জিম্মি জলদসু্যরাও ভারী অস্ত্র বসানো হয়েছে জাহাজে
প্রকাশ | ২৪ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
ইব্রাহিম খলিল, চট্টগ্রাম
ভারত মহাসাগর থেকে জিম্মি করা চট্টগ্রামের কবির গ্রম্নপের মালিকানাধীন এমভি আবদুলস্নাহ জাহাজে অবস্থান করা সোমালি জলদসু্যদের চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলা হয়েছে। ভূমি থেকে পাওয়া সহযোগিতার সব পথ বন্ধ করে দিয়েছে সে দেশের পান্টল্যান্ড পুলিশ।
অন্যদিকে এমভি আবদুলস্নাহর খুব কাছাকাছি অবস্থানে রয়েছে ইইউর যুদ্ধজাহাজ। যেখান থেকে এমভি আবদুলস্নাহর ওপর চক্কর কাটছে অ্যাটাক হেলিকপ্টার। ফলে জাহাজে থাকা জলদসু্যরা এখন উল্টো জিম্মি হয়ে পড়েছে এমভি আবদুলস্নাহয়।
আত্মসমর্পণ ছাড়া জলদসু্যদের আর কোনো উপায় নেই বলেও জানিয়েছে সে দেশের পান্টল্যান্ড পুলিশ। যদিও নিজেদের সুরক্ষায় জিম্মি জাহাজে বিমান বিধ্বংসী কামানের মতো ভারী অস্ত্র বসিয়েছে জলদসু্যরা।
সোমালিয়ার স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল পান্টল্যান্ডের নুগাল পুলিশ বিভাগের কমান্ডার মোহাম্মদ আলী আহমেদ মারদুউফ বিবিসি সোমালিকে এসব কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, এমভি আবদুলস্নাহ এখন সে দেশের জিফলের উপকূলীয় এলাকায় আছে।
তিনি বলেন, জলদসু্যদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন
করার জন্য আমরা পূর্বাঞ্চলে একটি অভিযান শুরু করেছি। যাতে তারা এই এলাকার ভূমি থেকে আর কোনো সহযোগিতা না পায়। আমরা এখন তীরে আছি। এছাড়া সমুদ্রের অংশে তারা আন্তর্জাতিক বাহিনীর ঘোরওয়ের মধ্যে আছে। তাই সেদিক থেকেও তারা বিচ্ছিন্ন। জাহাজ ও ক্রুদের বাঁচাতে যে কোনো অভিযানে অংশ নিতে তারা প্রস্তুত বলে জানান।
পুলিশ কমান্ডার মারদুউফ বিবিসি সোমালিকে আরো বলেন, জাহাজে থাকা জলদসু্যদের হাতে এখন দুটি বিকল্প পথ আছে। হয় তাদের পান্টল্যান্ড কর্তৃপক্ষের কাছে আত্মসমর্পণ করে কৃতকর্মের জন্য শাস্তি ভোগ করবে। নতুবা বিদেশি বাহিনী এমভি রুয়েন থেকে যেভাবে জলদসু্যদের ধরে নিয়ে গেছে, সেই পরিণতি ভোগ করতে হবে।
সোমালি জলদসু্যদের কাছে তিন মাসেরও বেশি বন্দি ছিল এমভি রুয়েন। এরপর ভারতীয় নৌবাহিনীর অভিযানে উদ্ধার হয় জাহাজটি। এ সময় গ্রেপ্তার হয় ৩৫ জলদসু্য। আন্তর্জাতিক আইন অনুসরণ করে ভারতে তাদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, পান্টল্যান্ড পুলিশ কয়েক দিন আগে একটি নৌযান জব্দ করে, যাতে করে আবদুলস্নাহ জাহাজে থাকা জলদসু্যদের জন্য খাত নামের এক ধরনের মাদক সরবরাহ করা হচ্ছিল। জলদসু্যদের যে দলটি আবদুলস্নাহকে দখল করে রেখেছে, সেই দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে দুজনকে গ্রেপ্তারও করেছে স্থানীয় পুলিশ।
এদিকে বৃহস্পতিবার গভীর রাতে সোমালি উপকূলে জলদসু্যদের হাতে জিম্মি এমভি আবদুলস্নাহর কাছেই একটি যুদ্ধজাহাজ মোতায়েনের কথা জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন নেভাল ফোর্স-ইইউএনএভিএফওআর এর আটলান্টা অপারেশন।
ইউরোপীয় এই বাহিনী বৃহস্পতিবার রাতে এক বার্তায় বলেছে, ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে দসু্যতার একাধিক ঘটনা ঘটেছে। তিনটি বাণিজ্যিক শহর জাহাজে হামলা হয়েছে। যার মধ্যে একটি এমভি আবদুলস্নাহ এখনো জলদসু্যদের নিয়ন্ত্রণে আছে। ওই এলাকায় আটলান্টা অপারেশনের যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন আছে।
মাইক্রোবস্নগিং সাইট এক্স এ ইইউএনএভিএফওআরের পোস্টের সঙ্গে যুক্ত একটি সংক্ষিপ্ত ভিডিওতে এমভি আবদুলস্নাহর অদূরে অপারেশন আটলান্টার যুদ্ধজাহাজটি অবস্থান করতে দেখা গেছে। এছাড়া আবদুলস্নাহর কাছাকাছি চক্কর দিচ্ছিল একটি হেলিকপ্টার।
পূর্ব আফ্রিকা উপকূলে জলদসু্যতা নির্মূলে কাজ করে যাওয়া ইউরোপীয় ইউনিয়ন নেভাল ফোর্স তাদের অপারেশন আটলান্টার অংশ হিসেবে এমভি আবদুলস্নাহর ওপর নজর রাখছে বলে শুরু থেকেই জানিয়ে আসছে। তাদের প্রকাশ করা তিনটি ছবির একটিতে অপারেশন আটলান্টার দুজন কমান্ডোকে এমভি আবদুলস্নাহর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখা গেছে। অন্য দুটি ছবির একটিতে এমভি আবদুলস্নাহর ওপর হেলিকপ্টার টহল দিতে এবং আরেক ছবিতে যুদ্ধ জাহাজটিকে দেখা গেছে।
এদিকে ইইউ জাহাজের উপস্থিতিতে এমভি আবদুলস্নাহ জাহাজের বিভিন্ন পাশে বিমান বিধ্বংসী অস্ত্র বসিয়েছে জলদসু্যরা। বন্দি ২৩ নাবিকের ওপর কড়াকড়িও আরোপ করছে সশস্ত্র জলদসু্যরা। ফাঁকা গুলি ছুড়ে নিজেদের অবস্থান জানান দিচ্ছে। ৩০ থেকে ৩৫ জন সশস্ত্র জলদসু্য জাহাজে সার্বক্ষণিক পাহারায় থাকছে। নাবিকদের কেবিনে থাকতে দেওয়া হচ্ছে না। একটি টয়লেট ব্যবহার করতে হচ্ছে সবাইকে। খাবার ও পানি ব্যবহার নিয়ে কষ্টে আছেন নাবিকরা। তবে এখনও পর্যন্ত সুস্থ আছেন সব নাবিক।
বুধবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ (সাবেক টুইটার) জলদসু্যদের বিমান বিধ্বংসী কামানের ছবি প্রকাশ করা হয়েছে। দ্য ডেইলি সোমালিয়া ও ভারতীয় বিমানবাহিনীর এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে এই ছবি প্রকাশ করা হয়। বিমান বিধ্বংসী অস্ত্রের ছবিটিতে দেখা যায়, কাপড় মুড়িয়ে সমুদ্রের দিকে তাক করে রাখা হয়েছে অস্ত্রটি।
এদিকে নাবিকদের নিরাপত্তা শঙ্কায় এমভি আবদুলস্নাহ উদ্ধারে কোনো অভিযান চায় না জাহাজটির মূল মালিক কোম্পানি চট্টগ্রামের কবির গ্রম্নপ। তারা জানায়, জলদসু্যরা তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে।
কবির গ্রম্নপের মিডিয়া এডভাইজার মিজানুল ইসলাম বলেন, 'জাহাজের নাবিকদের নিরাপত্তার স্বার্থে আমরা কোনো ধরনের সামরিক পদক্ষেপে সমর্থন করছি না। বাংলাদেশ সরকারেরও একই চাওয়া।'
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ বলেন, জলদসু্যদের হাতে ছিনতাই হওয়ার পর বেশ কয়েকবার অবস্থান বদলে বর্তমানে এমভি আবদুলস্নাহ জাহাজটি সোমালিয়ার পান্টল্যান্ড অঞ্চলের উপকূলের মাত্র দেড় নটিক্যাল মাইল দূরে অবস্থান করছে।
সম্প্রতি ভারতীয় নৌবাহিনী সোমালি জলদসু্যদের হাত থেকে একটি নৌযান এবং একটি বাণিজ্যিক জাহাজ উদ্ধারে পরপর দুটি সামরিক অভিযান চালায়। গত ১৬ মার্চ ভারতীয় নৌবাহিনী এমভি রুয়েনকে উদ্ধার করে। যেটি তিন মাসের বেশি সময় ধরে সোমালি জলদসু্যদের হাতে জিম্মি ছিল।
ওই জাহাজ ব্যবহার করে বিভিন্ন নৌযানে হামলা চালিয়ে আসছিল জলদসু্যরা। এমভি আব্দুলস্নাহকে ছিনতাইয়ের সময়ও জলদসু্যরা এমভি রুয়েনকে ব্যবহার করে থাকতে পারে বলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন নেভাল ফোর্সের ধারণা।
রয়টার্স সোমবার এক প্রতিবেদনে জানায়, ভারতীয় কমান্ডোরা জলদসু্যদের নিয়ন্ত্রণে থাকা মাল্টার পতাকাবাহী জাহাজ এমভি রুয়েনে অভিযান চালিয়ে ১৭ ক্রুকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করার পর এমভি আবদুলস্নাহয় অভিযানের পরিকল্পনা করছে।
ভারতীয় নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ আইএনএস তর্কশ এর আগে এমভি আবদুলস্নাহর কাছাকাছি পৌঁছেছিল। কিন্তু নাবিকরা সশস্ত্র জলদসু্যদের হাতে জিম্মি থাকায় সে সময় অভিযান চালানো থেকে বিরত থাকেন ভারতীয় নৌ সেনারা।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন নেভাল ফোর্স এর আগে আবদুলস্নাহর জিম্মি নাবিকদের উদ্ধারে অভিযান চালানোর প্রস্তাব দিলেও বাংলাদেশ সরকার তাতে সায় দেয়নি বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিটের সচিব খুরশেদ আলম জানিয়েছিলেন।
২০১০ সালে কবির গ্রম্নপের মালিকানাধীন জাহাজ এমভি জাহান মণিও সোমালি জলদসু্যদের কবলে পড়েছিল। মুক্তিপণ দিয়ে ১০০ দিন পর জাহাজ এবং নাবিকদের ফিরিয়ে আনা হয়েছিল সে সময়। এমভি আবদুলস্নাহকেও ছাড়িয়ে আনতে একইপথে হাঁটছে মালিকপক্ষ।
জাহাজটির মালিকপক্ষ চট্টগ্রামের কবির গ্রম্নপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান এসআর শিপিং লাইনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেরেুল করিম বলেন, গত বুধবার দুপুরে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে সোমালিয়ান জলদসু্যদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে।
এবার তারা জানিয়েছে মধ্যস্থতাকারী কোনো পক্ষ ছাড়াই তারা সরাসরি কথা বলবেন মালিক পক্ষের সঙ্গে। যদিও ২৩ মার্চ পর্যন্ত এ আলোচনার আর বিশেষ কিছু অগ্রগতি নেই। সমঝোতার বিষয়ে তারা কোনো ধরনের প্রস্তাব আমাদের দেয়নি। তাদের কোনো দাবি এখনো পর্যন্ত আমাদের জানানো হয়নি। আমাদের মূল লক্ষ্য হলো নাবিকদের সুস্থভাবে ফিরিয়ে আনা। এরপর জাহাজটি উদ্ধার করা।
তিনি বলেন, জলদসু্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার বিষয়টি কৌশলে এগোচ্ছে কবির গ্রম্নপের পক্ষ থেকে। সমঝোতার মাধ্যমেই এ সমস্যা নিরসনের চেষ্টায় রয়েছে শিল্পপ্রতিষ্ঠানটি। ফলে সরকারি বা ভারতীয় নৌবাহিনী ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের নৌবাহিনীর পক্ষ থেকে অভিযানের বিষয়ে তাদের সম্মতি নেই বলে জানিয়েছিল।
বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন বলেন, জলদসু্যরা যোগাযোগ করেছে এটা আমাদের জন্য ভালো খবর। এতে ২৩ নাবিক ও জাহাজটি উদ্ধারের পথ সুগম হলো। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সমাধান করা উত্তম। কিন্তু মুক্তিপণ ছাড়া সোমালিয়ান জলদসু্যদের কাছ থেকে জাহাজ ফিরিয়ে আনা বা নাবিকদের উদ্ধার করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। ফলে আন্তর্জাতিক নৌবাহিনীর অভিযানকে মালিকপক্ষের সমর্থন না করা খুবই যুক্তিসঙ্গত ছিল।
নৌবাণিজ্য দপ্তরের প্রিন্সিপাল অফিসার ক্যাপ্টেন সাব্বির মাহমুদ বলেন, সোমালিয়ান জলদসু্যরা যোগাযোগ করেছে। এখন মালিকপক্ষের উচিত তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে এ সমস্যার সমাধান করা। তবে জলদসু্যরা যেন বেইমানি না করে সেই সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
সূত্র মতে, গত বছরের নভেম্বর থেকে ভারত মহাসাগরে সোমালি জলদসু্যরা যে প্রায় দুই ডজন জাহাজে হামলা করেছে, তার মধ্যে সর্বশেষ দসু্যদের হাতে জিম্মি হয়েছে বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুলস্নাহ।
মোজাম্বিক রাজধানী মাপুতো থেকে ৫৫ হাজার টন কয়লা নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতের হামরিয়া বন্দরে যাওয়ার পথে গত ১২ মার্চ দুপুর দেড়টার দিকে ভারত মহাসাগরে জলদসু্যদের কবলে পড়ে ২৩ নাবিকসহ বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আবদুলস্নাহ। নাবিকদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয় মোবাইল, সঙ্গে থাকা ডলার। বন্ধ করে দেওয়া হয় জাহাজের ইন্টারনেট সংযোগও।
এর আগে ২০১০ সালে একই কোম্পানির এমভি জাহান মণি জাহাজ সোমালিয়ার জলসদসু্যরা ছিনতাই করেছিল। ওই সময় জাহাজে ২৫ ক্রু এবং ক্যাপ্টেনের স্ত্রীসহ মোট ২৬ ব্যক্তি ছিলেন। মুক্তিপণ দিয়ে ১০০ দিন পর জাহাজসহ তাদের দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল।