একাত্তরের অগ্নিগর্ভ মার্চের ২৪ তারিখ জেলা শহরগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে প্রতিরোধ আন্দোলন। এই দিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে সমাগত মিছিলকারীদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, 'আর আলোচনা নয়, এবার ঘোষণা চাই। আমরা সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ ঐক্যবদ্ধ। কোনো ষড়যন্ত্রই আমাদের দাবিয়ে রাখতে পারবে না।' ২৫ মার্চের মধ্যে সমস্যার কোনো সমাধান না হলে বাঙালি নিজেদের পথ বেছে নেবে বলেও উলেস্নখ করেন তিনি।
সংগ্রামী জনতার উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু আরও বলেন, 'আমি কঠোরতর সংগ্রামের নির্দেশ দেওয়ার জন্য বেঁচে থাকব কি না জানি না। দাবি আদায়ের জন্য আপনারা সংগ্রাম চালিয়ে যাবেন।'
এদিকে ২৩ মার্চ রাত থেকে এইদিন সকাল পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনারা সৈয়দপুর সেনানিবাসের পার্শ্ববর্তী বোতলাগাড়ী, গোলাহাট ও কুন্দুল গ্রাম ঘেরাও করে অবাঙালিদের সঙ্গে নিয়ে ব্যাপক হত্যাকান্ড চালায়। শহরে কারফিউ জারি করা হয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও অবাঙালিরা সম্মিলিতভাবে বাঙালিদের বাড়িঘরে আগুন দেয় এবং হত্যা অভিযান চালায়। হানাদার বাহিনীগুলোতে কমপক্ষে তিনশ' বাঙালি নিহত হন বলে জানা যায়।
অন্যদিকে মিরপুরে অবাঙালিরা সাদা পোশাকধারী পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতায় বাঙালিদের
বাড়িঘরের শীর্ষে ওড়ানো বাংলাদেশের পতাকা এবং কালো পতাকা নামিয়ে জোর করে তাতে আগুন দেয় এবং পাকিস্তানি পতাকা তোলে। রাতে বিহারিরা এখানে ব্যাপক বোমাবাজি করে আতঙ্কের সৃষ্টি করে।
রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী তার '৭১-এর দশ মাস' বইয়ে উলেস্ন্নখ করেছেন-এই দিনে ভুট্টো-ইয়াহিয়ার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক শেষে ভুট্টো বলেন, 'উই আর মেকিং সাম প্রগ্রেস।' এদিকে কোনো প্রকার নতি স্বীকার না করার সংকল্প পুনর্ব্যক্ত করেন বঙ্গবন্ধু। তিনি বলেন, 'কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া চলবে না। কোনো রক্তচক্ষু সহ্য করা হবে না।'
একাত্তরের এই দিনে দেশে শান্তিপূর্ণভাবে পতাকা উত্তোলন হলেও মিরপুরের ১০নং সেক্টরের একটি বাড়ির ওপর থেকে ভয়ভীতি দেখিয়ে পতাকা সরানো হয়। বোমা হামলা করা হয়। বাংলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক কাইউমকে ছুরিকাহত করে তার বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ভবনে আওয়ামী লীগ ও সরকারের মধ্যে উপদেষ্টা পর্যায়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। দুই ঘণ্টাব্যাপী এই বৈঠকে আওয়ামী লীগের পক্ষে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও ডক্টর কামাল হোসেন ছিলেন। বৈঠক শেষে তাজউদ্দীন আহমদ উপস্থিত সাংবাদিকদের জানান, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বক্তব্য প্রদান শেষ হয়েছে। এখন প্রেসিডেন্টের উচিত তার দিক থেকে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা।
তিনি বলেন, 'আজ প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টাদের স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, আলোচনা অনির্দিষ্টকাল চলতে পারে না। আওয়ামী লীগ আলোচনা আর দীর্ঘ করতে রাজি নয়।'
চট্টগ্রামে পাকিস্তানি সেনারা নৌ-বন্দরের ১৭নং জেটিতে নোঙর করা এমভি সোয়াত জাহাজ থেকে সমরাস্ত্র খালাস করতে গেলে প্রায় ৫০ হাজার বীরবাঙালি তাদের ঘিরে ফেলে। সেনাবাহিনীর সদস্যরা জাহাজ থেকে কিছু অস্ত্র নিজেরাই খালাস করে ১২টি ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়ার সময় জনতা পথরোধ করে। হানাদার বাহিনীর সেনারা ব্যারিকেড দেওয়া জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালালে শতাধিক শ্রমিক শহীদ হন।
রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী আরও উলেস্নখ করেছেন, চট্টগ্রাম সেনানিবাসের বাঙালি ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার এম আর মজুমদারকে ঢাকায় বদলি করে সেখানে ব্রিগেডিয়ার আনসারীকে কমান্ডার নিযুক্ত করে। এই দিন মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা ও মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি কুমিলস্না ও যশোর সেনানিবাস সফর করেন এবং ব্রিগেড কমান্ডারদের সঙ্গে বৈঠক করেন।
এই দিন ঢাকায় অবস্থানরত কাউন্সিলস মুসলিম লীগ, কাইয়ুম মুসলিম লীগসহ পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ৭ নেতা আকস্মিকভাবে করাচি রওনা দেন।
ঢাকা টিভি কেন্দ্রে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সেনারা টিভি কর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করলে সন্ধ্যা থেকে ঢাকা টিভির কর্মীরা সব ধরনের অনুষ্ঠান প্রচার থেকে বিরত থাকেন। অন্যদিকে এক বিবৃতিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করার উদ্দেশে সশস্ত্র বিপস্নবকে আরও জোরদারে জনগণের প্রতি আহ্বান জানান কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা।