আজ মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। বাঙালি জাতির সবচেয়ে গৌরবের দিন, পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর দিন। অত্যাচার-নিপীড়নে জর্জরিত বাঙালি জাতির সামনে আলোকময় ভবিষ্যতের দুয়ার খুলে দেওয়ার দিন।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্বিচার হত্যা, ধ্বংস ও পৈশাচিকতার বিরুদ্ধে ৯ মাসের মরণপণ লড়াইয়ে ৩০ লাখ শহীদের আত্মদানের বিনিময়ে অভু্যদয় ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশের। গোটা জাতি আজ শ্রদ্ধার সঙ্গে
স্মরণ করছে দেশের জন্য আত্মোৎসর্গকারী শহীদদের। শ্রদ্ধা জানাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ বাংলার অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের।
১৯৭১ সালের এই দিনে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়েছিল। ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বাঙালিদের ওপর অতর্কিত গণহত্যা অভিযান 'অপারেশন সার্চলাইট' শুরু এবং বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের পূর্বে বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ রাতের প্রথম প্রহরে ঢাকায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুর ওই ঘোষণা বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে প্রচারিত হয়।
বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তারের আগ মুহূর্তে স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়ে শত্রম্নসেনাদের বিতাড়িত করতে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়াই করতে দেশবাসীকে নির্দেশ দেন। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, 'ইহাই হয়তো আমাদের শেষ বার্তা, আজ হইতে বাংলাদেশ স্বাধীন।' আমি বাংলাদেশের জনগণকে আহ্বান জানাইতেছি যে, যে যেখানে আছেন, যার যাহা কিছু আছে, তাই নিয়ে রুখে দাঁড়াও, সর্বশক্তি দিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করো। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলার মাটি হইতে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জন না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাও। শেখ মুজিবুর রহমান। ২৬ মার্চ, ১৯৭১।'
তৎকালীন ইপিআরের ওয়্যারলেস থেকে বঙ্গবন্ধুর সেই বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া হয় দেশের সর্বত্র। বঙ্গবন্ধুর এ ঘোষণায় সেদিনই ঐক্যবদ্ধ সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে গোটা জাতি। চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ। ২৬ মার্চ দুপুরে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল হান্নান বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা পাঠ করেন। এরপর ২৬ ও ২৭ মার্চ বেশ কয়েকজন শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন।
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলার নিভৃত আমবাগানে শপ নেয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, তার অনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে এই সরকারের নেতৃত্বেই মুক্তিযুদ্ধ আনুষ্ঠানিক কাঠামো লাভ করে। একটি সুশৃঙ্খল ও অত্যাধুনিক সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালিদের রুখে দাঁড়ানোর নজির পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী প্রাণপণ যুদ্ধের সফল পরিণতিতে বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ ঘটে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলার আকাশে ওড়ে বিজয়ের লাল-সবুজ পতাকা। মরণপণ লড়াই ও এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় এই বিজয়। স্বাধীনতা তাই বাংলাদেশিদের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন।
প্রতি বছরের মতো এবারও সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে স্বাধীনতা দিবস উদযাপিত হচ্ছে জাঁকজমকপূর্ণভাবে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে দিনটি পালন করছে। বিটিভি, বাংলাদেশ বেতারসহ বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশন স্বাধীনতা দিবসের বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার করছে। সংবাদপত্রগুলো প্রকাশ করছে বিশেষ ক্রোড়পত্র। আজ সরকারি ছুটির দিন। সারাদেশে সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারিভাবে এবং দলীয় ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে। যথাযোগ্য মর্যাদা ও স্মরণে দিনটি পালিত হচ্ছে।
মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপনের লক্ষ্যে ঢাকাসহ সারাদেশে প্রতু্যষে ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে দিবসটির সূচনা হবে। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। এরপর মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রীর নেতৃত্বে উপস্থিত বীরশ্রেষ্ঠ পরিবার, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও বীর মুক্তিযোদ্ধারা পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। বাংলাদেশে অবস্থিত বিদেশি কূটনীতি, বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনসহ সর্বস্তরের জনগণ পুষ্পস্তবক অর্পণ করে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন।
এ উপলক্ষে সব সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি ভবনে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় পতাকা এবং ঢাকা শহরের ভবনসমূহে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়েছে এবং গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও স্থাপনায় আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হয়েছে। ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবসের কর্মসূচির আওতায় সোমবার রাত ১১টা থেকে ১১টা ১ মিনিট পর্যন্ত সারাদেশে প্রতীকী 'বস্ন্যাক আউট' পালন করা হয়।