সুযোগ বুঝে চড়া দাম হাঁকছেন বিক্রেতারা

নিম্নবিত্তের বাজারে মধ্যবিত্তের ভিড়

প্রকাশ | ২৫ মার্চ ২০২৪, ০০:০০

সাখাওয়াত হোসেন
ফুটপাতে জমে উঠেছে ঈদের কেনাকাটা। ছবিটি রোববার নিউমার্কেট এলাকা থেকে তোলা -নাজমুল ইসলাম
রাজধানীর নিউ মার্কেটের খোলা চত্বরের অস্থায়ী দোকান থেকে দুই মেয়ের ঈদের পোশাক কিনতে উত্তরা থেকে এসেছেন আফজাল হোসেন। মধ্যম আয়ের এই ব্যাংক কর্মকর্তার টার্গেট নামিদামি শপিংমল-বিপণী-বিতান এড়িয়ে কিছুটা কম দামে ঈদের কেনাকাটা করা। উচ্চ মূল্যস্ফীতির বাজারে সংসার চালাতে হিমসিম খাওয়া এই গৃহকর্তা শত কষ্টের মাঝেও সন্তানদের ঈদ আনন্দ মাটি হতে দিতে চান না। ওই মার্কেটেই ঈদের কেনাকাটা করতে আসা হালিমা খাতুনও জানান একই কথা। মধ্যবিত্ত পরিবারের এই গৃহিণী জানান, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে শিক্ষা-স্বাস্থ্য ও খাদ্য-বস্ত্রসহ সব খাতে খরচ বেড়ে যাওয়ায় স্বামীর বেতনের টাকায় সংসার চালানো দায়। গত কয়েক মাসে বেশকিছু ধার-দেনা করতে হয়েছে। ঈদ বোনাসের টাকায় সে ঋণ শোধ করার পরিকল্পনা রয়েছে। অথচ শিশু-কিশোর সন্তানদের নতুন জামা-কাপড়, জুতা না দিলে ঈদ আনন্দ ম্স্নান হয়ে যাবে। তাই নিউ মার্কেটের খোলা চত্বরের দোকানে এসেছেন কিছুটা কম দামে পোশাক-পরিচ্ছদ কিনতে। শুধু আফজাল হোসেন কিংবা হালিমা খাতুনই নয়, লাখ লাখ মধ্যবিত্ত মানুষ ঈদ কেনাকাটা সারতে ভিড় জমাচ্ছেন নিম্নবিত্তের বাজারে। ফলে সেখানে ক্রেতার সমাগম বেড়েছে। সুযোগ বুঝে বিক্রেতারা তাদের পণ্যের চড়া দাম হাঁকাচ্ছেন। তবে দর কষাকষি শেষে কিছুটা লাভ পেলেই বেশিরভাগ দোকািিন ঈদকে কেন্দ্র করে দোকানে তোলা নতুন মালামাল বিক্রি করে দিচ্ছেন। তাদের আশঙ্কা, সংসার চালাতে নাভিশ্বাস ওঠা নিম্নবিত্তের বিপুলসংখ্যক মানুষ এবার ঈদ কেনাকাটা থেকে দূরে থাকবে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ঈদের মোট বেচাকেনা আগের চেয়ে কম হবে। তাই ঈদের পোশাক-পরিচ্ছদ এখুনি বিক্রি না করে ধরে রাখলে শেষ সময় বড় হোঁচট খাওয়া লাগতে পারে। যদিও কোনো কোনো দোকানি ঝুঁকি নিয়ে চড়া দামেই ঈদ পণ্য বিক্রির 'খুট্টি' ধরে রয়েছেন। নিম্নবিত্তের বাজারে মধ্যবিত্তরা ভিড় করায় স্বল্প আয়ের মানুষ নতুন করে বিপাকে পড়েছেন। এমনিতেই সবকিছুর দাম বাড়ায় ঈদের কেনাকাটা তাদের পক্ষে অনেকটা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ওপর মধ্যবিত্তদের ভিড়ে বিক্রেতারা বাড়তি দাম হাঁকায় দর কষাকষি করে যে কোনো জিনিস কিনতে আগের চেয়ে বেশি সময় লাগছে। যা তাদের কাছে 'গোদের ওপর বিষফোঁড়া' হয়ে উঠেছে। এদিকে নিম্নবিত্তের ঈদ বাজারে মধ্যবিত্তের ভিড় বাড়ার এ বিষয়টি ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের ভাষ্য, মধ্যবিত্তদের একটি অংশ শুধু নিম্নবিত্তের বাজার থেকে ঈদ কেনাকাটাই নয়, খাদ্যসহ জীবন ধারনের সব ধরনের পণ্যই সেখান থেকে কিনছে। কারণ, মূল্যস্ফীতির চাপে পরোক্ষভাবে তাদের আয় কমে গেছে। এ ছাড়া নতুন করে লাখ লাখ মানুষ মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নবিত্তের কাতারে নেমে এসেছে। যার পরিসংখ্যান এখনো অজানা। অন্যদিকে বাজার পর্যবেক্ষকদের ধারণা, এবারের ঈদের পোশাক-পরিচ্ছদ থেকে সবকিছুর দামই ৩০-৪০ শতাংশ বেড়েছে। সে তুলনায় মধ্যবিত্তের আয় বাড়েনি। তাই শখ ও সামর্থ্যের সমন্বয় করতে গিয়ে তারা নিম্নবিত্তের বাজারে ভিড় করছে। নিম্নবিত্তের সৌখিন মার্কেট হিসেবে খ্যাত রাজধানীর তালতলা মার্কেটে শুক্রবার সকালে দুই মেয়েকে নিয়ে ঈদ কেনাকাটা করতে এসেছিলেন গার্মেন্টকর্মী বিবি আলেয়া। তবে পছন্দের সঙ্গে সামর্থ্যের সমন্বয় না হওয়ায় ঘণ্টা দুয়েক ঘুরে কিছুই কিনতে পারেননি। মার্কেটে দীর্ঘ সময় হেঁটে শিশু সন্তানরা ক্লান্ত হয়ে পড়ায় গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে খালিহাতে বাড়ি ফিরেছেন স্বামী পরিত্যক্তা এই নারী। আলেয়া জানান, ঈদে সন্তানদের জন্য নতুন জামা-কাপড়, জুতা, চুড়ি-ফিতা ও লিপিস্টিকসহ কিছু কসমেটিক কেনার জন্য গত দুই মাসে খাবারের বাজেট কাটছাঁট করে হাজার তিনেক টাকা জমিয়েছিলেন। আশা ছিল, এই টাকা দিয়েই ঈদের কেনাকাটা সারতে পারবেন। কিন্তু ঈদ মার্কেটে এসে তার সে ভুল ভেঙেছে। পছন্দ অনুযায়ী, এসব জিনিস কিনতে নূ্যনতম সাড়ে চার হাজার টাকা লাগবে। তাই আগামী মাসের বেতন পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। একই সংকটে পড়েছেন খিলগাঁও গালর্স স্কুলে আয়ার চাকরি করা জরিনা খাতুন। তিনিও কোনোভাবে পরিবারের ঈদ কেনাকাটায় স্বাদ আর সাধ্যির সমন্বয় করতে পারেননি। তাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বড় ছেলের জামা-জুতা কেনার বাজেট পুরোপুরি বাদ দিয়ে ছোট মেয়ের জন্য ফ্রক, কিছু কসমেটিক ও চামড়ার স্যান্ডেল কিনেছেন। খিলগাঁওয়ের তালতলা মার্কেটের দোকানি সোহাগ মিয়া জানান, তিনি ৭-৮ বছর থেকে এই মার্কেটে দোকানদারি করছেন। নিম্ন আয়ের মানুষই মূলত তাদের ক্রেতা। তবে এবার বিপুলসংখ্যক মধ্যবিত্ত পরিবার ঈদ কেনাকাটা করতে এই মার্কেটটিতে ভিড় জমাচ্ছে। রাজধানীর বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির বাজারে সংসার চালাতে নাভিশ্বাস ওঠা নিম্ন আয়ের বেশিরভাগ মানুষেরই ঈদ কেনাকাটার আনন্দ পুরোপুরিই উবে গেছে। সংসারের বিভিন্ন খাতের বাজেট কাটছাঁট করেও তারা পরিবারের শিশু-কিশোর সদস্যদের ঈদ কেনাকাটা সারতে ব্যর্থ হচ্ছেন। এই পরিস্থিতিতে অনেকে গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামর্থ্যবান বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজন কিংবা সহকর্মীদের কাছ থেকে ধার-দেনা করে সন্তানদের ঈদের খুশি ধরে রাখার চেষ্টা করেছেন। বাজার-সংশ্লিষ্টরা জানান, ঈদবাজারে মূল্যস্ফীতির প্রভাব শুধু বিত্তশালী কিংবা মধ্যবিত্তের পণ্যেই নয়, নিম্নবিত্তের জামা-কাপড়, জুতা-স্যান্ডেল, কসমেটিকসহ সবকিছুতেই পড়েছে। ফলে নামিদামি শপিংমল, বিপণী-বিতান ও মার্কেটগুলোতে ১০ রোজা পার হওয়ার আগেই বেচাকেনা জমে উঠলেও নিম্নবিত্তের ভরসা ছোট মার্কেট ও ফুটপাতে ভিন্ন চিত্র বিরাজ করছে। দোকানিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ছোট মার্কেট ও ফুটপাতের দোকানগুলোতে আগে শুধুমাত্র নিম্ন আয়ের মানুষ ঈদ কেনাকাটা করলেও এবার সেখানে ভিন্ন দৃশ্যের দেখা মিলছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণির অনেকেই সারা বছর সাধারণ মার্কেট থেকে পোশাক-পরিচ্ছদ কিনলেও ঈদের আগে নামিদামি শপিংমল ও বিপণী-বিতান থেকে নিউ ফ্যাশনের শখের জিনিসপত্র কিনেন। কিন্তু এবার তারা সে পথ বিমুখ হওয়ায় সবাইকে নতুন হিসাব কষতে হচ্ছে। এদিকে শুক্রবার ও শনিবার রাজধানীর ধানমন্ডি হকার্স মার্কেটসহ বেশকিছু ছোট মার্কেট ও ফুটপাতের দোকানগুলো ঘুরে দেখা গেছে, নিম্নবিত্তের এসব বাজারে এক-তৃতীয়াংশই মধ্যবিত্ত ক্রেতা। তাদের পোশাক-পরিচ্ছদ দেখা ও কথাবার্তা শুনে যা স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে। তাদের অনেকে দায় পড়ে সন্তানদের জন্য নিম্নবিত্তের বাজারে ঈদ কেনাকাটা করতে আসার কথা নিঃসংকোচে স্বীকারও করেন। ধানমন্ডি হকার্স মার্কেটে ঈদের কেনাকাটা করতে এসেছেন পঞ্চাশোর্ধ্ব গোলাম মোস্তফা। তিনি সবুজবাগের বাসাবো এলাকার বাসিন্দা। আগে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করলেও এখন কর্মহীন তিনি। পরিবারে উপার্জনাক্ষম কেউ না থাকায় বেশকিছু দিন ধরে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। কিন্তু কারও কাছে হাত পাততে পারছেন না। অথচ এই দুঃসময় দীর্ঘদিন পর গ্রাম থেকে আসা ছোট ভাইকে ঈদের জন্য কিছু কিনে না দিয়ে ঘরে চুপ করে বসে থাকতে পারেননি। তাই ৫০০-৭০০ টাকার মধ্যে একটি জিন্সের প্যান্ট এবং ৩০০-৪০০ টাকার মধ্যে একটি শার্ট কিনে দেওয়ার টার্গেট নিয়ে এই মার্কেটে এসেছেন। কিন্তু দীর্ঘসময় ধরে খোঁজাখুঁজি করে এই বাজেটের মধ্যে কিছুই কিনতে পারেননি। এই মার্কেটের দোকানি রহমত আলী জানান, সাধারণ সময় মধ্যবিত্তরা অনেকে টি-শার্ট, মেয়েদের ঘরে পড়া জামা-কাপড় সেখান থেকে কিনলেও ঈদ কেনাকাটায় তাদের খুব বেশি দেখা যায়নি। কিন্তু এবার ৭-৮ রোজা পার হওয়ার পর থেকেই এই মার্কেটে তাদের ভিড়ই বেশি। অনেকেই স্ত্রী-সন্তানসহ পুরো পরিবারের জন্য এই মার্কেট থেকে ঈদের কেনাকাটা করছেন। আরামবাগ এলাকার ফুটপাতের পোশাক বিক্রেতা মজনু মিয়া জানান, তিনি মূলত নিম্ন আয়ের মানুষদের পোশাক বিক্রি করেন। মধ্যম আয়ের ক্রেতারা কালেভদ্রে সেখানে আসেন। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে বিপুলসংখ্যক মধ্যবিত্ত মানুষ ফুটপাতের পোশাক কিনতে ভিড় জমাচ্ছেন। যদিও তাদের কেউ কেউ বলছেন, গ্রামের দরিদ্র আত্মীয়স্বজনের জন্য তারা এসব কম দামি কাপড় কিনছেন। যাতে বেশিসংখ্যক মানুষকে তা দেওয়া যায়। ওই দোকানির এই অনুমান যে অমূলক নয়, তা ঈদের কেনাকাটা করতে আসা মধ্যবিত্ত শ্রেণির অনেকের সঙ্গে কথা বলে স্পষ্ট হওয়া গেছে। রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলম জানান, কয়েক বছর আগেও আর্থিকভাবে তিনি যথেষ্ট স্বচ্ছল ছিলেন। তবে মূল্যস্ফীতির চাপে রেস্টুরেন্টে আগের মত সাধারণ ক্রেতার ভিড় নেই। ফলে তার ব্যবসাতেও মন্দা চলছে। এর ওপর প্রতিটি খাতে নিজের খরচ বেড়েছে। এ অবস্থায় ইচ্ছা থাকলেও আগের মতো গ্রামের বাড়ির সবার জন্য ভালো মানের কাপড়-চোপড় কেনা সামর্থ্যে কুলাচ্ছে না। অথচ তাদের সবাই তার দেওয়া ঈদের পোশাকের জন্য অপেক্ষা করে আছেন। তাই এবার বাধ্য হয়ে ফুটপাতে এসেছেন সবার জন্য জামা-কাপড় কিংবা জুতা কিনতে। মটর পার্টস ব্যবসায়ী শহিদুল আলমেরও একই অবস্থা। প্রতিবছর তিনি পরিবারের সবার জন্য নিউ মার্কেট থেকে ঈদের কেনাকাটা করতেন। এবারও নিউ মার্কেটে এসেছেন। তবে নিউ মার্কেটের পাশের ফুটপাত থেকে কেনাকাটা করছেন। তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি ও ডলার সংকটের কারণে বেশকিছুদিন ধরে গাড়ির পার্টসের ব্যবসা মন্দা চলছে। তাই লাভের অংক খুবই সামান্য। এরপরও গ্রামে খালি হাতে যেতে পারবেন না। তাই ফুটপাত থেকে কেনাকাটা করছেন।