বুধবার, ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ২০ কার্তিক ১৪৩১

ঈদের পাইকারি বাজারেও মন্দা!

সাখাওয়াত হোসেন
  ২৪ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
রাজধানীর ইসলামপুরের পাইকারি কাপড়ের মার্কেট

প্রতিবছর রমজান শুরুর আগেই পোশাক, জুতা ও প্রসাধনীসহ ঈদকেন্দ্রিক সব পণ্যের পাইকারি বিক্রি জমে উঠলেও এবারের চিত্র অনেকটাই ভিন্ন। রোজার এক-তৃতীয়াংশ শেষ হতে চললেও ঢাকাসহ দেশের বেশির ভাগ পাইকারি বাজারেই এখনো চলছে বছরের অন্যান্য সময়ের মতো টুকটাক বেচাকেনা। নেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাইকারি দরে বড় চালানের মাল কিনতে আসা দোকানিদের ভিড়। এতে পাইকারি ব্যবসায়ীরা চরম দুশ্চিন্তায় পড়েছেন।

বাজার সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, পাইকারি বিক্রিতে এ মন্দা চলমান থাকলে ঈদের খুচরা কেনাকাটায় এর বড় প্রভাব পড়বে। ছোট-বড় শপিংমল, বিপণিবিতান ও মার্কেট থেকে জামা-কাপড়, জুতা, ব্যাগ ও কসমেটিকসহ অন্যান্য ঈদপণ্য আগের চেয়ে অনেক বেশি দামে কিনতে হবে। যে ধাক্কা সামাল দেওয়া নিম্নমধ্যবিত্তের পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। এসব পণ্যের দোকানিদের সারা বছরের মোট বেচাকেনার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশই যেহেতু শুধু ঈদুল ফিতরের সময় হয়ে থাকে, সেহেতু তাদের অনেকের ব্যবসায় বড় ধস নামবে। পাশাপাশি ঈদকেন্দ্রিক কেনাকাটায় দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি চাঙ্গা হওয়ার পথও রুদ্ধ হবে।

অর্থনীতিবিদ ও বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, মূলত সার্বিক মূল্যস্ফীতি, ডলার দাম বাড়ায় আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি, এলসি খুলতে না পারা, মানুষের হাতে পর্যাপ্ত টাকা না থাকায় ভর মৌসুমে জমে ওঠেনি ঈদকেন্দ্রিক পাইকারি বেচাকেনা। এ পরিস্থিতিতে পাইকারি ব্যবসায়ীরা ঈদকে টার্গেট করে যে পরিমাণ মাল মজুত করেছেন, তার অর্ধেকও বেচতে পারবেন কিনা তা নিয়ে শঙ্কিত তারা।

দেশীয় পোশাকের পাইকারি বিক্রেতারা বলছেন, তিন দফায় পাইকারি বাজারে ভিড় থাকে। প্রথমত, শবেবরাতের পরের সপ্তাহে, দ্বিতীয়ত রোজার দ্বিতীয় সপ্তাহে এবং ২০ রোজার পর। তবে সাধারণত ১০ রোজার মধ্যেই পাইকারি বাজার প্রায় পুরোটাই খালি হয়ে যায়। ভিড় শুরু হয় খুচরা বাজার ও মার্কেটগুলোতে। তবে এবার শবেবরাতের পরের সপ্তাহে ঈদের পোশাক যে পরিমাণ বিক্রি হয়েছে তা হতাশাজনক। রোজার দ্বিতীয় সপ্তাহ শুরু হলেও এখনো বাজারে সেভাবে পাইকারদের ভিড় জমে ওঠেনি। বেশির ভাগ পাইকারি দোকানে ১০ থেকে ১৫ শতাংশের বেশি পোশাক বিক্রি হয়নি, যা পাইকারি ব্যবসায়ীদের বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, অভ্যন্তরীণ পোশাকের সবচেয়ে বড় জোগানদার ইসলামপুরসহ পুরান ঢাকার পোশাক মার্কেটগুলো। ঢাকার বিভিন্ন মার্কেটসহ দেশের বিভাগীয়, জেলাসহ মফস্বল মার্কেটগুলোয় দেশি পোশাক সরবরাহ হয় এখান থেকে। এখানকার অর্ধসহস্রাধিক পোশাকের দোকানে হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হয়। শবেবরাতের পর থেকে জমজমাট থাকে পাইকারি এ মার্কেটটি। এ সময় পাইকারি ক্রেতাদের ভিড়ে ওই এলাকার রাস্তায় হাঁটার সুযোগ থাকে না।

ভোক্তাদের পছন্দের দিকে খেয়াল রেখে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা দোকানি ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা রেয়ন মসলিন, রেয়ন কটন, লিনেন, সাটন ডিসকটসহ বিভিন্ন উন্নত মানের শাড়ি, থ্রিপিস, লুঙ্গি ও থান কাপড় সংগ্রহ করেন। কিন্তু এবার যেন কোনোভাবেই পোশাকের এ পাইকারি বাজারটি জমে উঠছে না।

ইসলামপুরের পোশাকের পাইকারি বিক্রেতা স্টাইল ফ্যাশনের স্বত্বাধিকারী হাজি ফয়সাল জানান, গুদাম ভরা থ্রিপিসসহ ঈদের জামা-কাপড়। এতদিনে তিন ভাগের দুইভাগ মাল বিক্রি হওয়ার কথা। কিন্তু এখনো কিছুই বিক্রি হয়নি। ঈদের আগে এর ৭০ শতাংশ বিক্রি হবে কিনা তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। মাল বেচতে না পারলে ব্যাংক ঋণ, থান কাপড়ের টাকা শোধ, দর্জির খরচ, কাঁচামালের খরচ, গোডাউন ভাড়া, কর্মচারীর মজুরি দেওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।

মঙ্গলবার দুপুরে ইসলামপুরের বিক্রমপুর গার্ডেন সিটি, গুলশানআরা সিটি কমপেস্নক্স, চায়না মার্কেট, নবাববাড়ী মার্কেট, ইসলামপুরের হাজি শরফুদ্দিন ম্যানশন, হাজি ইউসুফ ম্যানশন, আমানউলস্নাহ কমপেস্নক্স, লতিফ টাওয়ার, এ মাবুদ রাইন টাওয়ার, লায়ন টাওয়ার, মদিনা ভবন, হাজি শামসুদ্দিন ম্যানশন, হালিম পস্নাজা, সোনার বাংলা মার্কেটসহ আশপাশের ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো ঘুরে দেখা গেছে, পাইকারি ক্রেতা সমাগম নেই বললেই চলে। বেশির ভাগ দোকানে বিক্রয়কর্মীরা অলস সময় কাটাচ্ছেন।

এদিকে গ্যাস-বিদু্যৎ এবং সুতাসহ কাপড় তৈরির কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশীয় সব ধরনের কাপড়ের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। এর ফলে বেড়েছে সব ধরনের কাপড়ের দামও। যার প্রভাব পড়েছে দেশের বৃহত্তম পাইকারি কাপড়ের বাজারে। ভরা মৌসুমেও বেচাকেনা মন্দা বাবুর হাটে।

সেখানকার কাপড় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ও পাইকারি ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিবছর শবেবরাতের পর থেকে পাইকারি ক্রেতার ভিড়ে মুখর হয়ে ওঠে নরসিংদীর এই শেখের চর-বাবুরহাট কাপড়ের বাজার। সকাল থেকে রাতঅবধি টানা চলে বেচাকেনা। শাড়ি, লুঙ্গি, থ্রিপিস, শার্টপিস, প্যান্টপিসসহ গজ কাপড় কিনতে দেশের নানা প্রান্তের মানুষ ছুটে আসেন এ হাটে। রোজার ঈদে জাকাতের শাড়ি, লুঙ্গি বেশি বেচাকেনার আশায় বসে আছেন বিক্রেতারা। তবে এখনো ক্রেতাদের তেমন দেখা নেই।

ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, দেশীয় সব ধরনের কাপড়ের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় সব ধরনের কাপড়ের দামও বেড়েছে। এ ছাড়া নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় সাধারণ মানুষকে নিত্যপণ্য কিনতে হিসাব করতে হচ্ছে। এ কারণে ঈদ ঘিরে কাপড়ের ক্রেতা এবার খুবই কম।

পাইকারি ব্যবসায়ীদের ভাষ্য, খুচরা বাজারে কাপড়ের বেচাকেনা কম হওয়ার প্রভাব পড়েছে পাইকারি বাজারগুলোতেও। দাম বাড়ায় পাইকারি ও খুচরা কাপড় ক্রেতা-বিক্রেতাদের পুঁজি বিনিয়োগ করতে হচ্ছে কয়েকগুণ বেশি।

এদিকে একই অবস্থা ঢাকার গুলিস্তানের জুতার পাইকারি মার্কেটেও। রমজানের শুরুর আগেই সেখানকার দোকানগুলোতে হাজার হাজার পিস জুতা মজুত করা হয়েছে। সারা বছরের মোট বিক্রির ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ রোজার ঈদকে কেন্দ্র করে বিক্রি হবে সবাই এমনটাই আশা করেছেন। ঈদে ৪ হাজার কোটি টাকার জুতা বিক্রির টার্গেট নিয়েছেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা। তবে রোজা শুরুর পর সপ্তাহ পার হলেও এখনো মন্দা দশা কাটেনি।

লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা বলেন, দেশে বর্তমানে ৬ থেকে ৭ হাজার কোটি টাকার জুতার বাজার রয়েছে। তবে এবারের ঈদেই ৪ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হবে, পাইকারি ব্যবসায়ীরা এমনটাই আশা করেছিলেন। তবে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ও সাধারণ মানুষের হাতে টাকা না থাকায় এ টার্গেট পূরণ হওয়ার আশা একেবারেই ক্ষীণ। যার আলামত এরই মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

ফুলবাড়িয়া সিটি সুপার মার্কেটের পাইকারি জুতা ব্যবসায়ী শহিদুল ইসলাম জানান, প্রতিবছর শবেবরাতের পর থেকেই পাইকারি ক্রেতাদের প্রচন্ড চাপ থাকে। তবে এবারের চিত্র পুরোটাই উল্টো। এ অবস্থায় পাইকারি ব্যবসায়ীদের প্রত্যাশার ৭০ শতাংশ পূরণ হবে কিনা তা নিয়ে তারা নিজেরাই সন্দিহান।

পাইকারি জুতা ব্যবসায়ী জাহিদুর রহমান জানান, ডলার সংকট ও এলসি সমস্যার কারণে এবার জুতা কম আমদানি করতে পেরেছেন। এছাড়া ডলারের দাম আকাশচুম্বী হওয়ায় মূলধন অনুযায়ী আগের মতো পর্যাপ্ত জুতা আমদানি করা সম্ভব হয়নি। এতে নতুন সংকট সৃষ্টি হয়েছে।

এদিকে প্রতিবছর ঈদের আগে কয়েক কোটি টাকার ইমিটেশন জুয়েলারি ও বিভিন্ন প্রসাধনী সামগ্রী বিক্রি এবারের চিত্র ভিন্ন। ১০ রোজা পার না হওয়ার আগেই প্রতিবছর এ সময় লক্ষ্যমাত্রার তিন-চতুর্থাংশ পণ্য বিক্রি শেষ হলেও এবার তার সিকিভাগও বিক্রি হয়নি। প্রতিবছর রোজা শুরুর পর সপ্তাহ পার হলেই ক্রেতাদের অর্ডার অনুযায়ী মাল দিতে গিয়ে তাদের দম ফেলার ফুসরত না থাকলেও এবার বেশির ভাগ পাইকারি বিক্রেতা ঢাকাসহ দূর-দূরান্তের ক্রেতার আশায় তীর্থের কাকের মতো পথ চেয়ে বসে আছেন।

চকবাজারের নিউ ভাই ভাই কালেকশনের স্বত্বাধিকারী জাকির হোসেন জানান, ঈদে বিক্রির টার্গেট নিয়ে তিনি প্রায় দেড় কোটি টাকার ইমিটেশন জুয়েলারি ও কসমেটিকস কিনে মজুত করেছেন। কিন্তু এখনো আশানুরূপ ক্রেতার সাড়া মেলেনি। ঈদের আগে টার্গেটের অর্ধেক মাল বিক্রি করতে পারবেন কিনা তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন।

চকবাজারের অপর এক ইমিটেশন ব্যবসায়ী নূরুল হুদা জানান, তার দোকানের বিক্রীত ইমিটেশনের জুয়েলারির মূল ক্রেতা গ্রামাঞ্চলের মানুষ। উৎসব এলেই সেখানে এসব পণ্যের চাহিদা বাড়ে। তাই ঈদকে সামনে রেখে ৮০ লাখ টাকার মাল দোকানে তুলেছেন। কিন্তু সেখানকার পাইকারি ব্যবসায়ীরা এখনো আশানুরূপভাবে ঢাকায় আসেননি। এ পরিস্থিতি চলমান থাকলে তাদের বড় অঙ্কের গচ্চা যাবে বলে আশঙ্কা করছেন এই ব্যবসায়ী।

মঙ্গলবার পুরান ঢাকার চকবাজারের বিভিন্ন মার্কেট ঘুরে দেখা গেছে, ঘিঞ্জি এলাকায় সারি সারি দোকান। বিভিন্ন ধরনের পণ্য সাজিয়ে বসেছেন পাইকারি বিক্রেতারা। দোকানে থরে থরে সাজানো আছে মাথার ক্লিপ, ব্যান্ড, ব্যাগ, টুথব্রাশ, সাবান, শ্যাম্পু; পস্নাস্টিকের খেলনা, রবারের ক্রিকেট বল, রঙিন চশমা, জুতা, ফিতা ও পস্নাস্টিকের ছোট ছোট পণ্য। এছাড়া পাইকারিতে বিক্রি হচ্ছে মেয়েদের গলার হার, কানের দুল, হাতের চুড়ি, নাকের নথ, পায়েল, ব্রেসলেটসহ বিভিন্ন ধরনের ইমিটেশন জুয়েলারি। রাস্তার পাশের দোকানগুলোতে ঝুলছে বেলুন, বাঁশি, পিস্তল, বন্দুকসহ নানা রকমের খেলনা। লাটিম, গুলতি ও মার্বেলের মতো ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ খেলনাও বেশ কয়েকটি দোকানে সাজানো রয়েছে। তবে মার্কেটে ক্রেতার সংখ্যা একেবারেই হাতে গোনা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে