স্থানান্তরিত হওয়ার পর ভারত মহাসাগরে সোমালি জলদসু্যদের কবলে পড়া কয়লাবাহী জাহাজ এমভি আবদুলস্নাহর সঙ্গে সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। জাহাজটিকে উপকূলের প্রায় ৪০ নটিক্যাল মাইল দূরে গভীর সাগরে নিয়ে গেছে জলদসু্যরা। এর আগে ১৪ মার্চ সকাল ৬টা পর্যন্ত জাহাজটি গারাকাড উপকূল থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছিল।
চট্টগ্রামের কবির গ্রম্নপের প্রতিষ্ঠান এসআর শিপিংয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেরুল করিম রোববার (১৭ মার্চ) দুপুরে এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ১
ভারতীয় নৌবাহিনীর দুটি যুদ্ধ জাহাজ পিছু নেওয়ার পর সোমালি জলদসু্যরা এমভি আবদুলস্নাহকে উপকূলের প্রায় ৪০ নটিক্যাল মাইল দূরে গভীর সাগরে নিয়ে গেছে।
এরপর থেকে জাহাজটির নাবিকেরা মালিকপক্ষের সঙ্গে আর যোগাযোগ করেননি। পরিবারের সঙ্গেও যোগাযোগ করতে পারেননি। জাহাজের ফোন না আসায় জিম্মি হওয়া নাবিকদের স্বজনদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। দসু্যরা নিজেরাও কোনো দাবি নিয়ে ফোন না করায় নাবিকসহ জাহাজটি উদ্ধারের আলোচনাও শুরু করা যাচ্ছে না।
মালিকপক্ষ তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে দসু্যদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে যাচ্ছে। তবে শনিবার রাত পর্যন্ত ইতিবাচক সাড়া মিলেনি। এমভি আবদুলস্নাহর মুক্তিপণের ব্যাপার নিয়ে মধ্যস্বত্বকারীদের ভূমিকা এবং দাবির বিষয়টি ঠিক করতে তারা হয়তো সময় নিচ্ছে মন্তব্য করে মেহেরুল করিম বলেন, তাদের ফোন না আসা পর্যন্ত জাহাজটির মালিকপক্ষের বেশি কিছু করার নেই।
তবে জাহাজটিতে যেহেতু ৫৫ হাজার টন কয়লা রয়েছে এবং কয়লা যে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ পণ্য, তা দসু্যদের বোঝানো সম্ভব হয়েছে। জাহাজটির হ্যাজে থাকা কয়লার তাপমাত্রা ঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে বিস্ফোরণ ঘটবে; যা শুধু জাহাজ কিংবা জিম্মি হওয়া নাবিকদের নয়, দসু্যদেরও বিপদের কারণ হবে। এজন্য জাহাজের নাবিকদের স্বাভাবিক কাজকর্ম করার ব্যাপারে দসু্যরা অনুমোদন দিয়েছে। শিপিং বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি ভালো খবর যে, কয়লায় যাতে বিস্ফোরণ না ঘটে সেজন্য নাবিকদের কোনো ক্ষতি দসু্যরা করবে না।
এদিকে চট্টগ্রামে অবস্থানকারী ক্যাপ্টেন আতিক খান জাহাজের এক নাবিকের ভয়েস মেসেজের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, এমভি আবদুলস্নাহর নাবিকেরা সবাই সুস্থ আছেন এবং সোমালি জলদসু্যদের অধীনেই রয়েছেন। ভারতীয় নৌবাহিনী ওদেরকে উদ্ধার করেছে এই সংবাদের সত্যতা নেই। মিডিয়ায় এই সংবাদটা দেখে ওরা দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। ওরা চান মানুষ সত্যটা জানুক।
ওই নাবিক জানান, সোমালি উপকূলে অগ্রসর হওয়ার সময় ইউরোপ ও ভারতীয় নেভির দুটি যুদ্ধজাহাজ সোমালি জলদসু্যদের থামতে বলেছে। ওয়ার্নিং দিয়ে ইঞ্জিন বন্ধ করতে বলেছে আর আশপাশে পানিতে গোলাগুলি করেছে। কিন্তু জলদসু্যরা নির্বিকার ছিল এবং ওদের কথা শোনার প্রয়োজন মনে করেনি।
এ সময় জলদসু্যরা মনে করেছিল বাংলাদেশের নাবিকরা ওদের ডেকে এনেছে। তাই ওরা কিছুটা রাগ করে সবাইকে ব্রিজে ডেকে বন্দুকের মুখে রেখেছিল। পরে ক্যাপ্টেন রেডিওতে ভারতীয় নেভিকে দূরে সরে যেতে বললে পরিস্থিতি শান্ত হয়।
ক্যাপ্টেন আতিক জানান, জলদসু্যদের দোভাষী হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী ব্যক্তি বাংলাদেশের টিভি আর মিডিয়ার ওপর চোখ রেখেছে। তাই গুজব রটানো বা নাবিকরা বিপদে পড়ে এমন কিছু যেন মিডিয়ার মাধ্যমে ছড়ানো না হয় সেদিকে সতর্ক থাকার জন্য জিম্মি ওই নাবিক অনুরোধ জানিয়েছেন।
এদিকে ইইউ ও ভারতীয় নৌবাহিনীর জাহাজ দুটি জিম্মি হওয়া জাহাজটির এক মাইলের মধ্যে থেকে সার্বক্ষণিক অনুসরণ করছে। শিপিং বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জিম্মি হওয়া নাবিকদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে ওই দুটি জাহাজ থেকে কোনো অভিযান পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না। কমান্ডো অপারেশন চালানোর মতো অবস্থাও নেই বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। অপরদিকে সোমালিয়ায় কোনো সাংবিধানিক সরকার ব্যবস্থা না থাকায় সরকারি পর্যায়ে আলোচনারও খুব বেশি সুযোগ নেই।
কারণ বিভিন্ন দল, উপদল, গোষ্ঠী এবং উপগোষ্ঠীতে বিভক্ত ক্ষমতাশালীরা নিজেরাও জাহাজ জিম্মির অনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িত। এদের অনেকেই জাহাজ ডাকাতির জন্য জলদসু্যদের পেছনে অর্থ বিনিয়োগ করে এবং আদায়কৃত পণের বড় অংশ হাতিয়ে নেয়। বিশ্বের নৌবাণিজ্য রুটের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠা অঞ্চলটিতে মূলত কারো একক নিয়ন্ত্রণ নেই।
সোমালিয়ার যে উপকূলে এমভি আবদুলস্নাহকে প্রথমে নোঙর করা হয়েছিল সেখানকার শাসনে যারা জড়িত তাদের সঙ্গে দসু্যদের সম্ভবত বনিবনা হয়নি। একই সঙ্গে ইইউ ও ভারতীয় নৌবাহিনীর যুদ্ধ জাহাজ পিছু নেওয়ার ফলে জাহাজটিকে দূরে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। জাহাজটিকে সরানোর পর থেকে নাবিকদের আর কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেওয়া হয়নি। ফলে জাহাজটির সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে রোববার পর্যন্ত নিশ্চিত করে কেউ কিছু বলতে পারেননি।
প্রায় দুই কোটি জনসংখ্যা অধু্যষিত সোমালিয়া গৃহযুদ্ধের পর থেকে বিধ্বস্ত একটি দেশ। আইনশৃঙ্খলা বা নিয়ম-কানুনের চর্চা বেশি নেই দেশটিতে। ঘরে ঘরে অস্ত্র। জলদসু্যতাই তাদের আয়ের একটি বড় অংশ দখল করে রয়েছে। বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ এ নৌরুটে নিয়মিত জাহাজ ছিনতাই এদের পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক বছর ধরে সোমালিয়ার জলদসু্যরা জাহাজ ছিনতাই এবং মুক্তিপণ আদায় করে আসছিল। বছরে গড়ে ২০০টিরও বেশি জাহাজ জিম্মি করার রেকর্ডও রয়েছে। বিশ্বের নৌবাণিজ্যের কথা চিন্তা করে সোমালিয়ার এই রুটে নিয়মিত টহল এবং অভিযান চালানো শুরু করেছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ ক্ষমতাশালী বাহিনী।
দক্ষ এবং অত্যাধুনিক নৌবাহিনীর অভিযানের মুখে সোমালি দসু্যরা গত বছর কয়েক দমে যায়। ২০২২ সালের মাঝামাঝি এসে দ্য ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব শিপিংসহ ছয়টি আন্তর্জাতিক শিপিং সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত একটি গ্রম্নপ সোমালিয়া উপকূলকে শিপিং সেক্টরের জন্য আর হুমকি নয় বলে ঘোষণা দেয়। তারা ভারত মহাসাগরের এই রুটকে জাহাজ চলাচলের জন্য নিরাপদ করায় সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ দেয়।
কারণ ২০১৮ সাল থেকে সোমালিয়ার জলদসু্যদের মাধ্যমে কোনো বাণিজ্যিক জাহাজে আক্রমণ হয়নি। কিন্তু চলতি বছরের শুরু থেকে লোহিত সাগরের হুথি হামলা ঠেকানোর তৎপরতায় সবার চোখ যখন ভারত মহাসাগর থেকে সরে যায়, তখন নতুন করে সোমালি দসু্যরা সাগরে নামে। গত তিন মাসে তারা বেশ কয়েকটি বড় জাহাজ জিম্মি করে। সোমালি জলদসু্যদের পাশাপাশি দেশটির বিভিন্ন এলাকার ক্ষমতাসীনদের পৃষ্ঠপোষকতায় দসু্যরা শক্তি সঞ্চয় করে সাগরে নামে। এতে করে শান্ত হওয়া রুটটি নতুন করে বিশ্বের শিপিং সেক্টরের মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে ওঠে।
ওই রুটে একাধিকবার যাতায়াতকারী শিপিং বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সোমালি দসু্যরা শুধু অর্থের জন্য নাবিকসহ জাহাজ অপহরণ করে। মুক্তিপণ হিসেবে পাওয়া অর্থের বড় অংশ চলে যায় ডাকাতদের পেছনে যারা অর্থ বিনিয়োগ করে তাদের হাতে। জলদসু্যদের যারা অর্থায়ন করে তারা স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী। তাই জাহাজ জিম্মি করে নিয়ে যাওয়ার পর সেটি অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করা সম্ভব হয় না। ডাকাতদের পেছনে অর্থ বিনিয়োগকারীরা পুরো প্রক্রিয়ার সাথে থাকে।
ইদ্রিস নামে একজন ক্যাপ্টেন বলেন, দর কষাকষি করে যে পণ আদায় করা হয় তার অন্তত ৩০ শতাংশ চলে যায় বিনিয়োগকারীদের হাতে। বিশাল অঙ্কের এই নগদ ডলারের লোভই জলদসু্যতাকে টিকিয়ে রেখেছে। যেসব দসু্য জাহাজে উঠে নাবিকদের জিম্মিসহ জাহাজটি দখল করে তারা ১-২ শতাংশের বেশি পায় না বলে জানান তিনি।
উলেস্নখ্য, গত ১২ মার্চ মঙ্গলবার দুপুর দেড়টার দিকে কবির গ্রম্নপের মালিকানাধীন এসআর শিপিংয়ের কয়লাবাহী জাহাজটি সোমালিয়ান জলদসু্যদের কবলে পড়ে। এই জাহাজের মাস্টার হিসেবে আছেন চট্টগ্রামের রাশেদ মোহাম্মদ আব্দুর, চিফ অফিসার হিসেবে আছেন চট্টগ্রামের খান মোহাম্মদ আতিক উলস্নাহ, সেকেন্ড অফিসার হিসেবে আছেন চট্টগ্রামের চৌধুরী মাজহারুল ইসলাম, থার্ড অফিসার হিসেবে আছেন ফরিদপুরের ইসলাম মো. তারেকুল, ডেক ক্যাডেট হিসেবে আছেন টাঙ্গাইলের হোসাইন মো. সাব্বির।
এছাড়া চিফ ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে আছেন নওগাঁর শাহিদুজ্জামান এএসএম, সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার খুলনার ইসলাম মো. তৌফিকুল, থার্ড ইঞ্জিনিয়ার নেত্রকোনার উদ্দিন মো. রোকন, ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার চট্টগ্রামের আহমেদ তানভীর, ইঞ্জিন ক্যাডেট লক্ষ্ণীপুরের খান আইয়ুব, ইলেকট্রিশিয়ান উলস্নাহ ইব্রাহিম খলিল, এবিল সি-ম্যান (নাবিক) নোয়াখালীর হক মোহাম্মদ আনোয়ারুল, চট্টগ্রামের রহমান মো. আসিফুর, হোসাইন মো. সাজ্জাদ, অর্ডিনারি সি-ম্যান (সাধারণ নাবিক) নাটোরের মোহাম্মদ জয়, সিরাজগঞ্জের হক মো. নাজমুল, অয়লার হিসেবে আছেন চট্টগ্রামের হক আইনুল, চট্টগ্রামের শামসুদ্দিন মোহাম্মদ, বরিশালের হোসাইন মো. আলী, ফায়ারম্যান চট্টগ্রামের শাকিল মোশাররফ হোসেন, চিফ কুক চট্টগ্রামের ইসলাম মো. শফিকুল, জেনারেল স্টুয়ার্ড চট্টগ্রামের মোহাম্মদ নূর উদ্দিন ও ফাইটার হিসেবে আছেন নোয়াখালীর আহমেদ মোহাম্মদ সালেহ।