বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪, ৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

অবন্তিকার আত্মহত্যা :সহপাঠী ও শিক্ষককে গ্রেপ্তারে আল্টিমেটাম

আবু সাঈদ চৌধুরী, জবি
  ১৭ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
আপডেট  : ১৭ মার্চ ২০২৪, ০০:১০
ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকা

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকার আত্মহত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত তার সহপাঠী আম্মান সিদ্দিকী ও শিক্ষক দ্বীন ইসলামকে গ্রেপ্তারে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। এই দাবি পূরণ না হলে সোমবার উপাচার্য কার্যালয় ঘেরাওয়ের হুঁশিয়ার উচ্চারণ করেছেন তারা। এদিকে অভিযুক্ত সহপাঠী ও শিক্ষককে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। পাশাপাশি তার সহপাঠী আম্মানকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ এবং ঘটনা তদন্তে ৫ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ড. মো. আইনুল ইসলাম এবং জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ

\হফিরোজ আলম স্বাক্ষরিত পৃথক চারটি অফিস আদেশে এসব বিষয় জানানো হয়েছে।

শনিবার বিকাল ৩টার দিকে অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূূলক শাস্তির দাবিতে ক্যাম্পাসের শান্ত চত্বর বিক্ষোভ মিছিল করেন জবির শিক্ষার্থীরা। মিছিলটি ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে ভিক্টোরিয়া পার্ক এলাকা ঘুরে ফের শান্ত চত্বরে এসে সমাবেশে রূপ নেয়।

বিক্ষোভ সমাবেশে অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী রেজোয়ানুল হক বলেন, 'আজকের বিক্ষোভ থেকে আমরা ছয় দফা দাবি জানাচ্ছি। আমাদের প্রথম দাবি হলো, এ হত্যার সুষ্ঠু বিচার করতে হবে, দ্বিতীয় দাবি অভিযুক্ত আম্মান ও দীন ইসলামকে দ্রম্নত গ্রেপ্তার করতে হবে। তৃতীয় দাবি হলো- জরুরিভিত্তিতে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে স্থায়ী বহিষ্কার করতে হবে, চতুর্থ দাবি হলো ভিক্টিমের পরিবারের নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে, পঞ্চম দাবি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিপীড়ন বিরোধী সেলকে স্বাধীন করতে হবে এবং আমাদের সর্বশেষ দাবি হলো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে বাদী হয়ে মামলা করতে হবে।'

নাট্যকলা বিভাগের ১২তম আবর্তনের শিক্ষার্থী সোমা সুমাইয়া বলেন, 'আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দাবি না মানলে আমরা সোমবার ভিসি ভবন অবরোধ করব। আমরা তদন্ত কমিটির পাঁচজনের মধ্যে দুজনকে নিয়ে সন্ধিহান।'

সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী রাফি আল মাহমুদ বলেন, 'আমাদের কাছে থেকে ছয়টি দাবি প্রশাসনের কাছে দেওয়া হয়েছে। যদি এই ছয়টি দাবি না মানা হয়, তাহলে আমরা আরও কঠোর পদক্ষেপ নেব। এর সুষ্ঠু সমাধান ও তদন্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি না করে- আমাদের আন্দোলন চলতেই থাকবে।'

অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ ফিরোজ আলম স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০০৫ এর ধারা ১১ (১০) মোতাবেক আইন বিভাগের শিক্ষার্থী রায়হান সিদ্দিকি আম্মানকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে যা ১৬ মার্চ থেকে কার্যকর হবে। একই ধারার ক্ষমতাবলে ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক দ্বীন ইসলামকে সহকারী প্রক্টরের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে।

এছাড়া ঘটনা তদন্তে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৫ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। গঠিত কমিটিতে রয়েছেন শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. জাকির হোসেন (আহ্বায়ক), সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. আবুল হোসেন, আইন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. এসএম মাসুম বিলস্নাহ, সঙ্গীত বিভাগের চেয়ারম্যান ড. ঝুমুর আহমেদ এবং ডেপুটি রেজিস্ট্রার (আইন) অ্যাডভোকেট রঞ্জন কুমার দাস (সদস্য সচিব)। কমিটিকে অতি দ্রম্নত সময়েই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তরের বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, অভিযুক্ত শিক্ষার্থী রায়হান সিদ্দিকি আম্মানকে গ্রেপ্তারের জন্য ইতোমধ্যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে জবির প্রক্টর অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, 'আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে রাতেই এ বিষয়ে তাদের যে প্রক্রিয়া আছে সেই মোতাবেক ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। তারা তাদের প্রক্রিয়া মোতাবেক সবকিছু করবে।'

শিক্ষার্থী আত্মহত্যার ঘটনার অভিযুক্ত জবির আইন বিভাগের শিক্ষার্থী আম্মান সিদ্দিকী বলেন, 'আমি দীর্ঘদিন ধরে উনার সাথে কোনো প্রকার যোগাযোগ করিনি। এমনকি ফেসবুক, মেসেঞ্জার বা কোনো জায়গাতেই কানেক্টেড নই আমি। আমাকে দোষী প্রমাণের জন্য এভিডেন্স লাগবে। এভিডেন্স ছাড়া এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন।'

এছাড়া অন্য অভিযুক্ত জবির সহকারী অধ্যাপক দ্বীন ইসলাম বলেন, 'এর সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। মেয়েটার সঙ্গে দেড় বছর আগে আমাদের কথা হয়েছে। আমি চাই এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হোক।'

কুমিলস্নায় থামছে না মায়ের বিলাপ

অন্যদিকে কুমিলস্নায় নিজ বাড়িতে ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকার মা তাহমিনা শবনম বলেন, 'মেয়ে যে আত্মহত্যা করবে তা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি। রাত সাড়ে ৯টার দিকে আমাকে পানি দিয়ে গেল এক গস্নাস। এর কিছুক্ষণ পর ওর রুমে ফ্যানের শব্দ না পেয়ে ডাকাডাকি করি। কোনো সাড়া মেলেনি। পরে আমার ছেলে দারোয়ানকে নিয়ে মই দিয়ে পূর্ব পাশের জানালা খুলে ফ্যানের সঙ্গে অবন্তিকাকে ঝুলে থাকতে দেখে।'

তিনি বলেন, 'এরপর পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা পুলিশের একজন সদস্যসহ মেয়েকে নামিয়ে প্রথমে কুমিলস্না সদর হাসপাতালে ও পরে কুমিলস্না মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানে চিকিৎসক অবন্তিকাকে মৃত ঘোষণা করেন।'

শবনমের অভিযোগ, তার মেয়ের সহপাঠী আম্মান সিদ্দিকী নানাভাবে তাকে উৎপীড়ন করতে থাকলে সে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামের কাছে নালিশ করেছিলেন।

তিনি বলেন, 'কিন্তু সহকারী প্রক্টর ঘটনার বিচার করেননি, উল্টো মেয়েকে ডেকে নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করেন। ওই ছেলের পক্ষ নেন তিনি। তখন আম্মান সিদ্দিকী আরও বেপরোয়া হয়ে পড়েন। আপত্তিকর মন্তব্য করতেন, হুমকি দিতেন। এসব ঘটনার বিচার চেয়ে না পেয়ে আমার মেয়ে আত্মহত্যা করেছে।'

তাহমিনা শবনম বলেন, 'মাত্র এক বছর আগেই স্বামীকে হারিয়েছি এবার ছেড়ে চলে গেল পরম আদরের মেয়ে। আমার মেয়েকে অভিযুক্ত শিক্ষক ও তার সহপাঠীরা মানসিকভাবে নির্যাতন করেছে। এ বিষয়ে বারবার অভিযোগ দিয়েও কোনো প্রতিকার পাইনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে। আমি এই ঘটনার বিচার দাবি করছি।'

কুমিলস্নায় প্রতিবাদ

অবন্তিকার আত্মহত্যার ঘটনা তদন্ত করে দোষীদের শাস্তির দাবিতে শনিবার দুপুরে কুমিলস্না নগরীর পূবালী চত্বরে মানববন্ধন করেছে বিভিন্ন সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন।

এতে অংশ নেন বাংলা সংস্কৃতি বলয়, বাংলাদেশ ইয়ুথ ক্যাডেট ফোরাম, রং-তুলি যুব ফাউন্ডেশন, আলো যুব মহিলা কল্যাণ সংস্থা, প্রত্যাবর্তন, তারুণ্যের বাংলাদেশ, নিরাপদ চালক চাই, দেশ কল্যাণ সংস্থা, ভিবিডি কুমিলস্না, নবাব ফয়জুন্নেসা ফাউন্ডেশন, কুমিলস্না কলেজ থিয়েটার, ভিক্টোরিয়া কলেজ থিয়েটার, ইয়ুথ ফর পারপাস, কুমিলস্না সাইক্লিস্ট ফোরাম ও জুনিয়র ফ্রেন্ডার্স ক্লাবের প্রতিনিধিরা।

বাবার কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত

শনিবার বিকাল ৪টার দিকে কুমিলস্না নগরীর শাসনগাছায় পারিবারিক কবরস্থানে ফাইরুজ অবন্তিকার মরদেহ দাফন সম্পন্ন হয়েছে। তার বাবা অধ্যাপক জামাল উদ্দিনের কবরের পাশেই তাকে দাফন করা হয়েছে।

এর আগে বিকাল ৩টার দিকে কুমিলস্না সরকারি কলেজ মাঠে অবন্তিকার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। কুমিলস্না সরকারি কলেজ জামে মসজিদের ইমাম আবু মুসার ইমামতিত্বে এতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মেফতাহুল হাসান, কুমিলস্না মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সৈয়দ নূরুর রহমানসহ কুমিলস্নার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার অসংখ্য মানুষ অংশ নেন।

জানাজার আগে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মেফতাহুল হাসান বলেন, 'অবন্তিকা খুবই মেধাবী শিক্ষার্থী ছিল। তাকে হারানোর মধ্য দিয়ে আমরা একটি সম্পদ হারালাম। এ ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শক্ত অবস্থানে আছে। বিশেষ করে উপাচার্য সাদেকা হালিম ম্যাডাম শুক্রবার রাতেও ক্যাম্পাসে এসেছিলেন। ইতোমধ্যে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি অবন্তিকার সঙ্গে যা যা হয়েছে সেগুলো সঠিক তদন্তের মাধ্যমে বের করে দোষীদের শাস্তির আনা হবে।'

কুমিলস্না মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ নূরুর রহমান বলেন, 'আমাদের মেয়ে অবন্তিকাকে মৃতু্যর মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। বাবা-মা অনেক শখ করে দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন। অবন্তিকা একজন উপস্থাপিকা ছিল, সে আর্ট করতো। একটা প্রাণবন্ত মেয়ে ছিল। গত দুই বছর যাবৎ সে তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রচন্ড হয়রানির শিকার হয়েছিল। আমরা আজকের এই জানাজা থেকে এই বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করছি। জড়িতদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেওয়ার অনুরোধও জানাই।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে