অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা
নজরদারিতে মোবাইল ফোন কোম্পানির সাত কর্মকর্তা
প্রকাশ | ২৮ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
গাফফার খান চৌধুরী
অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগে গোয়েন্দা নজরদারিতে রয়েছেন মোবাইল ফোন কোম্পানির সাত কর্মকর্তা। তাদের বিষয়ে তদন্ত চলছে। এসব অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশেই অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা চলছিল। এসব কর্মকর্তাদের যোগসাজশে দেশের আর কোথাও এ ধরনের অবৈধ ব্যবসা চলছে কিনা সে বিষয়ে তদন্ত চলছে।
ন্যাশনাল টেলিকম মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) ওর্ যাব সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন সময় দেশে অবৈধ ভিওআইপি (ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রটোকল) ব্যবসা হয়েছে। দীর্ঘ সময় এ ব্যবসার তেমন কোনো তৎপরতা ছিল না। গত ২৩ মার্চ গাজীপুর জেলার টঙ্গী থানাধীন মুধমিতা সড়কের বহুতল অগ্রণী টাওয়ারে চালানো অভিযানের পর অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসার বিশাল নেটওয়ার্ক সম্পর্কে তথ্য বেরিয়ে আসে। ২০১৮ সালে বিভিন্ন মোবাইল ফোন কোম্পানির ৪২ হাজার সিমকার্ডসহ বিপুল পরিমাণ অবৈধ ভিওআইপি সামগ্রী জব্দের পর অনেকটাই বন্ধ ছিল এ ব্যবসা।
অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসার বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রাখার কথা জানিয়ে এনটিএমসির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান যায়যায়দিনকে বলেন, অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসার কারণে দেশ ও জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সরকার কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে। অতএব এ ধরনের ব্যবসায়ীদের কোনো ছাড় নয়। যাদের বিরুদ্ধেই সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যাবে, তাদেরকেই আইনের আওতায় আনা হবে। এজন্য গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
র্
যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন যায়যায়দিনকে বলেন, টঙ্গীর অভিযানে জব্দ হওয়া সাড়ে ১১ হাজার সিমকার্ডসহ বিপুল অবৈধ ভিওআইপি সরঞ্জাম জব্দের পর ভিওআইপি ব্যবসা সম্পর্কে নানা অজানা তথ্য বেরিয়ে এসেছে। জব্দ হওয়া সিমকার্ডের মধ্যে প্রায় ৮ হাজারই মোবাইল ফোন কোম্পানি বাংলা লিংকের। জব্দ হওয়া সিমকার্ডগুলো কোম্পানিটির অসাধু কর্মকর্তারা বেআইনিভাবে বিক্রি করেছেন বলে গ্রেপ্তার তাজুল ও হারুন জানিয়েছেন। কেন, কী কারণে এবং কী প্রক্রিয়ার মধ্যে
\হসিমকার্ডগুলো বিক্রি করা হয়েছে এ ব্যাপারে এনটিএমসি (ন্যাশনাল টেলিকম মনিটরিং সেন্টার), বিটিআরসি (বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন) ওর্ যাবসহ গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে সম্মিলিতভাবে তদন্ত চলছে।
গ্রেপ্তারদের জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গ্রেপ্তার তাজুল ড্যাফোডিল নামের একটি আইটি কোম্পানিতে লাইনম্যান হিসেবে চাকরি করতেন। চাকরির সুবাদে পরিচয় হয় একজন আইটি বিশেষজ্ঞের সঙ্গে। তার কাছ থেকেই তাজুল অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা শিখেন। ভিওআইপি ব্যবসা করতে মোবাইল ফোনের সিমকার্ড লাগে। অবৈধ সিমকার্ড সংগ্রহ করার সূত্রধরে পরিচয় হয় গ্রেপ্তার হারুনের সঙ্গে। হারুন ২০১৯ সাল থেকে সিমকার্ড বিক্রির ব্যবসা করছিলেন। তাজুল বিপুল পরিমাণ সিমকার্ডের চাহিদার কথা জানায় হারুন। এজন্য হারুনকে প্রতি সিমকার্ডে অন্তত ৫ টাকা লাভ দেবে বলে জানায়। এমন আশ্বাস পেয়ে তাজুল মোবাইল ফোন কোম্পানির অসাধু কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
র্
যাব কর্মকর্তা বলছেন, একাধিক মোবাইল ফোন কোম্পানির অসাধু কর্মকর্তা হারুনের প্রস্তাবে রাজি হন। যেখানে রাস্তায় প্রতিটি সিমকার্ড বিক্রি হয় নামকাওয়াস্তে দামে, সেখানে তাজুল প্রতিটি সিমকার্ড কোম্পানির কাছ থেকে ৬৮ টাকা করে কিনে নেন। এতে করে বিপুল অঙ্কের টাকা চলে যায় মোবাইল ফোন কোম্পানির সংশ্লিষ্ট অসাধু কর্মকর্তাদের পকেটে। বলতে গেলে তারা দ্বিগুণের চেয়েও বেশি দামে বিক্রি করত সিমকার্ডগুলো। তারা কোম্পানির দায়িত্বশীলদের বোঝানোর চেষ্টা করেন, নেটওয়ার্ক ভালো বিধায় সিমকার্ডের চাহিদা বেশি। কোম্পানি বিষয়টিকে স্বাভাবিকভাবেই নেয়। কোম্পানির যত বেশি সিমকার্ড বিক্রি হবে, তত বেশি গ্রাহক বাড়বে। গ্রাহক বাড়লে স্বাভাবিক কারণেই কোম্পানির লাভও হবে অনেক। তাই কোম্পানি বিষয়টি আমলে নেয়নি। যদিও সিমকার্ডগুলো অসাধু কর্মকর্তারা বিভিন্ন নামে হারুনের কাছে বিক্রি করেছেন। যাতে করে সন্দেহের সৃষ্টি না হয়। তবে কোম্পানির ওইসব কর্মকর্তারা জানতেন হারুনের কাছে বিক্রি হওয়া সিমকার্ড দিয়ে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা হয়। হারুন প্রায় ৪০ হাজার অবৈধ সিমকার্ড বিক্রি করেছেন তাজুলের কাছে। এসব সিমকার্ড ব্যবহৃত হয়েছে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসায়।
র্
যাব কর্মকর্তা কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, মূলত মোবাইল ফোন কোম্পানির কর্মকর্তাদের সহযোগিতায়ই তাজুল ও হারুন অবৈধ ভিওআইপি পরিচালনা করতে পেরেছেন। অন্যথায় তাদের পক্ষে এমন অবৈধ ব্যবসা পরিচালনা করা কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। অবৈধ ব্যবসা পরিচালনা করার সুযোগ দিয়ে মোবাইল ফোন কোম্পানির ওইসব অসাধু কর্মকর্তারা হারুন ও তাজুলের কাছ থেকে বাড়তি সুবিধাও নিয়েছেন। মাঝখান থেকে সরকার কোটি কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে। বাকি সিমকার্ডগুলো গ্রামীণফোনসহ বিভিন্ন কোম্পানির।
র্
যাব কর্মকর্তা কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, একজন সেলসম্যান বা রিপ্রেজেন্টেটিভ বা গ্রাহক কোন ফোন কোম্পানির কি পরিমাণ সিমকার্ড কিনতে পারেন, সে সম্পর্কে বিটিআরসির স্পষ্ট নির্দেশনা আছে। হারুনের কাছে সিম বিক্রির ক্ষেত্রে যেসব মোবাইল ফোন কোম্পানির সিমকার্ড পাওয়া গেছে, ওইসব কোম্পানি নির্দেশনা মানেনি। এখন পর্যন্ত তদন্তে একাধিক মোবাইল ফোন কোম্পানির এ ধরনের অবৈধ ব্যবসায় জড়িত থাকা সাত কর্মকর্তার নাম পাওয়া গেছে। গ্রেপ্তার তাজুল এবং হারুনও জিজ্ঞাসাবাদে ওইসব কর্মকর্তাদের নাম প্রকাশ করেছেন। ওই সাত কর্মকর্তাকে গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা হয়েছে। তাদের বিষয়ে গভীর তদন্ত চলছে। প্রয়োজনে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।
প্রসঙ্গত, টঙ্গীর ওই অভিযানে উপস্থিত হয়ে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহম্মেদ পলক বলেন, এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে যারাই জড়িত থাকবে, তাদেরকেই আইনের আওতায় আনা হবে। সারা দেশে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসার বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান চলমান থাকবে। কোন কোন মোবাইল ফোন কোম্পানির সিমকার্ডের সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। বিষয়টি এনটিএমসি, বিটিআরসি (বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন) ওর্ যাব তদন্ত করছে। অবৈধভাবে বিপুল সিম সরবরাহকারীদের গ্রেপ্তারে কাজ চলছে। বিদেশে বসে এমন ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদেরও দেশে এনে আইনের মুখোমুখি দাঁড় করানোর চেষ্টা অব্যাহত আছে।