প্রতি বছরের মতো এবারও ঈদ কেনাকাটায় এসি, মোবাইল ও ল্যাপটপসহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স পণ্যের চাহিদা বেড়েছে। ক্রেতা টানতে দোকানিরা ক্যাশব্যাকসহ নানা অফার দিচ্ছেন। এতে এসব পণ্য বিক্রির পালে নতুন হাওয়া লেগেছে।
বিশেষ করে আসন্ন গ্রীষ্মের কারণে বেড়েছে এসির কদর। এর বাইরেও ল্যাপটপ, মোবাইল ও টিভিতে রয়েছে ক্রেতাদের বিশেষ নজর। এদিকে ডলার সংকট ও এলসি জটিলতা কিছুটা হ্রাস পাওয়ায় এসব পণ্যের আমদানি বেড়েছে। ফলে বেড়েছে পণ্যের সমাহার।
তবে ক্রেতারা মাথায় রাখছেন পণ্যের বিক্রয়ত্তোর সেবা আর এসির ক্ষেত্রে বিদু্যৎ সাশ্রয়ের বিষয়টি। আর তাই চাহিদার শীর্ষে রয়েছে ইনভার্টার এসি। যা সাধারণ এসির তুলনায় বিদু্যৎ খরচ অনেকটাই কম, তবে দাম ১০-২০ হাজার টাকা বাড়তি। অন্যদিকে মোবাইল ও ল্যাপটপে ক্রেতারা গুরুত্ব দিচ্ছেন ব্র্যান্ড এবং টিভিতে গুরুত্ব দিচ্ছেন কালার টোন ও ফিচার।
কিন্তু গত বছরজুড়েই ক্রেতা সংকটে ভুগছিল দ্রম্নত বর্ধনশীল দেশের ইলেকট্রনিক্স ও প্রযুক্তি পণ্য খাত। ডলার ও এলসি সংকটে ব্যবসা অর্ধেকে নেমেছিল বলে জানিয়েছিলেন উদ্যোক্তা ও বিক্রেতারা। এ সময় দাম বেড়েছে ১০-৩০ শতাংশ পর্যন্ত। তবে দেশীয় কোম্পানিগুলো কিছুটা ভালো অবস্থানে ছিল।
তবে এবার রমজানের শরু থেকে অনেকটাই স্বাভাবিক গতিতে ফিরেছে এ খাতের বেচাকেনা। ব্যবসায়ী ও বিক্রেতাদের তথ্যমতে, রাজধানীর বাজারে ২-৩ গুণ বেড়েছে এসির বিক্রির পরিমাণ। এর পরের অবস্থানেই রয়েছে মোবাইল, ল্যাপটপ ও টিভিসহ ছোট-বড় বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য। যদিও মোবাইলে চাহিদা অন্য পণ্যের তুলনায় সারাবছরই ভালো অবস্থানে ছিল। যা এবারের ঈদ বাজারে আরও বেড়েছে। মূলত ডলার সংকট কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ায় পরিস্থিতি পরিবর্তন হয়েছে।
ঈদ উপলক্ষে রাজধানীর বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স পণ্যের শোরুম ও আইসিটি পণ্যের বাজারে দেখা গেছে উলেস্নখযোগ্য সংখ্যক ক্রেতা ও দর্শনার্থী। বিক্রেতারা জানিয়েছেন, প্রায় ৬ মাসেরও বেশি সময় পর প্রত্যাশানুযায়ী ক্রেতার দেখা পাচ্ছেন, বিক্রিও বেড়েছে কয়েকগুণ। মিরপুরের বেগম রোকেয়া সরণিরর্ যাংগস ইলেক্ট্রনিক্স লিমিটেডের শোরুম ইনচার্জ নুরুন নাহার জানান, রমজানের প্রথম সপ্তাহের পর থেকে বিক্রি বেড়েছে। বিশেষ করে এসির বিক্রি দ্বিগুণ হয়েছে।
একই কথা জানিয়েছেন সনি ইলেকট্রনিক্স ও স্মার্ট টেকনোলজি লিমিটেডের কর্পোরেট শাখার শোরুমে সেলস এক্সিকিউটিভ মো. খালেদও। অন্যদিকে আগারগাঁও আইডিবি ভবনের আইসিটি পণ্য বিক্রেতা ও রাজধানীর বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মোবাইলের বিক্রয় কেন্দ্রগুলোর তথ্যানুযায়ী এবার রমজানে প্রায় সবার বিক্রিই তুলনামূলকভাবে বেড়েছে।
এদিনর্ যাংগস শোরুমে
এসি কিনতে আসা তানিয়া সুলতানা বলেন, 'গত বছর ঈদেই ছেলের রুমের জন্য এসি কিনতে চেয়েছিলাম কিন্তু হয়ে ওঠেনি। তাই এবার ঈদের গিফট হিসেবে এটা ওকে দিতে চাই।' শ্যামলী ওয়ালটন শোরুমে এসি কিনেত আসা আকবর হোসেন বলেন, 'বেশিরভাগ সময় ঈদে গ্রামে যাওয়া হয়। কিন্তু এবার যাওয়া হবে না। তাই ঈদ বোনাসের টাকা দিয়ে ডাউন পেমেন্টে এসি কিনলাম।
আকবরের মতো এবার অনেকেই ঈদ বোনাসের টাকায় কিস্তিতে এসি ও টিভি কিনেছেন বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা। অন্যদিকে ঈদ খরচের সঙ্গে কিছুটা যোগ করে ল্যাপটপ কিনেছেন স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসি বিভাগের অনার্স ২য় সেমিস্টারের ছাত্র সাদী আহমদ। আর ছেলের আবদার মেটাতে ঈদে ল্যাপটপ কিনে দিয়েছেন মো. গোলাম হোসেন। তিনি বলেন, 'আমি একটি বেসরকারি হাসপাতালে রেডিওলজি বিভাগের কাজ করি। তাই এত দাম দিয়ে ল্যাপটপ কেনার সুযোগ সব সময় হয় না। তাই ঈদ খরচের সঙ্গে কিছুটা যোগ করে ছেলের আবদার পূরণের চেষ্টা করেছি।'
সাদী ও গোলাম হোসেনের মতো আইসিটির বিভিন্ন পণ্য কেনার উপলক্ষ হিসেবে ঈদকে বেছে নিয়েছেন বেশিরভাগ ক্রেতা। যার প্রভাব পড়েছে এ খাতের ব্যবসায়। গত ডিসেম্বরে আইডিবি কম্পিউটার সিটির ব্যবসায়ীরা যায়যায়দিনের প্রতিবেদককে বলেছিলেন, ডলার সংকট ও এলসি খুলতে না পারায় আইসিটি পণ্যের আমদানি হ্রাস পেয়েছে। এ ছাড়া অতিরিক্ত দাম বৃদ্ধিতে বিক্রিও নেমেছিল অর্ধেকে। তবে এই রমজানে স্বাভাবিক হয়েছে এ খাতের পণ্যের বেচাকেনা, বিশেষ করে ল্যাপটপের।
ফ্লোরা লিমিটেডের আইডিবি শাখা ম্যানেজার মোহাম্মাদ রেজাউল হাসান বলেন, মূলত ল্যাপটপ ও কম্পিউটারই দেশের বাজারে প্রধান পণ্য। একমাস আগেও প্রত্যাশা অনুযায়ী বিক্রি ছিল না। বাড়তি দামে এলসি খোলাসহ বন্দর চার্জ ও অতিরিক্ত ট্যাক্স দিয়ে ল্যাপটপ আমদানি করেও ক্রেতা পাওয়া যাচ্ছিল না। তবে ১০ রমজানের পর বিক্রি স্বাভাবিক হয়েছে। শুধু এই ভবনেই নয়, সারাদেশে তাদের সব বিক্রয় কেন্দ্রে ক্রেতা চাপ বেড়েছে।
তবে দাম বেশি থাকায় বেশিরভাগ ক্রেতাই কিস্তি সুবিধা গ্রহণ করছেন। বিক্রেতারা বলছেন আগে ১০০ ল্যাপটপের মধ্যে ৯০টিই ফুল পেমেন্ট হতো। কিন্তু এখন বেশিরভাগ ক্রেতাই অর্ধেক টাকা ডাউন পেমেন্ট কিস্তিতে কিনছেন। একই অবস্থা এসি, টিভিসহ ৫০ হাজার টাকার বেশি অধিকাংশ পণ্যে। মূলত দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রতিষ্ঠানগুলো এই সুবিধা রাখছেন। দেখা গেছে কোর আই থ্রি প্রসেসরে যে কোনো ব্র্যান্ডের ল্যাপটপ গত বছর ৪০ হাজার টাকার নিচে বিক্রি হলেও এখন বিক্রি হচ্ছে ৫৫-৬০ হাজার আর কোর আই ফাইভ প্রসেসরের ল্যাপটপ। গত বছর ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি হলে এখন বিক্রি হচ্ছে ৬৮-৮০ হাজার টাকায়।
সনির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পণ্যভেদে ১০-১৫ শতাংশ পর্যন্ত এ বছর দাম বেড়েছে। আরর্ যাংগসের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তাদের এসিতেও ৫-১০ শতাংশ পর্যন্ত দাম বেড়েছে। দেড় টনের এসি গত বছর ৫২ হাজার টাকায় বিক্রি হলেও এবার হচ্ছে ৬৭ হাজার টাকায়। তবে ঈদ উপলক্ষে এসব পণ্যে ডিজিটাল পেমেন্টে ক্যাশ ব্যাক অফার, স্ক্র্যাচ কার্ডে বড় অংকের ছাড়, বিশেষ পণ্যে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দেওয়া হয়েছে। যেমন সনি ইলেক্ট্রনিক্সের টিভিসহ বেশকিছু আইটেমে ২৫ শতাংশ ছাড় দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
ঈদের পর কেউ কেউ ব্যবসা ফের পরে যাওয়ার আশঙ্কা জানালেও এবারে ঈদে এ খাতের প্রবৃদ্ধিকে ঘুরে দাঁড়ানোর টনিক হিসেবে দেখছেন অনেকেই। তারা বলছেন, বিক্রি কমে যাওয়ায় অনেক ডিলার পণ্য নেওয়া কমিয়ে দিয়েছেন, অনেকেই শোরুমের পরিচালন ব্যয় মেটাতে না পারায় বিক্রি বন্ধ রেখেছে। এতে বিনিয়োগের আগ্রহ হারিয়েছে সারাদেশের লোকাল ডিলাররা। ফলে পণ্যের আমদানি হ্রাসের প্রবণতা ও এর ফলে সৃষ্ট সংকটে দাম আরও বেড়েছে। তাই এবারে ঈদ বাজারে ব্যবসা এ খাতে গতি ফেরাবে বলে আসা তাদের।
এদিকে বাংলাদেশে গত এক বছরে টিভি, এসি ও ল্যাপটপ ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়েছে। পাশাপাশি বেড়েছে ডেস্কটপ কম্পিউটার ব্যবহারকারীর সংখ্যাও। সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর (বিবিএস) প্রকাশিত 'বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্স-২০২৩: গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল' শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে দেশে স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ৭৪.৫০ শতাংশ। ২০২২ সালে যেটি ছিল ৭০.০৩ শতাংশ। পাশাপাশি ২০২৩ সালে দেশে ল্যাপটপ ও ডেস্কটপ কম্পিউটার ব্যবহার করেছেন ৪.৬৯ শতাংশ মানুষ, যা ২০২২ সালে ছিল ৪.২৬ শতাংশ। ২০২৩ সালে ৫৩.৪০ শতাংশ মানুষ রেফ্রিজারেটর ব্যবহার করেছেন, যা ২০২২ সালে ছিল ৪৯.৮১ শতাংশ। একইভাবে এসি ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২০২৩ সালে বেড়ে ২.২৮ শতাংশ হয়েছে, যা ২০২২ সালে ছিল ১.৭৪ শতাংশ। মোটরবাইক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২০২২ সাল থেকে ০.৫৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ২০২৩ সালে ১১.১১ শতাংশে পৌঁছেছে।