এ কেমন মৃতু্য!
প্রকাশ | ২৭ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
চন্দনাইশ (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি
প্রায় ছয় বছর আগে রুমি আক্তারের সঙ্গে বিয়ে হয় মো. সবুরের। তাদের ঘরে দুই শিশুর জন্ম হয়। সবুর গত ১৫ বছর ধরে সিএনজি চালিত অটোরিকশা চালাতেন। পরিবার পরিজন নিয়ে চলছিল ছোট্ট সংসার। বর্ষাকাল এলেই তাদের ঘরের চাল দিয়ে পানি পড়ে। তাই তার মাকে প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছিলেন- রোজার ঈদের সময় কিছু অতিরিক্ত ভাড়া টেনে টাকা জোগাড় করবে। এরপর ওই টাকা দিয়ে ঘরের চালের টিন বদলাবে। আর আগামীতে দুই সন্তানকে শিক্ষিত করবে। কিন্তু এসব স্বপ্ন এখন শুধু স্বপ্নই। একটি দুর্ঘটনায় পরিবারের আশা-আকাঙ্ক্ষা আর সবুরের জীবন হলো অঙ্গার!
চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের গাছবাড়িয়া এলাকার বরুমতি সেতুর পাশে সিএনজি চালিত অটোরিকশার সিলিন্ডার
বিস্ফোরণে সবুর পৃথিবী থেকে চির বিদায় নেন। সোমবার বিকালে বালুবাহী ট্রাকের সঙ্গে ধাক্কা লাগলে এ দুর্ঘটনা ঘটে। মো. সবুর (২৮) সাতকানিয়া উপজেলার ঢেমশা ইউনিয়নের ইছামতি আলীনগর এলাকার মফিজুর রহমানের ছেলে।
স্থানীয়রা বলেন, সোমবার বিকাল ৩টার দিকে অটোরিকশাটি পটিয়া থেকে গ্যাস নিয়ে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক দিয়ে কেরানিহাট যাচ্ছিল। পথে কলঘর এলাকায় ট্রাফিক চেকপোস্টে পুলিশ দাঁড়াতে সংকেত দিলে চালক সবুর গাড়িটি ঘুরিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তখন বরুমতি সেতুর পাশে একটি বালুভর্তি ডাম্পার ট্রাকে ধাক্কা লাগে। এতে অটোরিকশার গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে আগুন ধরে যায়। সিএনজিতে থাকা একজন নারী যাত্রীকে স্থানীয় লোকজন উদ্ধার করেন। আর সবুর তার নিজের আসনেই পুড়ে হন কয়লা।
প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন বলেন, হাইওয়ে পুলিশ অটো রিকশাটিকে ধাওয়া করলে অটোরিকশা চালক ভয়ে পালাতে গিয়ে বালুবাহী মিনিট্রাকের সঙ্গে ধাক্কা লাগে। মুহূর্তেই বিস্ফোরণে ঝলসে যায় চালক।
এ ঘটনার পর চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের কলেজ গেট সংলগ্ন এলাকায় এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে অবরোধ করে রাখেন স্থানীয়রা। পরে পুলিশ এসে ব্যারিকেড তুলে দিয়ে যান চলাচল স্বাভাবিক করে।
ঘটনাস্থলে হাইওয়ে পুলিশের উপস্থিতির কথা শোনা গেলেও দোহাজারী হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খান মোহাম্মদ ইরফান সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, 'হাইওয়ে পুলিশের কোনো টিম সেখানে ছিল না। আমরা যতটুকু জেনেছি, জেলা পুলিশের ট্রাফিক সার্জেন্ট সবুজের নেতৃত্বে সেখানে চেকপোস্ট বসানো হয়েছিল।'
তিনি আরও বলেন, বিস্ফোরণে ঘটনাস্থলেই চালকের মৃতু্য হয়েছে। লাশ উদ্ধার করে থানায় রাখা হয়েছে।
চন্দনাইশ থানার অফিসার ইনচার্জ ওবায়দুল ইসলাম ঘটনার সত?্যতা স্বীকার করেন।
এদিকে, সোমবার থেকেই মো. সবুরের ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরছে। কেউ কেউ বিস্মিত হয়ে বলছেন- এ কেমন মৃতু্য!
মঙ্গলবার সকালে নিহত সবুরের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, পাড়া-প্রতিবেশী নারী ও শিশুরা ভিড় করছে। তার অবুঝ দুই সন্তান চার বছর বয়সি ছেলে সাইফুল ইসলাম ও দেড় বছর বয়সি মেয়ে মেহেরিমা জান্নাত এখনো বুঝতেই পারছে না তাদের বাবা আর নেই। বাড়ির সামনের ছোট্ট গলিতে অন্য শিশুদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে তারাও দেখছিল লোকজনের আসা-যাওয়া। কিছুক্ষণ পর সাইফুল ইসলাম দাদির কোলে চড়ে বসে। তা দেখে মেহেরিমা জান্নাতও দাদির কোলে এসে বসে। তখনো দাদি গুলচাম্পা কান্না করছিলেন।
নিহত সবুরের বড় ভাই আবদুল গফুর কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, 'প্রায় ছয় বছর আগে রুমি আক্তারের সঙ্গে বিয়ে হয় সবুরের। তাদের ঘরে দুই শিশুর জন্ম হয়। সোমবার দুপুরের পর যাত্রী নিয়ে চন্দনাইশের দিকে গিয়েছিল আমার ভাইটি। বেলা তিনটার দিকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে বালুবোঝাই একটি ট্রাকের সঙ্গে ধাক্কা লেগে অটোরিকশার সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ঘটে। এতে দগ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলে আমার ভাইটি মারা যায়।'
সবুরের মা গুলচাম্পা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, 'বর্ষাকালে ঘরের চাল দিয়ে পানি পড়ে। ছেলেটি আমাকে বলেছিল, এই সামনের রোজার ঈদের সময় কিছু অতিরিক্ত ভাড়া টেনে টাকা জোগাড় করবে। এরপর ওই টাকা দিয়ে ঘরের চালের টিন বদলাবে। এখন ছেলেটি আগুনে পুড়ে মরে গেল। ঘরের চালের টিন কে বদলাবে। আমি কার কাছে থাকব, কে আমাকে খাওয়াবে?'
সবুরের স্ত্রী রুমি আক্তার বলেন, দুই শিশু শিশুসন্তানকে নিয়ে কীভাবে বাঁচবেন তিনি ভেবে পাচ্ছেন না। সবুরের স্বপ্ন ছিল, ভাঙা ঘরটি নতুন করে মেরামত করবেন। আর দুই সন্তানকে শিক্ষিত করবে।