বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪, ৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
অবন্তিকার আত্মহত্যা

আম্মান দুই দিন ও দ্বীন এক দিনের রিমান্ডে

অবন্তিকার আত্মহত্যা আম্মান দুই দিন ও দ্বীন এক দিনের রিমান্ডে স্টাফ রিপোর্টার, কুমিলস্না
  ১৯ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
আম্মান দুই দিন ও দ্বীন এক দিনের রিমান্ডে

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকার আত্মহত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার তার সহপাঠী রায়হান আম্মান সিদ্দিকী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন কুমিলস্নার আদালত। সোমবার দুপুরে এ তথ্য নিশ্চিত করেন আদালত পুলিশের পরিদর্শক মজিবুর রহমান।

কুমিলস্না কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ফিরোজ হোসেন জানান, বেলা পৌনে ১১টায় একটি সাদা প্রাইভেটকারে আসামিদের আদালতে হাজির করে কুমিলস্না কোতোয়ালি মডেল থানা পুলিশ। এরপর মাথায় হেলমেট ও মুখে মাস্ক পরা অবস্থায় তাদের আদালত পুলিশের পরিদর্শক মো. মজিবুর রহমানের কক্ষে রাখা হয়। বেলা ১১টা ২০ মিনিটে তাদের কুমিলস্নার বিচারিক হাকিম-২ নম্বর আমলি আদালতের বিচারক আবু বক্কর সিদ্দিকের আদালতে হাজির করা হয়। আদালতে পুলিশ অবন্তিকার সহপাঠী আম্মানের পাঁচ দিনের এবং শিক্ষক দ্বীন ইসলামের দুদিন রিমান্ডের আবেদন করে। শুনানি শেষে আদালত সহপাঠীর দুইদিন ও শিক্ষকের একদিন রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

ওসি জানান, রোববার রাতে কুমিলস্না জেলা পুলিশের একটি প্রতিনিধি দল ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের

হেফাজত থেকে দুই আসামিকে কুমিলস্নায় নিয়ে আসে। শনিবার রাতে কুমিলস্না কোতোয়ালি মডেল থানায় আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগে অবন্তিকার মা তাহমিনা বেগম শবনম জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৩তম ব্যাচের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী আম্মান সিদ্দিকীকে আসামি করে মামলা করেন।

মামলায় উলেস্নখ করা হয়, অবন্তিকার সহপাঠী আম্মান সিদ্দিকী অফলাইনে ও অনলাইনে তাকে যৌন হয়রানি করে আসছিলেন। এ বিষয়ে সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামের কাছে অভিযোগ করলে তিনি ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো অবন্তিকাকেই নানাভাবে অপমান করে আসছিলেন। এর আগে সহপাঠীদের আন্দোলন ও আলটিমেটামের ফলে অবন্তিকার আত্মহত্যার ঘটনায় তার সহপাঠী রায়হান সিদ্দিকী আম্মান এবং সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামকে শনিবার রাতে ডিএমপি পুলিশ আটক করে।

আদালত পুলিশের পরিদর্শক মুজিবুর রহমান বলেন, 'থানা পুলিশ আসামিদের এনেছে। আমরা আদালতে হাজির করেছি।'

প্রসঙ্গত, শুক্রবার রাত ১০টার দিকে ফেসবুক আইডিতে এক পোস্টে আত্মহত্যার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম ও সহপাঠী আম্মান সিদ্দিকীকে দায়ী করেন অবন্তিকা। এরপর কুমিলস্না নগরীর বাগিচাগাঁও পিসি পার্ক সরণিকা ভবনে দ্বিতীয়তলায় নিজ বাসায় গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি। অবন্তিকা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি কুমিলস্না সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যাপক প্রয়াত জামাল উদ্দিনের মেয়ে।

'আমরা কেন কথা

বলতে ভয় পাব'

এদিকে ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকার আত্মহত্যার ঘটনায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান নিয়েছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। ওই আত্মহত্যার ঘটনায় তারা প্রশাসনের গাফিলতির অভিযোগ তুলে এ ঘটনার দ্রম্নত বিচার দাবি করেন। সোমবার সকালে 'নিপীড়নের বিরুদ্ধে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়' ব্যানারে শিক্ষার্থীরা এই কর্মসূচি শুরু করেন।

কর্মসূচি থেকে জবি শিক্ষার্থী ইভান তাহসিফ বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা পড়তে এসেছি। কিন্তু হয়রানি কেন হবো। আমরা অভিযুক্ত ব্যক্তিদের দ্রম্নত স্থায়ী বহিষ্কার চাই।'

ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন বিভাগের শিক্ষার্থী শওরিন ইরা বলেন, 'আমরা কেন কথা বলতে ভয় পাব। আমরা সব নিপীড়নের তদন্তের প্রতিবেদন জানতে চাই।'

অবন্তিকার কয়েকজন বন্ধু বলেন, তিনি ফেসবুক পোস্টে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী আম্মান সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে যৌন হয়রানিসহ নানা ধরনের নিপীড়নের অভিযোগ করেন। ওই পোস্টে সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামের বিরুদ্ধে ছেলেটির পক্ষ নিয়ে তার সঙ্গে খারাপ আচরণের অভিযোগও করেছেন তিনি। সেখানেই আত্মহত্যার কথা বলেন ফাইরুজ।

'আর কোনো অবন্তিকা যেন

এভাবে ঝরে না পড়ে'

'বৃহস্পতিবারও একসঙ্গে ক্লাস করেছি; আর এখন এভাবে অবন্তিকার জন্য মানববন্ধন করতে হবে এটা বিশ্বাসই হচ্ছে না'- কথাগুলো জবির আইন বিভাগের শিক্ষার্থী মোস্তফা শান্তর। সহপাঠী এবং শিক্ষকদের সঙ্গে তিনিও সোমবার বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মানববন্ধনে দাঁড়িয়েছিলেন।

সবার দাবি, যাদের কারণে ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকা আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

সোমবার দুপুরে জবির শহীদ মিনারের সামনে থেকে আইন বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা পদযাত্রা করেন। পুরো ক্যাম্পাস ঘুরে ফের শহীদ মিনারে এসে তারা মানববন্ধনে মিলিত হন। অবন্তিকার মৃতু্যর ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্ত চেয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা বক্তব্য দেন সেখানে।

মানববন্ধনে বক্তারা জানান, আম্মান তাকে অনলাইন ও অফলাইনে 'হুমকির ওপর রাখতেন' এবং সহকারী প্রক্টরকে অভিযোগ দেওয়ার পর তিনিও 'হুমকি-ধমকি দিয়েছেন'- এমন অভিযোগের কথা আত্মহত্যার আগে লিখে গেছেন অবন্তিকা।

মানববন্ধনে অবন্তিকার সহপাঠী নাদিম বলেন, 'এখানে এভাবে অবন্তিকার জন্য মানববন্ধন করতে হবে সেটা কখনো ভাবিনি। আর কোনো আশ্বাস পেতে চাই না। প্রশাসনের কাছে দাবি, এ ঘটনার পেছনে যারা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক। এরপর যেন এমন কোনো ঘটনা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আর না ঘটে।'

আইন বিভাগের শিক্ষার্থী মোস্তফা শান্ত বলেন, 'আমি স্বপ্নেও ভাবিনি ও এমন করবে। এখানে এভাবে অবন্তিকার জন্য মানববন্ধন করতে হবে এটা বিশ্বাসই হচ্ছে না। আমরা দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই।'

জবির ১২ ব্যাচের শিক্ষার্থী আনিকা বলেন, 'এমন স্ট্রং মানুষ কীভাবে আত্মহত্যা করেছে এটাই ভেবে পাচ্ছি না। আমরা এমন একটা মেধাবী শিক্ষার্থীকে হারালাম, যে শুধু আইন বিভাগ না, পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের গর্ব ছিল। আমরা চাই একটা সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে এ ঘটনার পেছনে যারা দায়ী তারা বেরিয়ে আসুক। আর কোনো অবন্তিকা যেন এভাবে ঝরে না পড়ে।'

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেষ্টা ইয়াসুনুল কবির মনে করেন, 'একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের পতন' ঘটল।

অবন্তিকার সমস্যার বিষয়ে কিছু জানতেন না বলে আফসোস করেন আইন বিভাগের শিক্ষকরা। এ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নূরনাহার মজুমদার বলেন, 'আমাদের বিভাগে কোনো অভিযোগ করেনি, সে অভিযোগ করেছিল প্রক্টর বরাবর। সে আমাদের মৌখিকভাবে কিছু অভিযোগ করেছিল সহপাঠীদের বিরুদ্ধে। আমরা সে ব্যাপারে তাদের সঙ্গেও কথা বলেছি এবং তাদের সতর্ক করে বলা হয়েছে। পরে সে সরাসরি প্রক্টরের কাছে অভিযোগ জানিয়েছে।'

আইন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সরকার আলী আক্কাস বলেন, 'অবন্তিকার মৃতু্যতে আইন বিভাগে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। আমাদের বিভাগের মেধাবী ছাত্রী অবন্তিকার মৃতু্যর সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিচারের দাবি জানাই। সে ফেসবুকে পোস্ট করে মনের যে কথাগুলো বলল, সেগুলো যদি সে আমাদের আগেই বলত, তাহলে আমরা তাকে হয়তো বাঁচাতে পারতাম।'

তথ্য আহ্বান করেছে তদন্ত কমিটি

অন্যদিকে অবন্তিকার আত্মহত্যার ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্তের জন্য অভিযুক্ত সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তথ্য-প্রমাণাদি চেয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে তদন্ত কমিটি। সোমবার তদন্ত কমিটির আহ্বায়কের আদেশক্রমে কমিটির সদস্য সচিব ডেপুটি রেজিস্টার অ্যাডভোকেট রঞ্জন কুমার দাস স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বিষয়টি জানানো হয়েছে।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ফাইরুজ অবন্তিকার আত্মহত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক দ্বীন ইসলামের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি তদন্তপূর্বক প্রতিবেদন পেশ করার জন্য একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে প্রকৃত ঘটনার বিষয়ে তথ্য ও উপযুক্ত প্রমাণাদি প্রয়োজন।

বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, কারও কাছে কোনো তথ্য ও উপযুক্ত প্রমাণাদি থাকলে তা আগামী ২০ মার্চের মধ্যে গঠিত তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. মো. জাকির হোসেনের কাছে জমা দিয়ে তদন্তে সহযোগিতা করার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করছি।

অবন্তিকার আত্মহত্যার ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. জাকির হোসেনকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জবি প্রশাসন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে