হল-মার্ক কেলেঙ্কারি
তানভীর-জেসমিনের যাবজ্জীবন
রায়ে আরও সাতজনের যাবজ্জীবন, আট আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদে দন্ড, রায় শুনে আসামির পলায়ন
প্রকাশ | ২০ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি রিপোর্ট
অস্তিত্বহীন কোম্পানির নামে ঋণ নিয়ে ১০ কোটি টাকা আত্মসাতের দায়ে হল-মার্ক গ্রম্নপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. তানভীর মাহমুদ এবং তার স্ত্রী ও কোম্পানির চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলামসহ ৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিয়েছেন আদালত। এ ছাড়া একযুগ আগে দুদকের দায়ের করা এ মামলার বাকি আট আসামিকে দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড।
মঙ্গলবার ঢাকার প্রথম বিশেষ জজ আদালতের বিচারক মো. আবুল কাশেম এ মামলার রায় ঘোষণা করেন।
সোনালী ব্যাংক থেকে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাতের ঘটনায় ২০১২ সালে হল-মার্ক গ্রম্নপের মালিক, কর্মকর্তা এবং সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ১১টি মামলা হয়। এ মামলা তারই একটি।
রায়ে তানভীর ও জেসমিনকে দন্ডবিধির ৪০৯ ধারায় যাবজ্জীবন কারাদন্ড এবং পাঁচ কোটি টাকা অর্থদন্ড দেওয়া হয়। একই সঙ্গে ৪২০ ধারায় সাত বছরের সশ্রম কারাদন্ড ও ২৫ হাজার টাকা অর্থদন্ড দেওয়া হয়েছে তাদের।
তানভীরের ভায়রা হল-মার্কের জেনারেল ম্যানেজার তুষার আহমেদ, সোনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের সহকারী উপমহাব্যবস্থাপক মো. সাইফুল হাসান, নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল মতিন, ম্যাক্স স্পিনিং মিলসের মালিক মীর জাকারিয়া, প্যারাগন গ্রম্নপের এমডি সাইফুল ইসলাম রাজা, নকশী নিটের এমডি মো. আবদুল মালেক এবং টি অ্যান্ড ব্রাদার্সের পরিচালক তসলিম হাসানকে দন্ডবিধির ৪০৯ ও ১০৯ ধারায় যাবজ্জীবন কারাদন্ডের পাশাপাশি ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। আর ৪২০ ও ১০৯ ধারায় তাদের ৭ বছর করে কারাদন্ড এবং দুই লাখ টাকা অর্থদন্ড দিয়েছেন আদালত।
বাকি আসামির মধ্যে সোনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের ডিএমডি মাইনুল হক, ডিজিএম মো. সফিজউদ্দিন আহমেদ, সোনালী ব্যাংক ধানমন্ডি শাখার বর্তমান জ্যেষ্ঠ নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেরুন্নেসা মেরি, সোনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের জিএম মীর মহিদুর রহমান, এজিএম মো. কামরুল হোসেন খান, জিএম ননী গোপাল নাথ ও সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়ুন কবিরকে দন্ডবিধির ৪০৯ ও ১০৯ ধারায়
১০ বছরের সশ্রম কারাদন্ড ও ১০ লাখ টাকা অর্থদন্ড দেওয়া হয়েছে। আর ৪২০ ও ১০৯ ধারায় তাদের সাত বছর করে কারাদন্ড এবং দুই লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
এ ছাড়া সাভারের হেমায়েতপুরের তেঁতুলঝোড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জামাল উদ্দিন সরকারকে দন্ডবিধির ৪০৯ ও ১০৯ ধারায় পাঁচ বছরের কারাদন্ড এবং পাঁচ লাখ টাকা অর্থদন্ড দেওয়া হয়েছে। ৪২০ ও ১০৯ ধারায় তাকে দেওয়া হয়েছে দুই বছরের কারাদন্ড এবং দুই লাখ টাকা অর্থদন্ড।
আসামির- মধ্যে সাইফুল ইসলাম, মতিন, হুমায়ুন, ননী গোপাল, তসলিম, সাইফুল হাসান, মেরি ও জাকারিয়া পলাতক। জামাল উদ্দিন ও আলতাফ ছিলেন জামিনে। তানভীর, জেসমিন, তুষারসহ বাকি আটজন কারাগারে ছিলেন।
জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় হল-মার্ক গ্রম্নপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীরসহ অন্যদের বিরুদ্ধে ২০১২ সালে ৪ অক্টোবর রাজধানীর রমনা থানায় এই মামলা করে দুদক।
মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে পরস্পরের যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহার ও অর্থের অপব্যবহার, প্রতারণা, জালিয়াতি, অর্থ আত্মসাৎ এবং অর্থ পাচারের অভিযোগ আনা হয়।
মামলায় জালিয়াতির মাধ্যমে ৫২৫ কোটি ৬২ লাখ ৯২ হাজার ৮০০ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয় আসামিদের বিরুদ্ধে।
মামলার কাগজপত্রের তথ্য বলছে, সোনালী ব্যাংক কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশ করে সোনালী ব্যাংকের হোটেল শেরাটন (বর্তমান ইন্টারকন্টিনেন্টাল) শাখা থেকে হল-মার্ক মোট ২ হাজার ৬৮৬ কোটি ১৪ লাখ টাকা আত্মসাৎ করে। এর মধ্যে স্বীকৃত বিলের বিপরীতে দায় (ফান্ডেড) অর্থ হচ্ছে ১ হাজার ৫৬৮ কোটি ৪৯ লাখ ৩৪ হাজার ৮৭৭ টাকা। এ ঘটনায় ২০১২ সালের ৪ অক্টোবর রমনা থানায় মামলা করে দুদক।
তদন্ত শেষে পরের বছর ২০১৩ সালের ৭ অক্টোবর ১১টি মামলায় হল-মার্ক গ্রম্নপের চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলাম, ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর মাহমুদ, তার ভায়রা তুষার আহমেদসহ ২৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেওয়া হয়।
পরে ঢাকার জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ আদালত ২০১৬ সালের ১৭ ফেব্রম্নয়ারি ও ২৭ মার্চ আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। এই ১১টি মামলা বিচারের জন্য ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-১-এ বদলি করা হয়। আজ একটি মামলায় রায় ঘোষণা করা হলো। বাকি মামলা বিচারাধীন।
দুদকের আইনজীবী মীর আহম্মেদ সালাম জানান, এর আগে ৫ ও ৬ নম্বর বিশেষ জজ আদালতে হল-মার্ক কেলেঙ্কারির কয়েকটি মামলার রায় হয়েছে, তবে সেসব মামলায় তানভীর মাহমুদ বা জেসমিন ইসলাম আসামি ছিলেন না।
কারাদন্ডের আদেশ শুনে আসামির পলায়ন
এদিকে এদিন দুপুরে এ মামলায় জামিনে থাকা একমাত্র আসামি সাভারের হেমায়েতপুরের তেঁতুলঝোড়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মো. জামাল উদ্দিন সরকার সকালে রায় শুনতে আদালতে আসেন। হাজিরায় স্বাক্ষরও করেন। রায় ঘোষণাও শোনেন। তাকে পৃথক দুই ধারায় সাত বছরের কারাদন্ড দেওয়া হয়। কারাদন্ড শোনার পরই সবার অগোচরে আদালত থেকে পালিয়ে যান তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আসামিপক্ষের আইনজীবী হারুন অর রশিদ বলেন, জামাল উদ্দিন রায় ঘোষণার সময় আদালতে ছিলেন। রায় ঘোষণার পর পেছনে তাকিয়ে দেখি তিনি কোর্টে নেই। পরে তাকে খুঁজে আর পাওয়া যায়নি।
এর আগে এদিন বেলা ১২টা ৬ মিনিটে রায় ঘোষণা করতে আদালতের বিচারকাজ শুরু হয়। সংশ্লিষ্ট আদালতের বেঞ্চ সহকারী শুধু মামলা নম্বর ডাকেন। আসামিদের অবস্থান জানতে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এরপর আদালত রায় ঘোষণা শুরু করেন।
সংশ্লিষ্ট আদালতের বেঞ্চ সহকারী রাজীব ঘোষ জানান, রায় শেষে আসামিকে খুঁজতে গেলে দেখি তিনি নেই। আসামিদের নাম ডাকা হয়েছিল কি না জানতে চাইলে বলেন, তখন পরিস্থিতি এমন ছিল না।
এদিকে আসামি জামাল উদ্দিনের জামিন বাতিল করে সাজা পরোয়ানাসহ গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত।