অগ্নিঝরা মার্চ

'পাকিস্তান দিবস' ভেঙে ওড়ে বাংলাদেশের পতাকা

প্রকাশ | ২৩ মার্চ ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ ছিল 'পাকিস্তান দিবস'। তবে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলনে উত্তাল পূর্ব বাংলার ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ঘোষিত ইশতেহারের মাধ্যমে আগেই জানিয়ে দেয়, এই দিনে বাংলাদেশের পতাকা উড়বে। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী আজকের দিনে প্রথমবারের মতো সারা দেশে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। একই সঙ্গে চলমান অসহযোগ আন্দোলনে নিহত শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সারা দেশে উত্তোলন করা হয় কালো পতাকা। এ দিন সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ধানমন্ডির বাসভবনে নিজ হাতে উত্তোলন করেন বাংলাদেশের পতাকা। এদিকে ন্যাপ (ভাসানী) এ দিনটি 'স্বাধীন পূর্ববঙ্গ দিবস' হিসেবে পালন করে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আজকের দিনে সাধারণ ছুটি পালিত হয়। পল্টন ময়দানে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ 'প্রতিরোধ দিবস' পালন করে। ১৯৭১ সালের আজকের দিনে ঢাকা পরিণত হয় পতাকার নগরীতে। ঢাকায় অবস্থিত বিভিন্ন দেশের কনসু্যলেট ভবনে বাংলাদেশের পতাকা উড়ানো হয়। যুক্তরাজ্যের ডেপুটি হাইকমিশন ও সোভিয়েত কনসু্যলেটে সকাল থেকেই বাংলাদেশের পতাকা উড়ছিল। এছাড়া চীন, ইরান, ইন্দোনেশিয়া, নেপাল তাদের নিজেদের পতাকার পাশাপাশি পাকিস্তানের পতাকা উড়িয়েছিল। শেষপর্যন্ত জনতার দাবির মুখে বাংলাদেশের পতাকা উড়াতে হয়েছিল। নামিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়েছিল পাকিস্তানের পতাকা। এছাড়া হাইকোর্ট, প্রধান বিচারপতির ভবন, ঢাকার সচিবালয়, ইপিআর ও রাজারবাগ পুলিশ লাইন, ঢাকা বেতার ভবন, টেলিভিশন ভবন, মুখ্য সচিবের বাসভবন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তোলন করা হয় বাংলাদেশের পাতাকা। তৎকালীন ছাত্রনেতা ও বাংলাদেশের চার খলিফার অন্যতম নূরে আলম সিদ্দিকী (প্রয়াত) আজকের দিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে উলেস্নখ করেন, 'আমার স্পষ্ট মনে আছে, বিউগল আর ড্রাম বাজিয়ে সুরের মূর্ছনায় জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করা হয়।' 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি' গানের সুর পল্টনে উপস্থিত সব মানুষের চিত্তকে উদ্বেলিত করছিল।' তার ভাষায়, 'এ দিন সত্যিকারের স্বাধীনতার স্বাদ পাচ্ছিল বাংলার দুর্জয় ও অকুতোভয় জনতা। মোস্তফা মহসীন মন্টু, খসরু, হাসানুল হক ইনু, ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগ ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক সম্মিলিতভাবে আস্তে আস্তে পতাকাটি আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তোলন করেন। এ সময় সামরিক কায়দায় মঞ্চে দন্ডায়মান স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের চার নেতাকে অভিবাদন প্রদান করা হয়। বঙ্গবন্ধুর প্রতিনিধি হিসেবে আমরা অভিবাদন গ্রহণ করি। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের চার নেতা মঞ্চে দাঁড়িয়ে ছিলাম। অনেক ব্রিগেড সাজানো হয়েছিল। একটির পর একটি ব্রিগেড অভিবাদন জানিয়ে মঞ্চ অতিক্রম করে পাশে অবস্থান নিচ্ছে, আরেকটি ব্রিগেড মঞ্চের দিকে মাথা বাঁকিয়ে অভিবাদন জানিয়ে প্যারেড করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছে।' রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী তার '৭১ এর দশ মাস' বইয়ে এই দিনের ঘটনাবলি সম্পর্কে উলেস্নখ করেন, বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে জনতার ঢল নামে। ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত মিছিলের পর মিছিল আসতে থাকে। সবার হাতে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা। বাম হাতে বাংলাদেশের পতাকা তুলে ধরে ডান হাত জনতার উদ্দেশে বাড়িয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, 'বাংলার মানুষ কারও করুণার পাত্র নয়। আপন শক্তির দুর্জয় ক্ষমতাবলেই তারা স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনবে।' বঙ্গবন্ধু বজ্রকণ্ঠে আরও বলেন, '৭ কোটি মানুষের মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চলবে। সংগ্রাম চলছে, সংগ্রাম চলবে। বিজয় আমাদের সুনিশ্চিত। ঐক্যবদ্ধ হও। প্রস্তুত হও। বাঙালিকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না ইনশাআলস্নাহ্‌।' বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা শেষে নিজে সেস্নাগান ধরেন 'জয় বাংলা। আমার দেশ তোমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ। জাগো জাগো, বাঙালি জাগো।' একাত্তরের এই দিন ঢাকা টেলিভিশনের বাঙালি কর্মীরা অভূতপূর্ব এক কাজ করেন। টেলিভিশনের অনুষ্ঠান এ দিন মধ্যরাত পেরিয়ে আরও ৯ মিনিট চলে। বাজেনি পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীত। এ দিন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বৈঠক হয়নি। তবে দু'জনের উপদেষ্টামন্ডলীর মধ্যে দুই দফা বৈঠক হয়। প্রথম বৈঠক দুপুর ১২টা থেকে এক ঘণ্টা এবং দ্বিতীয় বৈঠক সন্ধ্যা ৬টা থেকে দুই ঘণ্টা চলে। এতে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও ড. কামাল হোসেন। ইয়াহিয়ার পক্ষে ছিলেন বিচারপতি এ আর কর্নেলিয়াস, লেফটেন্যান্ট জেনারেল পীরজাদা, এম এম আহমদ ও কর্নেল হাসান।