অবন্তিকার মৃতু্য
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে জবি শিক্ষার্থীদের 'লালকার্ড'
প্রকাশ | ২০ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি রিপোর্ট
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ফাইরুজ অবন্তিকার মৃতু্যর ঘটনায় শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ অব্যাহত আছে। মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্য চত্বরে এক প্রতীকী সমাবেশে প্রক্টর অফিস সিলগালা করার হুঁশিয়ারি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে 'লালকার্ড' দেখিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। এদিন জবির প্রধান ফটকে অভিযুক্তদের বিচারের দাবিতে প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। এছাড়া অবন্তিকাকে স্মরণ করে আইন বিভাগের শিক্ষক ও তার সহপাঠীরা জবির কেন্দ্রীয় মিলনায়তনে শোকসভার আয়োজন করেন।
মঙ্গলবার সকালে রাজু ভাস্কর্য চত্বরে প্রতিবাদ সমাবেশে শিক্ষার্থীরা বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রক্টরিয়াল বডি অন্যায়ভাবে অনেক মুচলেকা নিয়েছে। এর জন্য তাদের মুচলেকা দিয়ে ক্ষমা চাইতে হবে। সাত দিনের মধ্যে মুচলেকা না দিলে প্রক্টর অফিসের নামে যে টর্চার সেল তারা করে রেখেছেন সেখানে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হবে।'
অবন্তিকার মৃতু্যর ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে 'লালকার্ড' প্রদর্শন করে শিক্ষার্থীরা এ ঘটনার দ্রম্নত বিচার দাবি করেন। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়নবিরোধী সেল কার্যকর করারও দাবি জানান।
সমাবেশে ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন
বিভাগের শিক্ষার্থী শাহ সাকিব সোবহান বলেন, 'প্রক্টরিয়াল বডি করোনার সময় কুকুরের জন্য বরাদ্দ দেওয়া টাকা মেরে খেয়েছেন। আজকে সেই প্রক্টরিয়াল বডি নিপীড়ন বিরোধী সেলের নামে ডামি সেল গঠন করে রেখেছে। শুধু তাই নয়, প্রক্টরিয়াল বডি যখন তখন ক্যাম্পাস থেকে শিক্ষার্থীদের ধরে নিয়ে মুচলেকা সংগ্রহ করত। এখন থেকে সেই খেলা আর চলবে না। যৌন নিপীড়ন বিরোধী সেলে ছাত্র-শিক্ষকসহ বাইরে থেকে ম্যাজিস্ট্রেট এনে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। নিপীড়ক বিরোধী সেলের নামে টর্চার সেল যারা তৈরি করে রেখেছে, সেই প্রক্টর অফিসে আমরা সাত দিনের মধ্যে তালা ঝুলিয়ে দেব।'
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী ইভান তাহসিব বলেন, 'জগন্নাথে যে কোনো নিপীড়নের বিরুদ্ধে আমরা অবস্থান নেব। এখানে যৌন নিপীড়ন বিরোধী সেল থাকলেও তার কোনো কার্যক্রম নেই। এটি কার্যকর করতে হবে। এটিকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। সেখানে শিক্ষার্থী প্রতিনিধি যুক্ত করতে হবে। যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। শুধু কিছু প্রতিশ্রম্নতি দিলে হবে না।'
এই শিক্ষার্থী আরও বলেন, 'যখন একটা ঘটনা সামনে আসছে, তখন তদন্ত কমিটি করে দেওয়া হচ্ছে। ঘটনা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আমরা এভাবে আর এগোতে চাই না, আমরা আরেকটি অবন্তিকাকে দেখতে চাই না। আরেকটি অংকনকে দেখতে চাই না। আমাদের আন্দোলন ততদিন পর্যন্ত জারি থাকবে, যতদিন পর্যন্ত এটার একটা স্থায়ী সমাধান না হচ্ছে।'
শিক্ষার্থী মহিউদ্দিন আল আরাবি বলেন, 'উপাচার্যকে নিয়ে মসজিদে গিয়ে শোকসভা করে ঘটনাটিকে হালকা করার চেষ্টা করা হয়েছে। আমাদের সহপাঠীর মৃতু্য হয়েছে। তাই এ বিষয়ে আমাদের কথাই শুনতে হবে।'
এদিকে, ফাইরুজ অবন্তিকার আত্মহত্যার ঘটনায় অভিযুক্তদের বিচারের দাবি নিয়ে মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। এই প্রতিবাদ সমাবেশের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে প্রতিবাদে শামিল হয় কর্মজীবী নারীদের ব্যানারে আরেকটি সংগঠনও।
মহিলা পরিষদের অ্যাডভোকেসি লবি পরিচালক জনা গোস্বামীর সঞ্চালনায় সভাপতির বক্তব্যে ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয়ে বারবার সংঘটিত যৌন নিপীড়নের ঘটনা শিক্ষাঙ্গনকে চরম একটি বিব্রতকর অবস্থায় ফেলছে। আজ শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা চরমভাবে বিঘ্নিত। মহামান্য হাইকোর্টের রায় অনুসারে গঠিত যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধ কমিটিকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে এবং নারীর প্রতি অবমাননাকে সামাজিক অবমাননা হিসেবে দেখতে হবে। নারীর কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।'
অবন্তিকার আত্মহত্যার প্ররোচনার ঘটনায় বিষয়টি সুষ্ঠু তদন্ত করে এর সঙ্গে জড়িতদের অতিদ্রম্নত বিচারের আওতায় আনার পাশাপাশি জবির অন্যান্য যৌন হয়রানির অভিযোগের বিচার করারও দাবি জানানো হয় সমাবেশ থেকে।
অন্যদিকে, অবন্তিকার স্মরণসভায় তার সহপাঠী ইসমাইল হোসেন বলেন, 'এখানে তো শোকসভা হওয়ার কথা ছিল না। হয়তো অবন্তিকার জাতীয় বা আন্তর্জাতিক কোনো অর্জনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সংবর্ধনার আয়োজন করতে পারত।'
মঙ্গলবার জবির কেন্দ্রীয় মিলনায়তনে আইন বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থী অবন্তিকার স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন।
অনুষ্ঠানের শুরুতে অবন্তিকার স্মরণে প্রথমে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। পরে অবন্তিকার সহপাঠীদের বানানো একটি ভিডিও দেখানো হয়। যেখানে অবন্তিকার ক্যাম্পাসে আন্দোলনে অংশ নেওয়া, পশুদের উদ্ধার ও চিকিৎসার ব্যবস্থা, সহপাঠীদের সঙ্গে আড্ডা, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উপস্থাপনার বিভিন্ন দৃশ্য রয়েছে।
ভিডিওটি দেখতে দেখতে মিলনায়তনে থাকা শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা অশ্রম্নসিক্ত হয়ে পড়েন। তারা অপরাধীদের বিচার দাবি করেন। বিভাগের চেয়ারম্যান সরকার আলী আককাস সভায় সভাপতিত্ব করেন।
একজন ছাত্রী কেন আত্মহননের পথ বেছে নেবেন- এমন প্রশ্ন তোলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সাদেকা হালিম। যৌন নিপীড়নের অভিযোগ জানিয়ে ব্যবস্থা নিতে চার মাস আগে প্রশাসনের কাছে দেওয়া অবন্তিকার আবেদনে গাফিলতি, অবহেলা করা হয়েছে বলে দুঃখ প্রকাশ করে তিনি বলেন, 'এ জন্য আমি দগ্ধ। তারা যদি সক্রিয় থাকত, অন্তত আমি সন্তুষ্ট থাকতাম।'
স্মরণসভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মোস্তফা আহমেদ বলেন, 'এক ব্যাচ সিনিয়র হয়েও আমাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব সম্পর্ক রেখেছে। সব আন্দোলনে সামনে ছিল। সে নদীর মতো ধাবমান ছিল। একটা ঝড় গেছে, সে ভেবেছিল দ্রম্নত এই কালো ঝড় চলে যাবে। কিন্তু ঝড় শেষ হওয়ার আগেই সে চলে গেল।'
কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত অবন্তিকার মানসিক অসুস্থতার খবর উলেস্নখ করে মোস্তফা আহমেদ বলেন, 'তার কোনো মানসিক অসুস্থতা ছিল না।' অপরাধীরা যত শক্তিশালী হন না কেন তদন্ত সাপেক্ষে বিচারের দাবি করেন তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের গঠিত উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক জাকির হোসেন বলেন, 'আমরা যে বেদনা অনুভব করছি, এর থেকে শতগুণ বেদনা তার মা অনুভব করছেন। তদন্ত কমিটি দ্রম্নত সুষ্ঠু তদন্তের প্রতিবেদন দেবে।'
ক্যাম্পাস কেন নিরাপদ হলো না, তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মাসরিক হাসান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কোনো সমস্যা হলে তাদের পাশে দাঁড়াতে অনুরোধ জানান।
আইন অনুষদের ডিন মাসুম বিলস্নাহ বলেন, 'অবন্তিকার আইনি লড়াইয়ে আইন বিভাগ থাকবে তার পাশে থাকবে।'
প্রসঙ্গত শুক্রবার রাতে ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়ে জবির আইন বিভাগের শিক্ষার্থী অবন্তিকা নিজ বাড়ি কুমিলস্নায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন। অবন্তিকার কয়েকজন জানান, তিনি ফেসবুক পোস্টে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠীর বিরুদ্ধে যৌন হয়রানিসহ নানা ধরনের নিপীড়নের অভিযোগ করেন। ওই পোস্টে একজন সহকারী প্রক্টরের বিরুদ্ধে ছেলেটির পক্ষ নিয়ে তার সঙ্গে খারাপ আচরণের অভিযোগ করেন তিনি। সেখানে আত্মহত্যার কথাও বলেন অবন্তিকা।