বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪, ৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

দ্রব্যমূল্যের লাগাম টেনে ধরতে একই ভুল

সাখাওয়াত হোসেন
  ১৯ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
দ্রব্যমূল্যের লাগাম টেনে ধরতে একই ভুল

বাজার নিয়ন্ত্রণে গত বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর দেশে প্রথমবারের মতো পেঁয়াজ, আলু ও ডিমের দাম বেঁধে দেয় সরকার। কিন্তু তা কার্যকর হয়নি। এর আগে চিনি ও ভোজ্যতেলের দাম নির্ধারণ করে সরকার ভোক্তাদের সামান্য স্বস্তি দেওয়ার চেষ্টা করলেও সে মিশনও সফল হয়নি। গত মাসে বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হলেও সেই দামের তেল আসেনি বাজারে। মিলে তদারকি আর নানামুখী অভিযানে কোনো সুফল পাওয়া যায়নি। চিনির দামের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা।

অথচ এসব ব্যর্থতার কারণ পর্যালোচনা না করে রমজানে সাধারণ মানের খেজুরের পর মাছ-মাংস, ডিম-ডাল ও সবজির মতো ২৯টি পণ্যের দাম বেঁধে দিয়েছে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। যা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বাজারকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলেছে। সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে পণ্য বিক্রি না করার অভিযোগে ভ্রাম্যমাণ আদালত গুটি কয়েক ব্যবসায়ীকে জরিমানা করায় ধর্মঘট পালনের ঘটনা ঘটেছে। হঠাৎ এমন ধর্মঘটে বিপাকে পড়েন ক্রেতারা।

বাজার পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সরকার এর আগেও কয়েকটি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেঁধে দিয়েছিল, কিন্তু সেগুলো খুব কমই কার্যকর হয়েছে। অথচ রমজানে দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়ার লাগাম টানতে আবারও সেই একই কৌশল নেওয়া হয়েছে। বিগত সময়ের মতো কর্তৃপক্ষ শুধু দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে, সেগুলো কার্যকর করার ব্যবস্থা নেয়নি। বাজারের প্রকৃত পরিস্থিতি বিবেচনা করে দাম নির্ধারণ করেনি। বাজার তদারকি সংস্থাগুলো সমন্বিতভাবে অভিযান না চালিয়ে যে যার মতো করে খুচরা বাজারে হানা দিয়ে ব্যবসায়ীদের হয়রানি করেছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এ উদ্যোগের ফলাফল বরাবরের মতো ব্যর্থ হতে চলেছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত ব্যবসায়ী, এনবিআর ও অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে বসে সমাধান বের করে ভোক্তাদের কিছুটা স্বস্তি দেওয়া- যোগ করেন বাজার বিশেষজ্ঞরা।

এ প্রসঙ্গে কৃষি অর্থনীতিবিদ রেজাউল করিম সিদ্দিক বলেন, 'পাগলা ঘোড়াকে একবার মাঠে ছেড়ে দেওয়ার পর তার লাগাম টেনে ধরা খুবই কঠিন। নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যমূল্যের ক্ষেত্রে আমরা আগে বাজার ছেড়ে দিয়েছি, সেখানে আমার কোনো কিছুই করিনি। এ সময়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে অতিরিক্ত মুনাফা অর্জনের লোভ তৈরি হয়েছে। বাজার নিয়ে তারা নানা খেলা খেলেছে। এ সময় আকস্মিক কিছু পণ্যের দাম বেঁধে দিয়ে তাদের নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করা হলে স্বাভাবিকভাবেই তা ব্যর্থ হবে।'

এই কৃষি অর্থনীতিবিদ মনে করেন, রমজানের শুরুতে এসে আকস্মিক কিছু পণ্যের দাম বেঁধে দিয়ে স্বল্প সময়ের জন্য ভোক্তাদের স্বস্তি দেওয়ার চেষ্টা বাস্তব সম্মত নয়। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে সারা বছরের জন্য মূল্য কমিশন তৈরি করে দেওয়া জরুরি। যাতে চাহিদা ও জোগান পর্যালোচনা করে তারা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের উপযুক্ত দাম নির্ধারণ করে দিতে পারে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ডিস্টিংগুইশড ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়ার সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে, বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা। তার মতে, উৎপাদক স্তর থেকে ভোক্তা স্তর এবং আমদানি স্তর থেকে ভোক্তা স্তর- এই দুই পর্যায়ে যারা মধ্যস্বত্বভোগী রয়েছেন, অনেক ক্ষেত্রে তাদের হাতে বাজারটা একচেটিয়াভাবে চলে গেছে। তারা বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করছে এবং এ কারণে যে মূল্যটা সেটা বাজারের প্রতিযোগিতার সক্ষমতার নিরিখে হচ্ছে না। তিনি বলেন, এই মধ্যস্বত্বভোগীরাই বাজারের মূল্য নির্ধারণ করছে এবং অনেক সময় সরবরাহকে প্রভাবিত করছে।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে অব্যবস্থাপনার বিষয়টিকে সামনে এনেছেন অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম রায়হানও। তিনি বলেন, অনেক ব্যবসায়ীরা একটা সাময়িক সরবরাহ সংকট তৈরি করে কোনো কোনো পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে ফেলে। যেটার কোনো যৌক্তিক কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। চিনি বা ভোজ্যতেলের মতো খাতে সরবরাহকারীর সংখ্যাও হাতেগোনা, মাত্র তিন-চারটি প্রতিষ্ঠান। এদের মধ্যে বাজারকে প্রভাবিত করার প্রবণতা আছে বলে মনে করেন তিনি। বাজারে অ্যান্টি-কমপিটিটিভ প্র্যাক্টিসের (প্রতিযোগিতাহীন অবস্থা) নিদর্শন পাওয়া যায়, অথচ এগুলোর বিরুদ্ধে তেমন কোনো শক্তিশালী পদক্ষেপ দেখা যায় না- যোগ করেন সেলিম রায়হান।

দেশের বাজারে তথ্য-উপাত্তভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়ে বড় ধরনের দুর্বলতা থাকার বিষয়টি তুলে ধরেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের ভাষ্য, বাজারে চাহিদা কত, সরবরাহ কত, উৎপাদন কত, আমদানি কতটুকু করতে হবে এবং সেটা কোন সময়ে করতে হবে, সেই আমদানিটা উন্মুক্তভাবে হচ্ছে কিনা- এসব তথ্যের ভিত্তিতে বেশির ভাগ সময়েই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় না। ফলে যথেচ্ছভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।

এদিকে ভোক্তাদের অধিকার নিয়ে কাজ করা কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ক্যাব মনে করে সিন্ডিকেট ভেঙে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষেত্রে সরকারের যথেষ্ট গাফিলতি আছে। ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করার ঘোষণা দেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পেঁয়াজের মূল্য দ্বিগুণ হওয়া এবং পেঁয়াজ আমদানির খবর পাওয়ার সঙ্গে দাম কমে যাওয়া প্রসঙ্গ টেনে ক্যাবের সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, আমরা মনে করি এটা সুশাসনের ঘাটতি।

তিনি অভিযোগ করেন, ব্যবসায়ীরা যেমন খুশি দাম নির্ধারণ করছে, সরকারের কোনো বিধিবিধানের তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। আর সরকারের বিভিন্ন বিভাগ যারা যুক্ত তাদের নীরবতার প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে।

তিনি বলেন, 'আমরা বারবার বলেছি, সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়ের একটা বার্ষিক পরিকল্পনা থাকতে হবে। কখন আমদানি করবে আর কখন দেশীয় উৎপাদন দিয়ে চাহিদা পূরণ হবে, এ রকম কোনো উদ্যোগ দেখিনি। কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকা সংযুক্ত অন্যান্য পণ্যের দামও বাড়িয়ে দিচ্ছে।'

এদিকে সত্যিকার অর্থে সরকার পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায় কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। তিনি বলেন, সরকার চাইলে সবকিছুই করতে পারে, যদি সদিচ্ছা থাকে। কারা এই বাজার কারসাজি করছে, সরকার যে জানে না, এমন নয়। এখন তারা সিন্ডিকেট ভাঙতে চায় কিনা, সেটিই প্রশ্ন। সেটি করতে গেলে আমদানিকারকের সংখ্যা বাড়াতে হবে। পণ্য সরবরাহ, পণ্যের দাম ইত্যাদি একটি ব্যবস্থাপনার মধ্যে আনতে হবে। এখন একটি পণ্যের দাম বাড়ল, তখন হইচই পড়ে গেল আর সেই পণ্যের জন্য দুই-একটা পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এরপর আরেকটা পণ্যের দাম বাড়ে, এরপর আরেকটা। এভাবে চলতেই থাকে। এটি এ দেশে নতুন কিছু নয়। এখন সামগ্রিক একটা ব্যবস্থাপনা বা কাঠামো থাকলে সিন্ডিকেটের সুযোগ নেওয়া কঠিন হতো। সেই ব্যবস্থাপনা থাকলে, প্রয়োজনের মুহূর্তে দ্রম্নত পণ্য আমদানি করা সম্ভব হয়। কোন দেশের পণ্য আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকে, কী ধরনের শুল্ক আরোপ করা হয়, কোন দেশ থেকে পণ্য আনতে কেমন সময় লাগবে- এ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হয়। এখন পণ্যের দাম বাড়ে, আমদানির সিদ্ধান্ত ও দ্রম্নত পদক্ষেপ নিতে নিতেই ভোক্তার পকেট খালি হয়ে যায়।

বাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, পণ্যের দাম যখন অনেক বেড়ে যায়, তখন শুল্ক কমিয়েও পরিস্থিতি কিছুটা সামাল দেওয়া যায়। তবে সেটার জন্য শক্ত নজরদারির প্রয়োজন হয়, যাতে সুবিধাটা ভোক্তারা পেতে পারে। অথচ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের এ ধরনের তৎপরতা নেই বললেই চলে।

এদিকে বাজার কারসাজির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানোও জরুরি বলে মনে করেন তারা। সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, প্রতিযোগিতা কমিশন বলে একটি প্রতিষ্ঠান আছে, যার কথা অনেকে জানে না। তাদের দক্ষতা ও মানবসম্পদ বাড়াতে হবে। আইনিভাবে এটিকে শক্তিশালী করতে হবে। তারা বিভিন্ন কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা করে, কিন্তু সেগুলোর নিষ্পত্তি হয় না। সিন্ডিকেট করার কারণে শাস্তির বিধান থাকলেও তার বাস্তবায়ন হয় না। শুধু জরিমানা দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করার কৌশলও সেকেলে বলে মন্তব্য করেন বাজার পর্যবেক্ষকরা।

এদিকে অর্থনীতিবিদ ও বাজার বিশ্লেষকেরা বলছেন, এভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেঁধে দিয়ে তা নিয়ন্ত্রণ করা অনেকটাই অসম্ভব। কেননা চলমান অস্থিতিশীল বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হলে যা করা জরুরি সে সুযোগ-সুবিধা ও সক্ষমতা বর্তমান সরকারের নেই। তাদের ভাষ্য দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে হলে প্রথমত, উৎপাদন ও পরিবহণ খরচ কমাতে গ্যাস, বিদু্যৎ ও ডিজেলের দাম কমানো দরকার। সরকারের পক্ষে সেটি কঠিন। দ্বিতীয়ত, আমদানি বাড়িয়ে বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়ানো দরকার; কিন্তু মার্কিন ডলারের সংকটে ব্যবসায়ীরা সহজে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারছেন না। ডলারের বাড়তি দামের কারণেও খরচ বেড়েছে। তৃতীয়ত, কিছু কিছু পণ্যে উচ্চ হারে শুল্ক-কর রয়েছে। সেখানেও ছাড় দেওয়া সরকারের পক্ষে সহজ নয়। কারণ সরকার রাজস্ব ঘাটতিতে রয়েছে।

২০২২ সালের মে মাসের দিকে দেশে মার্কিন ডলারের দাম ছিল ৮৬ টাকার আশপাশে। এখন আমদানিতে নির্ধারিত দর ১১০ টাকা। যদিও ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমদানির ক্ষেত্রে ডলার কিনতে তাদের ১২৪ টাকাও লাগছে। ফলে এ সময়ে শুধু ডলারের দামের কারণে পণ্য আমদানির ব্যয় বেড়েছে ৪৪ শতাংশ। গম, ডাল, ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ, রসুন, আদা ও জিরার মতো নিত্যপণ্য এবং নিত্যব্যবহার্য পণ্যের কাঁচামাল আমদানির ব্যয় বাড়িয়ে দিয়েছে ডলারের দর।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, দাম কমানো কখনোই সম্ভব হবে না। তবে মূল্যবৃদ্ধি, অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। তার মতে, সরবরাহ যেহেতু কম, সেহেতু ডলারের মূল্যবৃদ্ধির চেয়েও দেশে দর বেশি বেড়েছে। এতে বাড়তি মুনাফা করার সুযোগ পাচ্ছেন বড় ব্যবসায়ীরা। গম, ভোজ্যতেল, চিনিসহ বিভিন্ন পণ্যের ক্ষেত্রে এটা হচ্ছে।

আহসান মনসুর আরও বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের এখন একটিই কৌশল হতে পারে, সেটি হলো ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়িয়ে ১৬ থেকে ১৭ শতাংশে নিয়ে যাওয়া। সঙ্গে সরকারের বাজেট ব্যয় ১ লাখ কোটি টাকার মতো কমিয়ে ফেলতে হবে। এটা রাজনৈতিক সদিচ্ছার বিষয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে