সোমালি জলদসু্যরা যোগাযোগ করেছে
প্রকাশ | ২১ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
ইব্রাহিম খলিল, চট্টগ্রাম
ভারত মহাসাগর থেকে বাংলাদেশি জাহাজ জিম্মির করার ৯ দিনের মাথায় সোমালি জলদসু্যদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে চট্টগ্রামের কবির গ্রম্নপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এসআর শিপিং লাইনের জাহাজ এমভি আবদুলস্নাহর মালিকপক্ষের সঙ্গে।
বুধবার জলদসু্যদের সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কবির গ্রম্নপের মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম। তিনি বলেন, দসু্যদের সঙ্গে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে যোগাযোগ হয়েছে। তবে কোনো আলোচনা হয়নি। বিষয়টি স্পর্শকাতর, তাই আলোচনা না হওয়া পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছে না।
কবির গ্রম্নপের আরেক কর্মকর্তা বলেন, বুধবার সোমালি দসু্যরা মালিকপক্ষেও সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। আশা করছেন উভয় পক্ষের মধ্যে এ বিষয়ে সমঝোতা হবে। জাহাজের জিম্মি নাবিকরা সুস্থভাবে ফিরে আসবেন। তবে কোনো দাবি দাওয়া জানিয়েছেন কিনা সে বিষয়ে কিছুই জানাননি ওই কর্মকর্তাও।
বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএমওএ) সভাপতি ক্যাপ্টেন এম আনাম চৌধুরী বলেন, 'আমি শুনেছি দসু্যরা জাহাজ থেকে যোগাযোগ করেছে। এখানে চার ধরনের দসু্য গ্রম্নপ আছে। একটি গ্রম্নপ জাহাজ আটক করেছে। আরেকটা গ্রম্নপ জাহাজের নিয়ন্ত্রণে আছে। চার নম্বর গ্রম্নপের দায়িত্ব হচ্ছে সমঝোতা করা। এখন কোন গ্রম্নপ যোগাযোগ করেছে তা বলতে পারছি না।'
এদিকে সমুদ্রগামী বাণিজ্যিক জাহাজের ক্যাপ্টেন আতিক ইউ এ খান বলেছেন, 'এমভি আবদুলস্নাহ জাহাজ জিম্মি করা দসু্যরা মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। কত ডলার দাবি করেছে তা বলতে পারছি না। প্রথমে অনেক বেশি দাবি করবে। পরবর্তীতে তা দরকষাকষিতে কমে আসবে। উভয়ের মধ্যে একটা সমঝোতা হবে।'
তিনি আরও বলেন, 'অবস্থান পরিবর্তন করেছে দসু্যরা। এবার আগের থেকে মাত্র দেড় নটিক্যাল মাইল দূরে নিয়ে জাহাজ নোঙর করা হয়েছে। তবে জাহাজ এমভি আবদুলস্নাহ উদ্ধারে জলদসু্যদের ওপর যৌথভাবে চাপ বাড়িয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ভারতীয় নৌবাহিনী।'
তিনি বলেন, গত দুই দিন আন্তর্জাতিক নৌবাহিনী এমভি আবদুলস্নাহকে বেশ চাপের মুখে রেখেছে। যুদ্ধজাহাজগুলো এমভি আবদুলস্নাহর দেড় নটিক্যাল মাইলের মধ্যে চলে এলে জলদসু্যরা জাহাজের নোঙর তুলে আরও ভেতরে চলে গিয়ে তীরের মাত্র এক দশমিক পাঁচ মাইল দূরে আবার নোঙর করেছে। দসু্যরা এটাও বলেছে যে বাড়াবাড়ি করলে জাহাজ তীরে তুলে দেবে। তবে নৌবাহিনী এখনো বিভিন্নভাবে তাদের অবস্থান জানান দিচ্ছে। এই চাপ হয়তো জলদসু্যদের দ্রম্নত মুক্তিপণ দাবিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।
আতিক ইউ এ খান আরও বলেন, নৌবাহিনীর চাপের ফলে সব নাবিককে এখন দিন-রাত ২৪ ঘণ্টাই ব্রিজে অবস্থান করতে হচ্ছে। এছাড়া মাঝে মধ্যে ভিএইচএফ (ওয়াকিটকি) ব্যবহার করে নৌবাহিনীকে অনুরোধও জানাতে হচ্ছে যেন কাছে না আসে।
আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিক থেকে কয়লা নিয়ে আরব আমিরাত যাওয়ার পথে গত ১২ মার্চ সোমালি উপকূল থেকে ৬০০ নটিক্যাল মাইল দূরে ভারত মহাসাগরে এমভি আবদুলস্নাহ জাহাজটি ছিনতাই করে সোমালি জলদসু্যরা। এর তিন দিনের মাথায় নাবিকসহ জিম্মি জাহাজটি সোমালিয়া উপকূলে নিয়ে যাওয়া হয়। দুই দফা স্থান পরিবর্তন করে জাহাজটি গত শুক্রবার সোমালিয়ার গদভজিরান উপকূলের কাছে নোঙর করে রাখে জলদসু্যরা।
আর এই সময়ের মধ্যে জাহাজটির মালিকপক্ষের কারো সঙ্গে কোনোরকম যোগাযোগ করেনি। কোনোরকম মুক্তিপণও চাওয়া হয়নি। বরং ইইউ ও ভারতীয় নৌবাহিনীর দুটি যুদ্ধ জাহাজ এমভি আবদুলস্নাহর পিছু নেওয়ায় এবং অ্যাটাক হেলিকপ্টারের আনাগোনায় ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে জলদসু্যরা।
অন্যদিকে এমভি আবদুলস্নাহ এবং জিম্মি নাবিকদের জলদসু্যদের কবল থেকে মুক্ত করতে সোমালি পুলিশ ও আন্তর্জাতিক নৌবাহিনী অভিযানের প্রস্তুতির খবরে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে সোমালি জলদসু্যরা। ফলে জিম্মি ঘটনার কয়েকদিন জাহাজটির নাবিকদের মালিকপক্ষ ও পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করার সুযোগ দিলেও পরে তা বন্ধ করে দেয়। শুধু তাই নয়, নাবিকদের সঙ্গে ক্রমেই খারাপ আচরণ করা শুরু করে জলদসু্যরা।
তবে গত মঙ্গলবার জাহাজে জিম্মি তিনজন নাবিক তাদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছে। এর মধ্যে জিম্মি থাকা ইঞ্জিন ক্যাডেট আইয়ুব খানের সঙ্গে কথা হয় বলে জানান তার বড় ভাই ওমর ফারুক। আইয়ুবের বরাত দিয়ে তার বড় ভাই জানান, জলদসু্যরা জিম্মি নাবিকদের সঙ্গে খুবই খারাপ আচরণ শুরু করেছে। প্রতিদিন প্রায় ১০০ জনের খাবার নষ্ট করছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বড় সংকটে পড়তে হবে জিম্মি নাবিকদের।
এরপর সর্বশেষ চিফ অফিসার ক্যাপ্টেন আতিকুলস্নাহ খানের সঙ্গে তার পরিবারের কথা হয়। ছেলের বরাত দিয়ে ক্যাপ্টেন আতিকুলস্নাহ খানের মা শাহানুর বেগম জানান, 'আমাদের সাথে শেষ যখন কথা হয়েছে তখন আমার ছেলে আমাকে বলেছে ওরা গায়ে হাত না দিলেও অনেক দুর্ব্যবহার করা শুরু করেছে। বিশেষ করে ভারতীয় নৌবাহিনীর হেলিকপ্টার টহল দেখার পর থেকে জলদসু্যদের আচরণে পরির্বতন হয়েছে।
সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার তৌফিকুল ইসলামের বরাত দিয়ে তার শ্যালক সিব্বির মাহমুদ জানান, 'গত শনিবারের পর থেকে আমাদের সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ হয়নি। এ নিয়ে পুরো পরিবার দুশ্চিন্তায় আছি। এরপর কারো পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি তাদের।'
জিম্মি নাবিকদের পরিবারের সদস্যদের ভাষ্য, এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে জলদসু্যদের হাতে জিম্মি জাহাজ। কয়েক দফায় দসু্যরা জাহাজে আসা যাওয়া করছে। প্রায় সবসময় জাহাজে থাকছে ৩০-৪০ জন জলদসু্য।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলছে, ভারতীয় কমান্ডোরা জলদসু্যদের নিয়ন্ত্রণে থাকা মাল্টার পতাকাবাহী জাহাজ এমভি রুয়েনে অভিযান চালিয়ে ১৭ ক্রুকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করার পর এমভি আবদুলস্নাহ ও জিম্মি নাবিকদের জলদসু্যদের হাত থেকে মুক্ত করতে অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে আন্তর্জাতিক নৌবাহিনী ও দেশটির পান্টল্যান্ড অঞ্চলের পুলিশ।
সোমালিয়ার আধা-স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল পান্টল্যান্ডের পুলিশ গণমাধ্যমকে জানিয়েছে, এমভি আবদুলস্নাহকে দখল করে থাকা জলদসু্যদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক নৌবাহিনীর অভিযানের একটি পরিকল্পনা তারা জানতে পেরেছে। সে কারণে তারা সতর্ক অবস্থানে রয়েছে এবং অভিযানে অংশ নিতেও প্রস্তুত রয়েছে।
তবে এই ধরনের অভিযানে রাজি নয় বাংলাদেশের সরকার। জাহাজটির মালিক কোম্পানি কেএসআরএম গ্রম্নপও এ ধরনের অভিযানে রাজি নয়। প্রতিষ্ঠানটির সহযোগী এসআর শিপিং লাইনের প্রধান নির্বাহী পরিচালক মেহেরুল করিম বলেন, অভিযানে নাবিক ও ক্রুদের জীবন বিপন্ন হয় এমন কোনো অপারেশন আমরা চাই না।
এদিকে নৌপরিবহণ অধিদপ্তরের পাশাপাশি বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশানও (বিএমএমওএ) জলদসু্যদের নিয়ন্ত্রণের থাকা জাহাজটির গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছে। বিএমএমওএ বলছে, 'গত তিন দিন ধরে জাহাজটি একই জায়গায় নোঙর করে আছে। আমরা আশা করছি এখান থেকেই তারা মালিকপক্ষের সঙ্গে দেন দরবার শুরু করবে।'