ভারতীয় চোরাচালানের পেঁয়াজে সয়লাব চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ
প্রকাশ | ২৫ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
ইব্রাহিম খলিল, চট্টগ্রাম
গত ৮ ডিসেম্বর থেকে বৈধপথে ভারতীয় কোনো পেঁয়াজ আসেনি চট্টগ্রামে। এর মধ্যে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার গত শনিবার ফের অনির্দিষ্টকালের জন্য পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ ঘোষণা করেছে। এতে আবারও পেঁয়াজের দাম বাড়ার শঙ্কা করছেন বিক্রেতারা।
তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, বৈধপথে ভারতীয় পেঁয়াজ না এলেও চোরাইপথে যে পেঁয়াজ এসেছে তাতে সয়লাব হয়ে গেছে দেশের বৃহৎ পাইকারি ভোগ্যপণ্যের বাজার খাতুনগঞ্জের আড়ত। ফলে কমেছে দামও। আর মজুদ এই পেঁয়াজ দিয়ে অন্তত চার মাস চলবে দেশের বাজার।
ব্যবসায়ীরা জানান, আভ্যন্তরীণ বাজারে সরবরাহ ঠিক রাখতে গত ৭ ডিসেম্বর পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ ঘোষণা করে ভারত সরকার। এই ঘোষণার পরপরই অস্থিতিশীল হতে শুরু করে বাংলাদেশের পেঁয়াজের বাজার। হু-হু করে বাড়তে থাকে দাম। কেজিপ্রতি দাম গিয়ে ঠেকে ২৪০ টাকা পর্যন্ত।
রমজান মাসে পেঁয়াজের দাম আরও বাড়তে পারে, এমন শঙ্কা থেকে ফেব্রম্নয়ারির মাঝামাঝি ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ভারত সরকারও এতে নীতিগত সম্মতি দেয়। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, রোজার আগেই দেশে আসবে ভারতীয় পেঁয়াজ। তবে ঘোষণার মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো সরকারিভাবে দেশে আসেনি ভারতীয় কোনো পেঁয়াজ।
তবে সীমান্ত দিয়ে চোরাইপথে আসা পেঁয়াজে ভরে গেছে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের আড়ত। এতে দেশের বৃহৎ ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজারটিতে ভারতীয় পেঁয়াজের দাম কমে কেজিপ্রতি ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। কমেছে দেশি পেঁয়াজের দামও।
রোববার (২৪ মার্চ) খাতুনগঞ্জ ও চাক্তাইয়ের মোকামে দেশি পেঁয়াজ ৪০ থেকে ৭০ টাকায় এবং ভারতীয় নাসিক জাতের পেঁয়াজ বিক্রি হয় কেজিপ্রতি ৬০-৬৫ টাকায়। আড়তদাররা বলছেন, দেশি পেঁয়াজ পুরোপুরি বাজারে আসায় এবং চোরাইপথে ভারতীয় পেঁয়াজ আসায় বাজারে সরবরাহ বেড়ে গেছে।
ফলে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার শনিবার অনির্দিষ্টকালের জন্য ফের পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ ঘোষণা করলেও আপাতত বাড়েনি পেঁয়াজের দাম। এখনো কমে যাওয়া দামেই বিক্রি হচ্ছে পেঁয়াজ। তবে এর আগে পেঁয়াজ রপ্তানি
বন্ধের খবরে দাম বাড়িয়েছে ব্যবসায়ীরা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, রমজানের শুরুতে পেঁয়াজের যে চাহিদা ছিল তা এখন নেই। তাছাড়া খাতুনগঞ্জে যে পেঁয়াজ মজুদ আছে তাতে চারমাস পর্যন্ত চলবে দেশের বাজার। বরং মজুদ পেঁয়াজ পচনের শঙ্কা রয়েছে। এতে দাম বাড়ার সম্ভাবনা কম। উল্টো আরও কমে যেতে পারে পেঁয়াজের দাম।
আমদানিকারকদের তথ্যমতে, ভারতের স্থানীয় বাজারে পেঁয়াজের দাম বেড়ে যাওয়ায় গত বছরের আগস্টে সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে পেঁয়াজ রপ্তানিতে ভারত সরকার ৪০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে। এরপর গত অক্টোবরে পেঁয়াজের সর্বনিম্ন রপ্তানি মূল্য নির্ধারণ করা হয় টনপ্রতি ৮০০ মার্কিন ডলার।
কিন্তু অভ্যন্তরীণ বাজারে পেঁয়াজের দাম বাড়ায় এবং এসব পদক্ষেপ তেমন কার্যকর না হওয়ায় গত ৮ ডিসেম্বর থেকে পেঁয়াজ রপ্তানি পুরোপুরি বন্ধ করে ভারত সরকার। ভারতের ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফরেন ট্রেড কার্যালয় গত ৭ ডিসেম্বর এক আদেশে চলতি বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত পেঁয়াজ রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিলে বাংলাদেশের বাজারে হু-হু করে বাড়তে থাকে দাম। দেশের বাজারে ২৪০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয় প্রতি কেজি পেঁয়াজ। পরে দেশি পেঁয়াজ বাজারে আসা শুরু করলে ধীরে ধীরে কমে ৫০-৬০ টাকা কেজিতেও পেঁয়াজ বিক্রি হয়। ফেব্রম্নয়ারি মাসের শুরু থেকে আবারও বাড়তে থাকে পেঁয়াজের দাম। খুচরা বাজারে রোজার শুরুতেও ১২০-১৩০ টাকা কেজিতে ভারতীয় পেঁয়াজ বিক্রি হয়।
এদিকে রমজান মাসে দেশের বাজারে দাম আরও কমাতে নির্দিষ্ট পরিমাণে চিনি ও পেঁয়াজ রপ্তানির অনুমতি দিতে ভারতকে আনুষ্ঠানিক চিঠি দেয় বাংলাদেশ সরকার। ফলে ৫০ হাজার টন পেঁয়াজ ও এক লাখ মেট্রিক টন চিনি আনার ঘোষণা দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু সরকারি ঘোষণার মাস পেরোলেও এখনো সরকারি উদ্যোগে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি শুরু হয়নি।
তবে বাংলাদেশে পেঁয়াজের অতিরিক্ত দামের সুযোগে ভারত থেকে চোরাইপথে পেঁয়াজ আসা শুরু হয়। ফেব্রম্নয়ারির শুরু থেকে চোরাইপথে আসা পেঁয়াজ বিক্রি শুরু হয় খাতুনগঞ্জ ও চাক্তাইয়ের মোকামে।
সরেজমিন দেখা যায়, খাতুনগঞ্জ ও চাক্তাইয়ের মোকামগুলো পেঁয়াজে ভর্তি, বিক্রিও হচ্ছে সমানতালে। তবে পাইকারি বাজারে দাম কমার প্রভাব আনুপাতিকহারে খুচরা বাজারে পড়েনি। খুচরা ব্যবসায়ীদের দাবি, এখনো দোকানে রমজানের আগে কেনা পেঁয়াজ রয়েছে। যে কারণে খুচরা দোকানগুলোর বড় অংশ এখন লোকসান দিয়ে পেঁয়াজ বিক্রি করছে। পাইকারি বাজার থেকে খুচরা বাজারে কেজিপ্রতি ২৫-৩০ টাকার পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।
চাক্তাইয়ের বশর অ্যান্ড সন্সের ম্যানেজার মো. শহীদ বলেন, আড়তে দেশি পেঁয়াজের পাশাপাশি ভারতীয় পেঁয়াজে ভরে গেছে। মঙ্গলবার ভারতীয় পেঁয়াজ ৫৫ টাকা এসেছিল। শনিবার ফের পাঁচ টাকা বেড়েছে। রোজার আগেও ভারতীয় পেঁয়াজ ১২০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। একইভাবে দেশি পেঁয়াজের দামও কমেছে। মাঝারি সাইজের পেঁয়াজ ৫০-৫২ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে।
খাতুনগঞ্জের মেসার্স জামেনা ট্রেডিংয়ের পরিচালক মো. আজগর হোসেন বলেন, রোজার শুরুতে সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়। এ সময় বেশিরভাগ মানুষ পুরো মাসের বাজার করেন। যে কারণে রোজার শুরুতে একত্রে বেশি পেঁয়াজ কিনেছেন ভোক্তারা। রোজা শুরুর পর পাইকারি কিংবা খুচরা বাজারে পেঁয়াজের বিক্রি কমেছে। কিন্তু আড়তে পেঁয়াজের সরবরাহ স্বাভাবিক ছিল। যে কারণে দাম দ্রম্নত কমে গেছে।
তিনি বলেন, বর্তমানে পাবনা, চুয়াডাঙ্গা, ফরিদপুর, রাজবাড়ী থেকে দেশি পেঁয়াজ আসছে খাতুনগঞ্জের আড়তে। ফরিদপুরের ছোট ও মাঝারি দানার পেঁয়াজ ৪০ থেকে ৫৫ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। পাশাপাশি পাবনার মোটা দানার ভালো পেঁয়াজ ৬৫-৭০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। রোববার ফরিদপুরের বাজারে মোটা দানার পেঁয়াজ দুই হাজার ৪০০ থেকে আড়াই হাজার টাকায় বিক্রি হয়। খাতুনগঞ্জে আসতে যাবতীয় খরচসহ কেজিতে ৬৮ টাকা পড়ছে ক্রয়মূল্য।
খাতুনগঞ্জের হামিদউলস্না মিয়া বাজারের ব্যবসায়ী আবু তৈয়ব বলেন, বাজারের প্রতিটি আড়ত পেঁয়াজে ভর্তি। অনেকে আড়তে রাখতে না পেরে ফুটপাতে পেঁয়াজ রেখেছেন। দেশি পেঁয়াজের পাশাপাশি ভারতীয় পেঁয়াজের দাম কমে গেছে। রোজার আগে ভারতীয় ১২০ টাকার পেঁয়াজ এখন ৬০ টাকা। আবার রোজার আগে ৯০ টাকার দেশি পেঁয়াজ এখন ৫০-৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বাজারের ফয়েজ স্টোরের স্বত্বাধিকারী বাবুল বড়ুয়া বলেন, মুদি দোকানে সব ধরনের আইটেম রাখতে হয়। ক্রেতাদের চাহিদা মেটানোর জন্য রোজার আগের পেঁয়াজ এখনো বিক্রি করছেন। রোজার আগে ১১০ টাকা কেনা পেঁয়াজ ৮০-৯০ টাকায় বিক্রি করছেন। কেজিতে ২০-৩০ টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে।
এদিকে ভারত অনির্দিষ্টকালের জন্য পেঁয়াজ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিলেও খাতুনগঞ্জে এর কোনো প্রভাব পড়বে না বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। বর্তমানে পেঁয়াজের যে মজুদ তা দিয়ে অন্তত আরও চার মাস চাহিদা মেটানো যাবে বলে ধারণা করছেন তারা। তবে অসাধু ব্যবসায়ীরা সুযোগ বুঝে পেঁয়াজের ঝাঁজ বাড়িয়ে দেবেন না এই শঙ্কাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না তারা। ভারতীয় নিষেধাজ্ঞাকে পুঁজি করে পেঁয়াজের দাম আরও বাড়াবে অসাধু ব্যবসায়ীরা- এমন শঙ্কা ক্রেতা-বিক্রেতা সবার।
খাতুনগঞ্জ হামিদুলস্নাহ মিয়া মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইদ্রিস বলেন, নতুন করে ভারত সরকার পেঁয়াজ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিলেও বাংলাদেশ তথা চট্টগ্রামে এর প্রভাব পড়বে না। কেননা বর্তমানে বাজারে যা পেঁয়াজ সরবরাহ আছে তা দিয়ে চট্টগ্রামে আগামী চার মাস চলবে। তবে দামের কথা চিন্তা করলে হয়তো নতুন করে ১০ টাকা করে বাড়তে পারে। তবে সেটি আগের দামে যাবে না।
মো. ইদ্রিস বলেন, ভারত থেকে বৈধপথে কোনো পেঁয়াজ আসছে না। দেশে এখন যত ভারতীয় পেঁয়াজ আছে সবই চোরাইপথে এসেছে। চোরাইপথে আসা ভারতীয় পেঁয়াজে এখন বাজার সয়লাব হয়ে গেছে। সেগুলো পাইকারিতে বিক্রি হচ্ছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকায়। আর মেহেরপুর (দেশি) পেঁয়াজ প্রতিকেজি ৪৫ থেকে ৫০ টাকা এবং ফরিদপুর (দেশি) পেঁয়াজ ৫০ থেকে ৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
তিনি বলেন, রোজার আগে যখন দাম বেশি ছিল তখন দেশে পেঁয়াজ কাটা তেমন শুরু হয়নি। এখন দেশি পেঁয়াজের ভরপুর মৌসুম। তাই বাজারে দেশি পেঁয়াজের সরবরাহ বেড়েছে। পাশাপাশি ভারতীয় পেঁয়াজ বাজারে থাকার কারণে দাম কমে গেছে। তাছাড়া রোজার শুরুতে চাহিদা বেশি ছিল, এখন চাহিদা অনেক কমে গেছে। এতে খুচরায় বেচাকেনা কম, তাই পাইকারি বাজারে দাম কমেছে। তবে বর্তমান বাজার দামে কৃষক কিংবা আড়তদার ব্যবসায়ীদের কোনো সমস্যা হচ্ছে না বলে জানান তিনি।
তবে আবারও আগের দামের কাছাকাছি ফিরে যাওয়ার শঙ্কা করছেন কেউ কেউ। খাতুনগঞ্জের বিছমিলস্নাহ ট্রেডার্সের ব্যবস্থাপক আবুল কাশেম বলেন, গত সপ্তাহে ভারত থেকে পেঁয়াজ আসার খবরে হু-হু করতে কমতে থাকে দাম। বর্তমানে যে দামে বাজারে পেঁয়াজ বিক্রি করা হচ্ছে। তা বলতে গেলে লোকসান দিয়েই বিক্রি করতে হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, এখন বাজারে যেসব ভারতীয় পেঁয়াজ রয়েছে তা চোরাই পথে আসা। ভারত থেকে বৈধ পথে পেঁয়াজ আসার খবরে দেশি পেঁয়াজ থেকে শুরু করে ভারতীয় পেঁয়াজ সব ধরনেরই দাম কমে গেছে। এখন তো শুনছেন নতুন করে অনির্দিষ্টকালের জন্য পেঁয়াজ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ভারত। তাহলে যেভাবে পেঁয়াজের দাম কমেছিল সেভাবে আবারও আগের দামে ফিরে যাবে পেঁয়াজের দাম। এ ছাড়া খুচরা পর্যায়েও পেঁয়াজের দাম নতুন করে প্রভাব পড়বে।
খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, এখনো কমে যাওয়া দামেই বিক্রি হচ্ছে পেঁয়াজ। অনেক খুচরা বিক্রেতা জানে না নতুন করে ভারত পেঁয়াজ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। জানলে পেঁয়াজের ঝাঁজ বাড়ানো শুরু করবে বিক্রেতারা। তবে পাইকারি বাজারে পণ্যের দামের ওপর নির্ভর করে খুচরায় বিক্রির দাম।
প্রসঙ্গত, ভারত বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ পেঁয়াজ রপ্তানিকারী দেশ। বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, নেপাল ও সংযুক্ত আরব আমিরাত ভারতীয় পেঁয়াজের সবচেয়ে বড় ক্রেতা। তবে মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশেও রপ্তানি হয় ভারতীয় পেঁয়াজ। প্রতিবছর ডিসেম্বরে ভারত পেঁয়াজ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়। এরপর দেশটির অভ্যন্তরীণ বাজারে পেঁয়াজের দামে ধস নামে। আর বিশ্ববাজারে পেঁয়াজের দাম বাড়ে হু-হু করে।