মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
জাতির উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী

কান্ডারি হুঁশিয়ার

যাযাদি রিপোর্ট
  ২৬ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
কান্ডারি হুঁশিয়ার

পরাধীনতার অর্গল ভেঙে স্বাধীন বাংলাদেশের অভু্যদয়ের সাড়ে পাঁচ দশক হতে চললেও এ দেশের অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করতে 'ষড়যন্ত্র থেমে নেই' মন্তব্য করে সবাইকে সজাগ থাকার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।

তিনি বলেছেন, 'অপ্রিয় হলেও সত্য যে, আমাদের এই স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে খর্ব করার এবং অর্থনৈতিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্র আজও থামেনি। ষড়যন্ত্রকারীরা এখনও ওত পেতে বসে আছে কীভাবে বাংলাদেশের অগ্রসরমান অভিযাত্রাকে স্তব্ধ করা যায়। একাত্তরের পরাজিত শক্তি ও পঁচাত্তরের ঘাতক এবং তাদের দোসররা এখনো তৎপর রয়েছে পরাজয়ের বদলা নিতে। সুযোগ পেলেই তারা আঘাত হানবে। তাদের সামনে একমাত্র বাধা আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগকে ছলে-বলে-কৌশলে নিশ্চিহ্ন বা দুর্বল করতে পারলেই পরাজিত শক্তির উত্থান অনিবার্য। কাজেই কান্ডারি হুঁশিয়ার।'

স্বাধীনতার ৫৪ বছর পূর্তির প্রাক্কালে সোমবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে এসব কথা বলেন তিনি।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, 'এই ভূখন্ড যুগ যুগ ধরে ঔপনিবেশিক শক্তির লক্ষ্যবস্তু ছিল। নানা সময়ে বিদেশি শক্তিরা এদেশ নিজেদের কব্জায় নিয়ে শাসন করেছে, সম্পদ লুট করেছে, শোষণ করেছে। কোনোদিনই বাঙালি পরিপূর্ণ স্বাধীনতার স্বাদ পায়নি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ২৩ বছরের রাজনৈতিক সংগ্রাম আর ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি ১৯৭১ সালে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো সম্পূর্ণভাবে মুক্তিলাভ করে।'

প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'বাঙালি বীরের জাতি। যুদ্ধ করে আমরা এদেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছি। সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়- জাতির পিতা নির্দেশিত এই বৈদেশিক নীতি অনুসরণ করেই আমরা দেশ পরিচালনা করি। আমাদের কোনো প্রভু নেই, আছে বন্ধু।'

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আবারও আওয়ামী লীগের ওপর 'আস্থা রাখায়' দেশের নাগরিকদের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা

জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, 'আমাদের লক্ষ্য, যে উন্নয়ন-অগ্রগতি আমরা এখন পর্যন্ত সাধন করেছি তা আরও এগিয়ে নিয়ে বাংলাদেশকে ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত-সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। যে বাংলাদেশ হবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলাদেশ।'

জাতির উদ্দেশে তিনি বলেন, 'স্বাধীনতার ৫৪তম দিবসে আসুন, সকল কূট-কৌশল-ষড়যন্ত্রের বেড়াজাল ছিন্ন করে ঐক্যবদ্ধভাবে বাংলাদেশের উন্নয়ন-অগ্রযাত্রাকে আরও সামনে এগিয়ে নিয়ে যাই।'

'দেশবাসীর প্রত্যাশা অনেকাংশে পূরণ করেছি'

গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে পঞ্চমবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার প্রসঙ্গ ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'দেশবাসীর প্রতি আমার কর্তব্য হিসেবে এবং আমার পিতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ার কাজ আরও এগিয়ে নেওয়ার জন্য আমি বার বার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছি। আমি চেষ্টা করেছি সকলের সমর্থন এবং সহযোগিতা নিয়ে এদেশের সাধারণ মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের মাধ্যমে তাদের মুখে হাসি ফোটাবার। আজকে ২০২৪ সালে স্বাধীনতার ৫৩তম বার্ষিকীতে আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে চাই, আমরা দেশবাসীর প্রত্যাশা অনেকাংশেই পূরণ করতে সক্ষম হয়েছি।'

শেখ হাসিনা বলেন, 'এটা কোনো অসার বাগাড়ম্বর দাবি নয়। বাংলাদেশ আজ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল বিশ্বে একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আমরা প্রমাণ করেছি রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে সীমিত সম্পদ দিয়েও একটি দেশকে এগিয়ে নেওয়া যায়।'

'কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না'

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর সামরিক শাসকের ক্ষমতাগ্রহণ এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে জাতির পিতার নেওয়া সকল কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ার কথা প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে তুলে ধরেন।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফেরার পর দেশকে আবার উন্নয়নের মহাসড়কে তুলতে যা যা করা হয়েছে সবিস্তারে তার বিবরণ দেন প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, 'আপনাদের ম্যান্ডেট নিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বিগত পনের বছরের অধিক সময় ধরে সরকার পরিচালনা করছে। এই পনের বছরের অভিযাত্রা একেবারেই কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না।'

প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগ, মহামারি, যুদ্ধ, আন্তর্জাতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি এবং সর্বোপরি দেশি-বিদেশি শক্তির নানা 'ষড়যন্ত্র' এ জাতির চলার পথকে 'বারবার বাধাগ্রস্ত' করেছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, 'প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগও জনজীবনে কম দুর্ভোগের কারণ হয়নি। ২০১৩-১৪ সময়ে এবং ২০১৬ সালে বিএনপি-জামাতের দেশব্যাপী হরতাল-অবরোধ, অগ্নি-সন্ত্রাস, অগণিত মানুষ হত্যার মতো নৃশংসতা এখনো জনমনে গভীর দাগ কেটে আছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপি এবং তার মিত্ররা এবারও হরতাল-অবরোধ, অগ্নি সংযোগের মতো সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের সূচনা করেছিল। কিন্তু জনগণের প্রতিরোধের মুখে এবার তাদের পিছু হটতে বাধ্য হতে হয়। তবুও তাদের হাতে বেশ কয়েকজন নিরীহ মানুষ প্রাণ হারান এবং কয়েকশ কোটি টাকার সম্পদ বিনষ্ট হয়।'

শেখ হাসিনা বলেন, 'এসব অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করে আমরা দেশের অগ্রযাত্রাকে আরও বেগবান করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বিগত দেড় দশকে আর্থ-সামাজিক খাতে বাংলাদেশের অভূতপূর্ব রূপান্তর ঘটেছে। অভ্যন্তরীণ এবং বাইরের অভিঘাত মোকাবিলা করে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ২০২৬ সাল নাগাদ বাংলাদেশ স্থায়ীভাবে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে শামিল হবে।'

স্বাধীনতা পুরস্কার দিলেন প্রধানমন্ত্রী

এদিকে, জাতীয় পর্যায়ে গৌরবোজ্জ্বল ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিতে দেশের দশ ব্যক্তির হাতে স্বাধীনতা পুরস্কার তুলে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

সোমবার রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তি ও তাদের প্রতিনিধিদের হাতে স্বাধীনতা পুরস্কার তুলে দেন সরকারপ্রধান।

এ বছর স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য তিনজন; চিকিৎসাবিদ্যা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, সংস্কৃতি এবং ক্রীড়ায় একজন করে মোট চারজন এবং সমাজসেবায় তিনজনকে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ এ পদকে ভূষিত করা হল।

স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য এ বছর স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছেন কাজী আবদুস সাত্তার, বীর মুক্তিযোদ্ধা ফ্লাইট সার্জেন্ট মো. ফজলুল হক (মরণোত্তর) ও বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ আবু নইম মো. নজিবউদ্দিন খাঁন (খুররম) (মরণোত্তর)।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে অবদানের জন্য এ পুরস্কার পেয়েছেন ড. মোবারক আহমদ খান।

চিকিৎসাবিদ্যায় ডা. হরিশংকর দাশ, সংস্কৃতিতে গীতিকার, লেখক, চলচ্চিত্রের কাহিনীকার মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান ও ক্রীড়ায় ফিরোজা খাতুনকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ এই সম্মাননা দেওয়া হয়। এছাড়া সমাজসেবা/জনসেবায় অবদানের অরণ্য চিরান, বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক ডা. মোলস্না ওবায়েদুলস্নাহ বাকী ও এসএম আব্রাহাম লিংকনকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়া হয়।

নিভৃতে থেকে যারা মানুষের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছেন, সেইসব নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে সম্মানিত করার ওপর জোর দিয়ে অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা বলেন, 'আমি আহ্বান জানাচ্ছি যারা বিভিন্ন গ্রাম-গঞ্জে ও অন্যান্য এলাকায় নিবেদিতপ্রাণ হয়ে কাজ করে চলেছেন, তাদের খুঁজে বের করে পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করার জন্য। তাদের জন্য নয়, বরং জনগণের কল্যাণের জন্য। কারণ, তারা কখনোই সামনে আসেন না বা আসতে চান না। নিজস্ব উদ্যোগে বা স্ব-প্রণোদিত হয়ে যারা মানুষের কল্যাণে বিভিন্ন অবদান রেখে যাচ্ছেন তাদের পুরস্কৃত করতে পারাটাই সবচেয়ে বড় কথা।'

যারা স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছেন, তাদের সবাইকে অভিনন্দন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'এই পুরস্কার প্রাপ্তির ফলে মানুষের জন্য কাজ করা ও দেশের জন্য কাজ করার ক্ষেত্রে আরো অনেকে অনুপ্রাণিত হবেন এবং দেশের কল্যাণে কাজ করবেন সেটাই আমরা আশা করি।'

মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেনের সঞ্চালনায় মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, বিচারপতি, জাতীয় সংসদ সদস্য, বিদেশি কূটনীতিক, সরকারের পদস্থ সামরিক এবং বেসামরিক কর্মকর্তা, মুক্তিযোদ্ধা, রাজনীতিবিদ, কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী এবং দেশবরেণ্য ব্যক্তিরা অনুষ্ঠানে অংশ নেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে