বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪, ৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে ওঠে গাজীপুরে

যাযাদি রিপোর্ট
  ১৯ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে ওঠে গাজীপুরে

একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলনের আঠারতম দিন ১৯ মার্চ পূর্ব উত্তাল বাংলা। এরই ধারবাহিকতায় গাজীপুরের (তৎকালীন জয়দেবপুর) শান্তিকামী জনতা পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। প্রতিরোধ যুদ্ধে মনু খলিফা, কিশোর নিয়ামত, ফুটবলার হুরমত আলী ও কানু মিয়া শহীদ হন। আহত হন আরও অনেকে। জয়দেবপুরের এই সম্মুখ যুদ্ধের পর সারাদেশে পাকবাহিনীর প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। সেদিন জনতার স্স্নোগান ছিল- 'জয়দেবপুরের পথ ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর।'

১৯৭১ সালে গাজীপুরের জয়দেবপুর সেনানিবাসের ভাওয়াল রাজবাড়ীতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট কার্যালয় ছিল। এই দিনে ঢাকা ব্রিগেড হেডকোর্য়ার্টার থেকে আকস্মিকভাবে পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার জাহান জেবের নেতৃত্বে পাকিস্তানি রেজিমেন্ট জয়দেবপুরের দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিরস্ত্র করার জন্য পৌঁছে যায়। এ খবর জানাজানি হতেই বিক্ষুব্ধ জনতা জয়দেবপুরে বিশাল প্রতিরোধ সৃষ্টি করে। সেখানে ২৫-৩০ জন ছাড়া সবাই ছিলেন বাঙালি সেনা কর্মকর্তা। পাকিস্তানিরা বাঙালি দমনের নীল নকশা অনুযায়ী ১৫ মার্চের মধ্যে অস্ত্র জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু বাঙালি সৈন্যরা এতে রাজি ছিলেন না। জনতা দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বটতলায় জড়ো হন। এ সময় পাকিস্তানি

সেনাবাহিনী জনতার ওপর গুলিবর্ষণ করলে ঘটনাস্থলেই হতাহত হন অনেকে।

সেদিন জয়দেবপুর হাটের দিন ছিল। জয়দেবপুর রেল গেটে মালগাড়ির বগি, রেলের অকেজো রেললাইন, স্স্নিপারসহ বড় বড় গাছের গুঁড়ি, কাঠ, বাঁশ, ইট ইত্যাদি যে যেভাবে পেরেছে, তা দিয়ে এক বিশাল ব্যারিকেড দেওয়া হয়। জয়দেবপুর থেকে চৌরাস্তা পর্যন্ত আরও ৫টি ব্যারিকেড দেওয়া হয়, যাতে পাকিস্তানি বাহিনী অস্ত্র নিয়ে ফেরত যেতে না পারে।

রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী একাত্তরের এই দিনের ঘটনাবলি সম্পর্কে তার '৭১-এর দশ মাস' বইয়ে লিখেছেন- জয়দেবপুর রাজবাড়ী থেকে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি জওয়ানদের সেনানিবাসে ফিরিয়ে নিতে ব্যর্থ হয়ে পাঞ্জাবি ব্রিগেডিয়ারের নেতৃত্বে সামরিক কর্তৃপক্ষ একদল সেনা জয়দেবপুরে পাঠায়। বেলা ১১টায় পাঞ্জাবি নেতৃত্বাধীন পাকবাহিনীর দলটি চৌরাস্তায় অসহযোগ আন্দোলনরত জনতার ওপর প্রবল গুলিবর্ষণ করে। রাজবাড়ীর দিকে অগ্রসরগামী সেনাবাহিনীকে প্রতিরোধ করতে জনতার সঙ্গে বাঙালি সেনাদল যোগ দেয়। পাকবাহিনীর সঙ্গে প্রতিরোধ বাহিনীর তুমুল গুলি বিনিময় হয়। বাঙালি সেনাদলের নেতৃত্ব দেন লে. কর্নেল মাসুদুল হোসেন খান ও মেজর শফিউলস্নাহ। পাঞ্জাবি বাহিনী ঢাকা ফিরে আসে। পথিমধ্যে বোর্ড বাজারে জনতার ওপর গুলিবর্ষণ করে। মৃতের সংখ্যা ১২৫ বলে জানা যায়।

এই দিন সন্ধ্যায় সেনাবাহিনী জয়দেবপুরে সান্ধ্য আইন জারি করে বহু মানুষকে অজ্ঞাত স্থানে ধরে নিয়ে যায়। তারা কেউ আর ফিরে আসেনি। জয়দেবপুরে সেনাবাহিনী গুলিবর্ষণের তীব্র নিন্দা জানিয়ে এই দিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, 'বাংলাদেশের মানুষ সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান চায়। তার অর্থ এই নয় যে, তারা শক্তি প্রয়োগে ভয় পায়। জনগণ যখন রক্ত দিতে তৈরি হয়, তখন তাদের দমন করতে পারে এমন শক্তি দুনিয়ায় নেই।'

ঢাকায় প্রেসিডেন্ট ভবনে এই দিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ইয়াহিয়া খানের দেড় ঘণ্টাব্যাপী একান্ত বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের বলেন, 'আগামীকাল আবার বৈঠক হবে। দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা আমাকে সাহায্য করবেন। আজ সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগ দলীয় নেতাদের সঙ্গে প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টারা আলোচনায় মিলিত হবেন।'

এ সময় 'জয়বাংলা' প্রসঙ্গে বিদেশি এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, 'আমি মুসলমান ঘুম থেকে উঠে আলস্ন্নাহকে স্মরণ করি তারপরই আমি 'জয়বাংলা' বলি। মৃতু্যর সময়ও আমি আলস্নাহর নাম নিয়ে 'জয়বাংলা' বলে বিদায় নিতে চাই।'

এই দিন চট্টগ্রামে মওলানা ভাসানী বলেন, 'শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা অর্পণ ছাড়া পাকিস্তানকে রক্ষা করা সম্ভব নয়।'

পশ্চিম পাকিস্তানি নেতা মিয়া মমতাজ দৌলতানা, শওকত হায়াৎ খান ও মওলানা মুফতি মাহমুদ এদিন ঢাকা আসেন। করাচিতে পিপিপি নেতা জে এ ভুট্টো বলেন, ক্ষমতার হিস্যা থেকে বঞ্চিত হলে তিনি চুপ করে বসে থাকবেন না। তিনি শক্তি প্রদর্শনে বাধ্য হবেন। সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ভবনে উপদেষ্টা পর্যায়ের বৈঠক হয়। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও ডক্টর কামাল হোসেন এবং সরকারের পক্ষে বিচারপতি এ আর কর্নেলিয়াস লে. জে. পীরজাদা ও কর্নেল হাসান অংশ নেন। দুই ঘণ্টাব্যাপী আলোচনায় দুই দলের উপদেষ্টারা কী ফর্মুলার ভিত্তিতে আলোচনা হবে অর্থাৎ 'টার্মস অব রেফারেন্স' নির্ণয় করেন।

শিল্পী কামরুল হাসানের পরিকল্পনা ও ডিজাইনে 'বাংলা স্টিকার একেকটি বাংলা অক্ষর এককটি বাঙালির জীবন' প্রথম প্রকাশিত হয়। এটি তরুণদের কাছে খুবই আকর্ষণীয় ছিল।

রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী তার '৭১ এর দশ মাস' বইয়ে আরও লিখেছেন- একাত্তরের ১৯ মার্চ অনেক মিছিল শেখ মুজিবের বাসভবনে যায়। বঙ্গবন্ধু তাদের উদ্দেশে বলেন, 'শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে হলেও আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে বাঁচার ব্যবস্থা করে যাব।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে