বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪, ৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

টাঙ্গাইলে কিশোর গ্যাং 'ভয়ংকর'!

রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ হুমকিতে সামাজিক নিরাপত্তা
জোবায়েদ মলিস্নক বুলবুল, টাঙ্গাইল
  ২২ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
টাঙ্গাইলে কিশোর গ্যাং 'ভয়ংকর'!

টাঙ্গাইলে দিন দিন 'ভয়ংকর' হয়ে উঠছে কিশোর গ্যাং। তুচ্ছ ঘটনায় প্রায় প্রতিদিনই সংঘাত-সংঘর্ষে জড়াচ্ছে এরা। একই সঙ্গে নেশায় যুক্ত হওয়ায় বিস্তৃতি ঘটছে মাদকের। পার্ক বা নিরিবিলি স্থানে টিনএজ জুটি দেখলেই তাদের ওপর হামলে পড়ছে গ্যাংয়ের সদস্যরা। রাজনৈতিক, ব্যক্তিবিরোধ কিংবা আধিপত্য বিস্তারের বিবাদে জড়িয়ে ছিঁচকে অপরাধী থেকে হয়ে উঠছে খুনি অপরাধী। ফলে জেলায় অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধির পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তাও হুমকির মুখে পড়েছে। অভিযোগ উঠেছে, রাজনৈতিকভাবে এদের পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ারও।

জানা যায়, টাঙ্গাইল শহরেই গড়ে উঠেছে সাতটি কিশোর গ্যাং। গ্যাংয়ের সদস্যরা শহরের ক্যাপসুল মার্কেট, সবুর খান টাওয়ারের সামনের রাস্তা, ছয়আনি পুকুরপাড়, সরকারি বিন্দুবাসিনী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের পেছনের বড় পুকুরপাড়, শহিদ স্মৃতি পৌর উদ্যান, নজরুল সেনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনের রাস্তাসহ পুরো গলি, কেন্দ্রীয় ঈদগাঁ মাঠ, ঈদগাঁ মাঠের বাঁশ বাজার, পরিত্যক্ত ভাসানী হল চত্বর, জেলা সদরের ডিসি লেক, টাঙ্গাইল জেনারেল ও শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ এলাকা, বাসটার্মিনালসহ শহরের বিভিন্ন অংশে মিলিত হয়। পরে শহরজুড়ে বিকট শব্দে হর্ন বাজিয়ে মোটর সাইকেলের মহড়া দেয়। ঈদকে সামনে রেখে এরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। ছিনতাই তাদের নিত্যদিনের ঘটনা। যে কোনো ছলছুঁতোয় ধরে নিয়ে গিয়ে মারপিট করে টাকা-মোবাইল হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শহরের বিশ্বাস বেতকা, মীরের বেতকা ও সাবালিয়ার

একাংশের নিয়ন্ত্রণে একটি গ্যাং। ডিস্ট্রিক্ট গেট, ডিসি লেক, হাসপাতাল ও বাসটার্মিনাল এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে দ্বিতীয় গ্যাং। আদালতপাড়া, মাহমুদুল হাসান কলেজ, সমবায় মার্কেট, শামছুল হক মার্কেট, ভিক্টোরিয়া রোড, পৌর উদ্যানের একাংশ নিয়ন্ত্রণ করে তৃতীয় গ্যাং। এ গ্যাংয়ের মূল আড্ডাস্থল সবুর খান টাওয়ার এলাকা। পার্ক বাজার, ঈদগাঁ মাঠ, জেলা সদর রোড, বিন্দুবাসিনী স্কুল এলাকা, পৌর উদ্যানের একাংশ নিয়ন্ত্রণ করে চতুর্থ গ্যাং। ঈদগাঁহ মাঠের বাঁশ বাজারের নির্জন এলাকা এ গ্যাংয়ের মাদক সেবনের আড্ডস্থল। বাজিতপুর, মাঝিপাড়া, বিলুপ্ত মালঞ্চ সিনেমা হল এলাকা ও শান্তিকুঞ্চ মোড়ের একাংশ নিয়ন্ত্রণ করে পঞ্চম গ্যাং। বেপারীপাড়া, কাজীপুর ও শান্তিকুঞ্চ মোড়ের একাংশ নিয়ন্ত্রণ করে ষষ্ঠ গ্যাং। শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত একটি ফুডজোনের দোতলায় এ গ্যাংয়ের মাদক কেনাবেচা ও সেবনের কার্যক্রম চালানো হয়। থানাপাড়া, আলিয়া মাদ্রাসা মোড়, পতিতালয় এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে সপ্তম গ্যাং। এছাড়া আরও কয়েকটি ছোটখাট কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতাও লক্ষ্য করা যায়। এসব কিশোর গ্যাংয়ের আদলে জেলার ১১টি উপজেলা সদরসহ গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন এলাকায় শাখা কিশোর গ্যাংও গড়ে উঠেছে। তারা জেলা সদরের নির্দেশনা মেনে চলার চেষ্টা করে। এসব কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের বয়স ১৪ থেকে ২০ বছরের মধ্যে।

অভিযোগ আছে, শহরের ছয়টি কিশোর গ্যাংয়ের মূল নিয়ন্ত্রক পৌরসভার দু'জন কাউন্সিলরসহ সরকারদলীয় স্থানীয় কতিপয় নেতা, অপর একটির নিয়ন্ত্রক জেলা বিএনপির জনৈক নেতা। তবে তারা কখনও সামনে আসেন না। তাদের হয়ে ২২ থেকে ২৮ বছর বয়সি ৯ থেকে ১২ জন যুবক পৃথক গ্যাংগুলোর সরাসরি নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন।

কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ ও টেলিগ্রামে বিভিন্ন নামে গ্রম্নপ খুলে নিজেদের মধ্যে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করে। কোনো ঘটনা ঘটলে এসব গ্রম্নপের মাধ্যমে মুহূর্তেই সে খবর সদস্যদের কাছে পৌঁছে যায়। এসব গ্রম্নপের মাধ্যমে কোথায় কখন মিলিত হতে হবে, কী ধরনের 'অপারেশন' করতে হবে- এমন নির্দেশনাও সংশ্লিষ্ট গ্রম্নপের সদস্যরা পেয়ে থাকে।

সম্প্রতি শহরে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে কিশোর গ্যাংয়ের এক গ্রম্নপের সঙ্গে অন্য গ্রম্নপের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। ফলে প্রায় প্রতিদিন কিশোর গ্যাংয়ের বিভিন্ন গ্রম্নপের সদস্যদের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটছে। শহরবাসী যে কোনো সময় বড় ধরনের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের আশঙ্কা করছে।

গত ১৮ মার্চ রাতে তারাবিহ পড়ে ফেরার পথে নাগরপুর উপজেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জাহিদ হাসান খান ঝলক কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের হাতে খুন হন। মামলার পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ কিশোর গ্যাংয়ের তিন সদস্য রানা (২২), জিহাদ (১৯) ও ইমনকে (১৯) গ্রেপ্তার করে।

কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা মাদক সেবনেও যুক্ত হচ্ছে। শহরে মাদকাসক্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। মাদকের টাকা জোগাতে কেউ কেউ মাদক ব্যবসার সঙ্গেও যুক্ত হচ্ছে। শহরে মাদকের সংকট হলেই তারা মোটর সাইকেলযোগে মাদক সংগ্রহের জন্য শহরতলির গালা ইউনিয়নের মনতলা, মগড়া ইউনিয়নের ছোট বাসালিয়া, ঘারিন্দা রেলস্টেশন, সন্তোষ, অলোয়া জমিদার বাড়ির আশপাশ, রাবনা ও আশেকপুর বাইপাস এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে।

পবিত্র ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে শহরের কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। গ্রাম বা উপজেলা থেকে ঈদের মার্কেট করতে আসা ব্যক্তি, পরিবার ও টিনএজ জুটি তাদের লক্ষ্যবস্তু। তাদের আটকে রেখে বাড়ি থেকে বিকাশে টাকা এনে মোবাইল রেখে দেওয়া হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রেই ওইসব শিকাররা ভয়ে কিছু বলতে পারে না।

শহরের কলেজ গেট এলাকার হাতেম আলীর ছেলে মামুনকে গত ১৫ মার্চ শুক্রবার বিশ্বাস বেতকা এলাকার কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য পিয়াসের নেতৃত্বে গ্যাংয়ের সদস্যরা তুলে নিয়ে বেদম প্রহার করে। স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করে। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে চিকিৎসক তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়। সেখান থেকে চিকিৎসা নিয়ে তিনি বর্তমানে টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এ বিষয়ে আহতের মা মালেকা বেগম বাদী হয়ে টাঙ্গাইল সদর থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন।

১২ মার্চ মঙ্গলবার রাতে টাঙ্গাইল ফুটবল একাডেমির ছাত্র তরুণ ফুটবলার মো. সজিব হোসেন (১৮) শহরের সাবালিয়ায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের হাতে বেদম প্রহারের শিকার হন। তার বাম হাত-মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হয়। গুরুতর আহত অবস্থায় তিনি বর্তমানে? টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

সম্প্রতি জেলা সদরের ডিসি লেকে বেড়াতে আসা বাসাইলের এক কলেজ ছাত্রকে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে। নাম প্রকাশ না করে ওই কলেজ ছাত্র জানায়, ১৪ মার্চ বৃহস্পতিবার সকালে তিনি এক বান্ধবীকে নিয়ে ডিসি লেকে বেড়াতে আসেন। ডিসি লেকের শিশু পার্ক চত্বর থেকে একদল কিশোর তাদের আটক করে পাশের একটি ফাস্টফুডের দোকানে নিয়ে যায়। সেখানে তাকে ও তার বান্ধবীকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয়। পরে তাদের সঙ্গে থাকা টাকা-পয়সা ও মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।

তিনি জানান, ডিসি লেকের পাশে অবস্থিত বেশ কয়েকটি ফাস্টফুডের দোকানদারদের সঙ্গে ওইসব কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের যোগসাজশ রয়েছে। স্থানীয় অনেকেই নাম প্রকাশ না করে জানায়, প্রায় প্রতিদিনই ডিসি লেকে বেড়াতে আসা নিরীহ ছাত্র-ছাত্রীরা এ ধরনের ঘটনার শিকার হচ্ছে।

টাঙ্গাইল কেন্দ্রীয় ঈদগাঁহ মাঠের কয়েকজন দোকানদার জানান, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা প্রায় দিনই শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের ধরে এনে ঈদগাঁহর পশ্চিম পাশের বকুল গাছের নিচে অত্যাচার চালায়। তাদের কাছে থাকা টাকা-মোবাইল ফোন রেখে ছেড়ে দেওয়া হয়। অনেক ক্ষেত্রে বিকাশের মাধ্যমে টাকা এনেও ছেড়ে দেওয়া হয়। প্রায় ক্ষেত্রেই এসব ঘটনার পেছনে প্রেম সংক্রান্ত বিষয় জড়িত থাকে বলেও তারা জানায়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কিশোর গ্যাংয়ের দুই সদস্য জানান, টাঙ্গাইলের এক প্রভাবশালী রাজনৈতিক বড় ভাইয়ের আশীর্বাদে তাদের গ্যাংয়ে প্রায় ২৫ জন সদস্য রয়েছে। কয়েকটি উপজেলায়ও তাদের অনুসারীরা রয়েছে- সেখানকার প্রতিটি গ্রম্নপে ১৫-২০ জন করে সদস্য আছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে তারা সেই ভাইয়ের পক্ষ হয়ে নিয়মিত মিছিল-মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করেন। এর প্রতিদানে সেই বড় ভাই বিভিন্ন ঘটনা কৌশলে মীমাংসা করে দেন এবং বড় কোনো ঝামেলা হলেও তিনিই শেল্টার দিয়ে থাকেন।

শহরের মাহমুদুল হাসান আদর্শ মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ আমিনুল ইসলাম উজ্জল জানান, 'অলস মস্তিষ্ক শয়তানের আড্ডা'। মূলত সন্তান কোথায় কখন কী করছে পরিবারের অভিভাবকরা তার খোঁজখবর রাখেন না। অভিভাবকদের এই অনীহাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের কিশোর গ্যাংয়ে ঢুকতে সুযোগ করে দেয়। সাধারণত সামাজিক অবক্ষয় ও রাজনৈতিক বড় ভাইদের আশ্রয়-প্রশ্রয় এবং দাপট বা ক্ষমতার নেশা বা সহজে অর্থপ্রাপ্ততার কারণে কিশোররা দলবদ্ধ হয়ে কিশোর গ্যাং তৈরি করে। বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানের দূরত্ব বেড়ে যাওয়ায় ছেলেমেয়েরা আদর-স্নেহ ও শাসন থেকে বঞ্চিত হয়ে মাদক সেবনসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে। এরই ধারাবাহিকতায় তৈরি হচ্ছে কিশোর গ্যাং। নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানরা নগদ টাকার আশায় আর উচ্চবিত্ত পরিবারের বখে যাওয়া সন্তানরা থ্রিলারের আশায় কিশোর গ্যাংয়ে সম্পৃক্ত হয়।

টাঙ্গাইল সদর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. লোকমান হোসেন জানান, কিশোর গ্যাংয়ের অস্তিত্ব সারাদেশেই আছে- একই অবস্থা টাঙ্গাইলেরও। তাদের সম্পর্কে পুলিশের পক্ষ থেকে সব সময় খোঁজখবর রাখা হচ্ছে। যখনই তারা কোনো অপরাধমূলক ঘটনা ঘটাচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা মাদকের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে- এটারও সত্যতা আছে।

তিনি আরও জানান, প্রতিটি কিশোর গ্যাং সৃষ্টির পেছনে রাজনৈতিক বড় ভাইদের হাত থাকে। কিশোরদের অপতৎপরতা রোধে শুধু প্রশাসন যথেষ্ট নয়। পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতাদেরও এ বিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে