রোববার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১
অগ্নিঝরা মার্চ

ছয় দফার ভিত্তিতে সংবিধান প্রণয়নে অটল বঙ্গবন্ধু

যাযাদি রিপোর্ট
  ১৭ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
আপডেট  : ১৭ মার্চ ২০২৪, ০০:১০
ছয় দফার ভিত্তিতে সংবিধান প্রণয়নে অটল বঙ্গবন্ধু

একাত্তর সালের মার্চের ১৭ তারিখ ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের মধ্যে তৃতীয় দিনের মতো বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে বঙ্গবন্ধু জনগণের গণতান্ত্রিক রায়ের ভিত্তিতে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং ছয় দফার ভিত্তিতে সংবিধান প্রণয়নের প্রশ্নে অটল থাকেন।

অন্যদিকে ইয়াহিয়া খান জনগণের ভোটে নির্বাচিতদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানান। ফলে বৈঠকে শুরু হয় অচলাবস্থা। একপর্যায়ে বঙ্গবন্ধু ও ইয়াহিয়া খানের মধ্যে আলোচনা ভেঙে যায়। বৈঠক শেষে প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে বঙ্গবন্ধুর গাড়ি বের হয়ে আসে। আগের মতোই বঙ্গবন্ধুর সাদা গাড়ির এক পাশে কালো পতাকা এবং অপর পাশে শোভা পাচ্ছিল বাংলাদেশের প্রস্তাবিত মানচিত্র খচিত পতাকা।

রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী '৭১ এর দশ মাস' বইতে এ দিনের ঘটনাবলি সম্পর্কে উলেস্নখ করেন, বৈঠক

থেকে বেরিয়ে আসার পথে সাংবাদিকরা বঙ্গবন্ধুর গাড়ি ঘিরে ধরে আলোচনার ফলাফল সম্পর্কে জানতে চান। তখন জাতির পিতা গাড়ি থেকে নেমে বেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের বলেন, 'আলোচনার ফলাফল বলার সময় আসেনি।' এর পরই সাংবাদিকের এক প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, 'সংগ্রাম জোরদার হতে পারে।'

সেখান থেকে বঙ্গবন্ধু নিজের বাসভবনে গেলে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের অনুরোধে তিনি তাদের সঙ্গে এক ঘরোয়া বৈঠকে মিলিত হন। একজন সাংবাদিক জানতে চান বৈঠক সংক্ষিপ্ত হলো কেন? জবাবে বঙ্গবন্ধু মৃদু হাসেন। আরেক বিদেশি সাংবাদিক বলেন, 'এই হাসি থেকে আমরা কী কিছু অনুমান করে নিতে পারি?' জবাবে শেখ মুজিব বলেন, 'আপনার মুখেও তো মৃদু হাসি। আমি জাহান্নামে বসেও হাসতে পারি।'

একাত্তরের ১৭ মার্চ ছিল বঙ্গবন্ধুর ৫২তম জন্মদিন। জন্মদিনে বঙ্গবন্ধুর কামনা কী, জনৈক বিদেশি সাংবাদিকের এই প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, 'জনগণের সার্বিক মুক্তি।'

সাংবাদিকদের অপর এক প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, 'আমি জনগণেরই একজন। আমার জন্মদিনই কী, আর মৃতু্যদিনই কী! আমার জনগণের জন্যই আমার জীবন ও মৃতু্য। আপনারা আমাদের জনগণের অবস্থা জানেন। অন্যের খেয়ালে যে কোনো মুহূর্তে আমাদের মৃতু্য হতে পারে।'

এইদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ছাত্র-জনতা এবং ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতাসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গিয়ে তাকে ৫২তম জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানান।

এদিকে, বঙ্গবন্ধু-ইয়াহিয়ার বৈঠক ভেঙে যাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে ঢাকার রাজপথে জনতার ঢল নামে। বায়তুল মোকাররম মসজিদ এলাকায় ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিবাদ সমাবেশে ছাত্র নেতারা ঘোষণা করেন, 'বাংলার মানুষ এখন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। আর কোনো বৈঠক দরকার নেই। স্বাধীনতা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই।'

একাত্তরের আজকের দিনেই টিক্কা খান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে উত্থাপিত নৃশংস কার্যকলাপের অভিযোগ তদন্তের নির্দেশ দিলে বঙ্গবন্ধু তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, 'সামরিক কর্তৃপক্ষ নিযুক্ত তদন্ত কমিশন মানি না।'

অসহযোগ আন্দোলনের ১৬তম দিনে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ছাত্রছাত্রীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ময়দানসহ বিভিন্ন এলাকায় কুচকাওয়াজ ও রাইফেল চালানোর প্রশিক্ষণ শুরু করেন।

এছাড়া ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসকে 'প্রতিরোধ দিবস' হিসেবে পালনের জন্য স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ কর্মসূচি ঘোষণা করে। এ উপলক্ষে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতারা ওইদিন সকাল ৬টায় সরকারি-বেসরকারি অফিস, আদালত, শিক্ষা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং সব যানবাহনে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন, প্রভাতফেরি, শহীদ মিনারে পুষ্পমাল্য অর্পণ, জয় বাংলা বাহিনীর কুচকাওয়াজ এবং বিকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বটতলায় ছাত্র-জনসভার কর্মসূচি ঘোষণা করে।

এদিন গভীর রাতে ঢাকায় পাকিস্তান জেনারেলদের গোপন বৈঠক বসে। মূলত ইয়াহিয়া খানের আলোচনা নাটকের আড়ালেই চলতে থাকে ইতিহাসের নৃশংস হত্যাকান্ডের পরিকল্পনা। এ রাতেই প্রেসিডেন্ট ভবনে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে টিক্কা খানের বৈঠক হয়। গভীর রাতেই জেনারেল খাদেম হোসেন রাজাকে চূড়ান্ত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। ঢাকায় সামরিক জান্তার বৈঠকে বাঙালি হত্যার নীলনকশা 'অপারেশন সার্চলাইট' চূড়ান্ত করা হয় এদিনই। বাঙালিকে দমিয়ে রাখতে দীর্ঘ সময় ধরে সব ধরনের ষড়যন্ত্রেরই আশ্রয় নেয় সামরিক জান্তা।

তথ্যসূত্র :'৭১ এর দশ মাস', রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী, গতিধারা ১৯৯৭, ঢাকা ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে