার জন্য প্রধানত খাদ্য-বহির্ভূত পণ্যকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। নভেম্বরেও দেশে খাদ্য-বহির্ভূত মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৮ দশমিক ৫২ শতাংশ। এবার তা বেড়ে ৯ দশমিক ৪২ শতাংশে উঠেছে। এর আগে গত ডিসেম্বরে দেশে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৪১ শতাংশ। তবে এবার তা কিছুটা বেড়েছে। যদিও গত মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার সামান্য কমে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৫৬ শতাংশে।
বিবিএসের তথ্যে দেখা যায়, এবার গ্রামের চেয়ে শহর এলাকায় মূল্যস্ফীতি বেশি হয়েছে। জানুয়ারিতে শহর এলাকায় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ। ডিসেম্বরে এ হার ছিল ৯ দশমিক ১৫ শতাংশ। শহরে গত মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৯৮ শতাংশ। আর খাদ্য-বহির্ভূত পণ্যে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৪৩ শতাংশ। গত মাসে গ্রামাঞ্চলেও মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে।
বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী, গত মাসে দেশের গ্রামীণ এলাকায় মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৭০ শতাংশে। এর আগে ডিসেম্বরে এ হার ছিল ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশ। জানুয়ারিতে গ্রামে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমে ৯ দশমিক ৪১ শতাংশে নেমেছে। ডিসেম্বরে এর হার ছিল ৯ দশমিক ৬৬ শতাংশ। এ সময় গ্রামীণ এলাকায় মূলত খাদ্য-বহির্ভূত পণ্যের দামই বেড়েছে তুলনামূলক বেশি। তথ্য অনুযায়ী গ্রামাঞ্চলে গত মাসে খাদ্য-বহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ১৯ শতাংশ যা ছিল ডিসেম্বরে ৮ দশমিক ৪১ শতাংশ।
খোদ সরকারের পরিসংখ্যান বলছে, মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে। বিবিএসের পরিসংখ্যান বলছে, যারা গৃহস্থালির কাজ করেন কিংবা কর্মের সন্ধানে আছেন, খাদ্যনিরাপত্তায় তাদের চেয়েও পিছিয়ে আছেন কর্মজীবীরা। গৃহস্থালির কাজে যুক্ত ২১ দশমিক ৬৭ শতাংশ মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। কর্মের সন্ধানে থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে এ হার ১৮ দশমিক ৫১ শতাংশ। তবে যারা কোনো কাজ করেন না তাদের মধ্যে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার হার সবচেয়ে বেশি; ২২ দশমিক ৩৮ শতাংশ।
বিবিএসের অন্য এক পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে, দেশের ২১ দশমিক ৯২ শতাংশ মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভোগছে। এদের মধ্যে গ্রামে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার হার ২৩ দশমিক ৮৯ শতাংশ। শহরে এ হার ২০ দশমিক ৫৬ শতাংশ। সবচেয়ে কম সিটি করপোরেশন এলাকায়, ১৩ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়েছে ১৮ শতাংশ মানুষ। আর ২২ শতাংশ মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। তার মানে, যারা দারিদ্র্যসীমার ওপরে আছে তারাও উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে পড়েছে।
বিবিএসের প্রতিবেদনের তথ্য মতে, শ্রেণিভিত্তিক বিভাজনে অতিদরিদ্রদের মধ্যে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার হার ৭০ দশমিক ৩৭ শতাংশ। দরিদ্রদের মধ্যে ২২ দশমিক ৯ শতাংশ। মধ্যবিত্তদের মধ্যে এ হার ১৪ দশমিক ৮৮ শতাংশ। ধনীদের মধ্যে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে ১ দশমিক ১১ শতাংশ।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যাংক ঋণে সুদের হার বাড়ানো হয়েছে। এতে ব্যাংক আমানতেও সুদের হার বেড়েছে। এজন্যই অন্যান্য খাত থেকে টাকা ব্যাংকে ঢুকতে শুরু করেছে। এখন সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ কমে যাওয়াসহ অন্যান্য খাতে বিনিয়োগ আগের চেয়ে কমে যাবে।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, সুদের হার হ্রাস ও নানা ধরনের কড়াকড়ি আরোপের কারণে সাধারণ মানুষের সবচেয়ে নিরাপদ বিনিয়োগ সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে গেছে। সে কারণেই নিট বিক্রি নেগেটিভ হয়েছে। এছাড়া সরকারকে কোষাগার থেকে সুদ-আসল পরিশোধ করতে হচ্ছে।