ভাঙাচোরা যানও ঈদযাত্রায় প্রস্তুত!
প্রকাশ | ২৩ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
সাখাওয়াত হোসেন
এবারের ঈদযাত্রায় কোনোভাবেই ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলতে দেওয়া হবে না- হাইওয়ে পুলিশের এমন হুঁশিয়ারির পরও থেমে নেই লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা বাস জোড়াতালি মেরামত ও রংচং দিয়ে খোলস বদলানোর কাজ। আমিনবাজার বেড়িবাঁধ, মানিকগঞ্জ, সাভার, নারায়ণগঞ্জ, টঙ্গীসহ ঢাকার উপকণ্ঠ এলাকার বিভিন্ন ওয়ার্কশপে রীতিমতো পালস্না দিয়ে এ কাজ চলছে। ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের বিভিন্ন ডকইয়ার্ডে শ্রমিকরা ব্যস্ত পুরানো ও ভাঙাচোরা লঞ্চ রং করার কাজে।
এদিকে, এ ধরনের অপতৎপরতায় বরাবরের মতো এবারের ঈদযাত্রার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন পরিবহণ বিশেষজ্ঞরা। ঈদযাত্রায় দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি কমাতে ফিটনেসবিহীন লক্কড়-ঝক্কড় যানবাহন চলাচল বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেন তারা। সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, দেশে গণপরিবহণ সংকটের সুযোগ কাজে লাগিয়ে, একসঙ্গে লাখও যাত্রী ঈদযাত্রার বহরে পথে নামার সুযোগ নিয়ে কতিপয় অসাধু পরিবহণ মালিক প্রতি বছর ঈদে ফিটনেসবিহীন বাস ও লঞ্চ রংচং করে চলাচলের উপযোগী করে। এসব যানবাহন মাঝপথে দুর্ঘটনায় পতিত হলে অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি ঘটে। পথে দীর্ঘ যানজটে ভোগান্তি তৈরি হয়। তাই ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলাচল বন্ধে শুধু হুমকি-ধামকি না দিয়ে বরং কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে ঈদযাত্রা নিরাপদ করা জরুরি- যোগ করেন পরিবহণ বিশেষজ্ঞরা।
গত কয়েকদিনে কেরানীগঞ্জের তেলঘাট থেকে মীরেরবাগ পর্যন্ত প্রায় ২৫টি ডকইয়ার্ডের মধ্যে ৮/৯টি ঘুরে দেখা গেছে, ঈদ সামনে রেখে সেখানে ভাঙাচোরা, রংচটা কিংবা অচল লঞ্চগুলো মেরামত করে সচল করার চেষ্টা চলছে। শ্রমিকরা জানান, এসব লঞ্চ ২০/২২ রোজার মধ্যে মালিকদের ডেলিভারি দিতে হবে। তাই দিন-রাতের দু'শিফটে তারা কাজ করছেন। এসব লঞ্চের কোনোটির ইঞ্জিনের কাজ করতে হচ্ছে, আবার কোনোটির বডিতে লোহার পাত ঝালাই করতে হচ্ছে। জং ধরে যাওয়া কাঠামোতে লাগাতে হচ্ছে রং। এভাবে পুরানো লঞ্চগুলো নতুন মোড়কে প্রস্তুত করতে হচ্ছে।
পরিবহণ সংশ্লিষ্টরা জানান, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর চাঁদপুর ছাড়া অন্য জেলাগুলোর নৌযাত্রীর হার প্রায় ২০ শতাংশ কমলেও এবারও ঈদযাত্রায় রাজধানীর সদরঘাট টার্মিনালে অস্বাভাবিক চাপ পড়বে। ঢাকাসহ আশপাশের জেলাগুলোর প্রায় ৩০ লাখ মানুষ নৌপথে বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বরগুনা, ভোলা, পটুয়াখালী, চাঁদপুর, শরীয়তপুর ও মাদারীপুরের উপকূলীয় এলাকায় যাবে। এর মধ্যে দৈনিক গড়ে ৩ লাখ করে ৯ দিনে অন্তত ২৭ লাখ মানুষ সদরঘাট হয়ে যাবে। বাকি ৩ লাখ মানুষ যাবে নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দর হয়ে।
কাগজে-কলমে ঢাকা থেকে বিভিন্ন গন্তব্যের নৌপথ ৪১টি। তবে তীব্র নাব্যসংকট ও যাত্রীস্বল্পতার কারণে বড় আয়তনের ও বিলাসবহুল লঞ্চ চলাচল না করায় অন্তত ১৫টি নৌপথ দৃশ্যত ইতোমধ্যে পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছে। বাকি ২৬টি নৌপথে প্রায় ৭০টি লঞ্চ নিয়মিত আসা-যাওয়া করে। ঈদের আগে লঞ্চের সংখ্যা বেড়ে ১৩০টি হবে। এর মধ্যে প্রতিদিন ৯০টি নৌযান সদরঘাট থেকে বিভিন্ন গন্তব্যের উদ্দেশে ছেড়ে যাবে এবং ৯০টি বিভিন্ন স্থান থেকে সদরঘাটে আসবে। এ হিসাবে প্রতিদিন ৯০টি লঞ্চে ৩ লাখ যাত্রী বহন করা হলে একটি লঞ্চে গড়ে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার (৩ হাজার ৩৩৩ দশমিক ৩৩ জন) যাত্রী উঠবে। কিন্তু কোনো লঞ্চেরই ২ হাজারের বেশি যাত্রী ধারণক্ষমতা নেই। অনেক লঞ্চের ধারণক্ষমতা ১ হাজারেরও নিচে। এর উপর জোড়াতালি মেরামতের লঞ্চগুলো নৌপথের যাত্রীদের কতটা নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে তা নিয়ে শঙ্কা রয়েই গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঈদ মৌসুমে যাত্রীর চাপ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় এ সময় অতিরিক্ত যাত্রীর লোভে কিছু অসাধু লঞ্চমালিক লক্কড়-ঝক্কড়, চলাচলে অনুপযোগী লঞ্চ সংস্কার ও রং করে চাকচিক্য করে তোলেন। অনেকে কয়েক বছর ধরে বসা লঞ্চও রংচং করে নদীতে ভাসান।
যদিও এ অভিযোগ স্বীকার করেছেন ডকইয়ার্ডে ওঠানো একাধিক লঞ্চের মালিক। তাদের ভাষ্য, দোতলা একটি লঞ্চ সংস্কার ও রং করতে চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা খরচ হয়। ঈদের আগে ওই লঞ্চটি নামাতে পারলে এক মৌসুমে পুরো খরচই উঠে আসে। কিন্তু অন্য সময় ওই টাকা ওঠানো অনেক কঠিন। তাই ঈদের মৌসুমেই সংস্কার করা হয়। ফিটনেসবিহীন, ভাঙাচোরা লঞ্চ মেরামত করে কিংবা রং করে ঈদের সময় নদীতে ভাসানোর প্রশ্নই আসে না।
এদিকে যায়যায়দিনের স্থানীয় সংবাদদাতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আমিনবাজার বেড়িবাঁধ, মানিকগঞ্জ, সাভার, নারায়ণগঞ্জ ও টঙ্গীসহ আশপাশের এলাকায় পুরানো বাস-মিনিবাস মেরামতের হিড়িক লেগেছে। ইঞ্জিনে ত্রম্নটি, বডির রং ও সিটকাভার পাল্টাতে ওয়ার্কশপের শ্রমিকরা নাওয়া-খাওয়া ভুলে কাজ করছেন। ওয়ার্কশপ থেকে সৌন্দর্যবর্ধন করে গাড়িগুলো রাস্তায় নামানোর পর এর কোনোটাই দেখে বোঝার উপায় নেই ক'দিন আগেই এগুলো লক্কড়-ঝক্কড় অবস্থায় বিভিন্ন গ্যারেজে কিংবা রাস্তার পাশে পড়ে ছিল।
সরেজমিন আমিনবাজার বেড়িবাঁধসহ আশপাশের বেশ কয়েকটি ওয়ার্কশপে দেখা গেছে, লক্কড়-ঝক্কড় বাসগুলোর মেরামতের কাজ চলছে। ফিটনেসবিহীন ভাঙাচোরা গাড়িগুলো ঝালাই করে জোড়াতালি দিচ্ছেন মিস্ত্রিরা। পুরানো গাড়ি মেরামতে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন তারা। কোনো গাড়ির ইঞ্জিন সড়ক দুর্ঘটনায় দুমড়ে-মুচড়ে গেছে, কোনো গাড়ির ব্রেক কিংবা গিয়ার বক্সে সমস্যা। আবার কোনোটির সিট ছিন্নভিন্ন; গাড়ির বডির রং নেই। এগুলো কোনোরকম জোড়াতালি দিয়ে মেরামত করে ২৫-২৬ রোজার মধ্যে সড়কে নামানো হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ওয়ার্কশপ মালিক এ প্রতিবেদককে জানান, বর্তমানে যেসব গাড়ি ওয়ার্কশপে মেরামত করা হচ্ছে সেগুলোর বেশিরভাগেরই ফিটনেস নেই। কিছু গাড়ি পুরোপুরি অচল অবস্থায় বিভিন্ন গ্যারেজে পড়ে ছিল।
ওয়ার্কশপের পুরানো গাড়ি মেরামতের কারিগর জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ঈদের সময় পুরানো গাড়ির কাজ সবচেয়ে বেশি। ইঞ্জিনে ত্রম্নটিসহ নানা সমস্যা নিয়ে মালিকরা গাড়িগুলো গ্যারেজে নিয়ে আসেন। সেগুলো মেরামত করে নতুনভাবে সাজিয়ে দিলে বোঝার উপায় থাকে না যে গাড়িগুলো অচল পড়ে ছিল।
এদিকে প্রতিবছর ঈদযাত্রায় রংচঙা ফিটনেসবিহীন যানবাহনের কারণে প্রাণঘাতী সড়ক দুর্ঘটনা ঘটলেও এ নিয়ে পুলিশ কিংবা বিআরটিএ কারোরই মাথা ব্যথা নেই। বিআরটিএ কর্মকর্তাদের ভাষ্য, ওয়ার্কশপগুলো তদারকি করা তাদের কাজ নয়। আর ফিটনেসবিহীন যানবাহন রাস্তায় নামলে ট্রাফিক ও হাইওয়ে পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, বিআরটিএর তথ্য অনুযায়ী ৫ লাখের মতো আনফিট গাড়ি রয়েছে। সেই ৫ লাখের সঙ্গে অ্যাক্সিডেন্টের গাড়িসহ মেরামতের গাড়িগুলো রাস্তায় নামানো হলে সবকিছু মিলে এক ভয়ংকর ঝুঁকি তৈরি হবে; যার অনিবার্য পরিস্থিতি হিসেবে প্রতি বছর ঈদযাত্রা নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ে। পরিবহণ সেক্টরে লাইসেন্স ও ফিটনেস প্রদান এবং নিবন্ধন পদ্ধতি ও মেরামত পদ্ধতিতেও ত্রম্নটি আছে। ঈদযাত্রায় সড়ক থেকে লক্কড় ঝক্কড় যানবাহন চলাচল বন্ধ করা গেলে এসময় সড়কে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি অনেকাংশে কমে আসবে বলে মনে করেন তিনি।
এদিকে আসন্ন ঈদের আগে পরে কোনোভাবেই ঝুঁকিপূর্ণ ও ফিটনেসবিহীন কোনো যানবাহন সড়কে চলতে দেওয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন হাইওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি মো. শাহাবুদ্দিন খান। তিনি বলেন, যারা অনিরাপদ যানবাহনে যাত্রী উঠাবেন তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ব্যাপারে হাইওয়ে পুলিশ জিরো টলারেন্স দেখাবে।
প্রসঙ্গত, গত বছর ঈদুল ফিতরের আগে-পরে ১৪ দিনে দেশে ২৪০টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৮৫ জন নিহত হন। আহত হন কমপক্ষে ৪৫৪ জন। ঈদযাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনার এ চিত্র তুলে ধরে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন জানায়, দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ৩৬ শতাংশের বেশি জাতীয় মহাসড়কে, ৩৪ শতাংশের বেশি আঞ্চলিক সড়কে, প্রায় ১৮ শতাংশ গ্রামীণ সড়কে এবং প্রায় ১১ শতাংশ শহরের সড়কে সংঘটিত হয়। সড়কে দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হিসেবে ত্রম্নটিপূর্ণ যানবাহনের কথা উলেস্নখ করে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন।
ওই বছরের ঈদুল আজহার ছুটিতে দেশের সড়ক-মহাসড়কে ২৭৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৯৯ জন নিহত এবং ৫৪৪ জন আহত হন।