বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪, ৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

ফের লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণা

বাড়ছে ভোগান্তি কমছে উৎপাদন
সাখাওয়াত হোসেন
  ১৭ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
আপডেট  : ১৭ মার্চ ২০২৪, ০০:০৯
ফের লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণা

দেশে গরম বাড়ার সঙ্গে পালস্না দিয়ে আবাসিক, বাণিজ্যিক ও শিল্পকারখানায় লোডশেডিং বাড়তে শুরু করেছে। এতে জনভোগান্তি যেমন বাড়ছে, তেমনি শিল্প কারখানায় উৎপাদন কমছে। গ্রামাঞ্চলে ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে সেচ কাজ স্বাভাবিক রাখতে না পারায় ফসল উৎপাদন বিঘ্নিত হচ্ছে। বিপাকে হ্যাচারি ও পোলট্রি খাত; ব্যয় বেড়েছে কুটির ও মাঝারি শিল্পে।

সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, সামনে গরম আরও বাড়লে লোডশেডিংয়ের ভোগান্তি আরও বাড়বে। এ ছাড়া গ্যাস সংকটের কারণে বিদু্যৎ উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হলে পরিস্থিতি আরও বেসামাল হয়ে পড়বে। এই পরিস্থিতিতে শিল্পকারখানার উৎপাদন, সেচ কাজ ও বিভিন্ন বাণিজ্যিক কার্যক্রম কতটা স্বাভাবিক রাখা সম্ভব হবে, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন অনেকেই।

এদিকে ঢাকাসহ সারাদেশে ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে জনজীবনে ভোগান্তি বাড়লেও বাংলাদেশ বিদু্যৎ উৎপাদন বোর্ড (বিপিডিবি) ভিন্ন কথা বলছে। তাদের দাবি, এখন পর্যন্ত কোথাও তেমন লোডশেডিং হয়নি। বিপিডিবির ওয়েব সাইটের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ১৩ মার্চ দিনের পিক সর্বোচ্চ উৎপাদন ১১ হাজার ৫১৫ মেগাওয়াট এবং সন্ধ্যায় সর্বোচ্চ উৎপাদন ১২ হাজার ৬২১ মেগাওয়াট। এ সময় বিদু্যতের সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ১২ হাজার ৭৮০ মেগাওয়াট। এই হিসাবে ওই সময় লোডশেডিং ছিল ১৫৯ মেগাওয়াট। এদিন ময়মনসিংহে ১৫২ মেগাওয়াট লোডশেডিং হলেও দেশের অন্য কোথাও কোনো লোডশেডিং ছিল না। অথচ ঢাকা, খুলনা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ইফতার-সেহ্‌রির পাশাপাশি বিভিন্ন সময় কয়েক দফা লোডশেডিংয়ের খবর পাওয়া গেছে।

বিপিডিবির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৩ মার্চ ফোর্সড শাটডাউন ছিল বড়পুকুরিয়া এসটি ইউনিট ১ ও ২, ঘোড়াশাল-৩,৫,৭; শাহাজিবাজার ৩৩০ মেগাওয়াট; বাঘাবাড়ি-৭১, ১০০ মেগাওয়াট; রাউজান ইউনিট-২; সিদ্ধিরগঞ্জ ২১০ মেগাওয়াট ও আশুগঞ্জ উত্তর।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জ্বালানি সংকটের কারণে চাহিদা অনুযায়ী বিদু্যৎ উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে না। এ ছাড়া চলছে সেচ মৌসুম। এ কারণে বিদু্যতের চাহিদা বেড়েছে। রমজানে সর্বোচ্চ চাহিদার সময় ইফতার ও তারাবির সময় তাই তেলভিত্তিক কেন্দ্র চালানো হচ্ছে।এরপরও এই দুই সময় লোডশেডিং হচ্ছে।

পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থানে লোডশেডিংয়ের জন্য দায়ী ট্রান্সমিশন ও জ্বালানির সীমাবদ্ধতা। জ্বালানি সীমাবদ্ধতার কারণে বেশি দামে ফার্নেস অয়েলনির্ভর বিদু্যৎকেন্দ্রগুলো চালানো হচ্ছে। এ ছাড়া বিদু্যৎ উৎপাদনের জন্য যে পরিমাণ গ্যাসের প্রয়োজন, তা পাওয়া যাচ্ছে না।

গত এক সপ্তাহের লোডশেডিংয়ের চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, লোডশেডিং প্রতিদিনই ধাপে ধাপে বাড়ছে। =

গত ৭ মার্চ দেশে লোডশেডিংয়ের পরিমাণ ছিল ৮৩ মেগাওয়াট, ৮ মার্চ ৯৩ মেগাওয়াট, ৯ মার্চ ৯৬ মেগাওয়াট, ১০ মার্চ ৮০ মেগাওয়াট, ১১ মার্চ ১৪৯ মেগাওয়াট এবং ১২ মার্চ ৯০ মেগাওয়াট এবং ১৩ মার্চ ১৫৯ মেগাওয়াট। ১৬ মার্চ সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বিপিডিবির ওয়েব সাইটে ১৪ মার্চ ও ১৫ মার্চের উৎপাদন ও লোডশেডিংয়ের কোনো তথ্য আপলোড করা হয়নি।

এদিকে শহরের চেয়ে গ্রামাঞ্চলে লোডশেডিং যে অনেক বেশি, তা সেখানকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে স্পষ্ট চিত্র পাওয়া গেছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা জানান, গত কয়েক বছরে মফস্বলে বিদু্যৎনির্ভর ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পকারখানার যে প্রসার ঘটেছে, তা ফিকে হতে বসেছে। থমকে দাঁড়িয়েছে হ্যাচারি ও পোলট্রি খাত। বন্ধের পথে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প উদ্যোগ। লোকসান গুনে ব্যবসা ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন তরুণ উদ্যোক্তারা। তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক ফ্রিল্যান্সিং ও স্টার্টআপ খাতের অগ্রযাত্রায় পড়েছে ছেদ; বাড়ছে বেকারত্ব। গত কয়েক বছরে বিদু্যৎনির্ভর গ্রামীণ অর্থনীতির পালে যে দুর্বার হাওয়া লেগেছিল, তা টেকসই হওয়া নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন সংশ্লিষ্টরা।

মফস্বল শহরের ছোট ছোট কারখানার মালিকরা জানান, দিন-রাত মিলিয়ে কয়েক দফা লোডশেডিং হচ্ছে। ডিজেল পুড়িয়ে জেনারেটর চালিয়ে কারখানা চালু রাখতে গিয়ে প্রতিদিন ২০-২৫ হাজার টাকা বাড়তি খরচ হচ্ছে। যা বাধ্য হয়ে উৎপাদন খরচের সঙ্গে যোগ করে মালের মূল্য নির্ধারণ করতে হবে।

কনজু্যমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেছেন, 'সরকার শতভাগ বিদু্যতায়নের কথা জোরেশোরে বললেও বাস্তবতা ভিন্ন। গ্রামের মানুষ ঠিকমতো বিদু্যৎ পায় না। একটি গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতে সরকার একের পর এক অপরিকল্পিত বিদু্যৎকেন্দ্র করেছে। এসব কেন্দ্রের অধিকাংশ উৎপাদন না করেও বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা পকেটে ভরছে। এই লোকসান কমাতে বারবার বাড়ানো হচ্ছে দাম। কিন্তু মানুষ বাড়তি অর্থ খরচ করেও বিদু্যতের দেখা পাচ্ছে না।'

যদিও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের আমলাদের দাবি, চাহিদা অনুসারে সারাদেশে বিদু্যৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। কোথাও লোডশেডিং নেই। গ্রামে কিছু সমস্যা রয়েছে। তবে এটি লোডশেডিং নয়, বিতরণ লাইনজনিত বিভ্রাটের কারণে এমন হচ্ছে।

এদিকে গ্রামাঞ্চলে গড়ে ওঠা মুরগির খামারি জানান, লোডশেডিংয়ের কারণে গরমে মুরগি মারা যাচ্ছে। ব্যাহত হচ্ছে ডিম ও বাচ্চা উৎপাদন। ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে জেনারেটর ও সৌরবিদু্যৎ ব্যবহার করছেন। এতে বাড়ছে উৎপাদন খরচ।

এ ছাড়া বিদু্যৎ সংকটে চলতে পারছে না হ্যাচারিগুলো। ধুঁকছে কাঁকড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ ও হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান। ডিজেলচালিত জেনারেটর ব্যবহারের কারণে উৎপাদন ব্যয় প্রায় ২৫ ভাগ বেড়ে গেছে।

অন্যদিকে ঘন ঘন বিদু্যৎ যাওয়ায় চাহিদামতো সেচ দিতে পারছেন না কৃষকরা। পানির অভাবে ফসলের ক্ষেত ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। কৃষকরা বলেছেন, বৃষ্টি না হলে বা সেচের মাধ্যমে সময়মতো ক্ষেতে পানি না দিলে চারা মরে যাবে; ব্যাহত হবে ফসল উৎপাদন।

দফায় দফায় লোডশেডিংয়ের কারণে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকারখানার উদ্যোক্তারা চরম বিপদে পড়েছেন। উৎপাদন কমে গেছে। অনেকে কর্মচারী ছাঁটাই করেছেন। ফলে রুদ্ধ হচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশ। বিদু্যৎ কাজে লাগিয়ে গ্রামগঞ্জে যারা ফটোকপি, কম্পিউটার-ইন্টারনেট সেবার মতো ছোট ছোট ব্যবসা গড়ে তুলেছেন। লোডশেডিংয়ের কারণে এ ধরনের ব্যবসায়ীদের এখন চরম বিপাকে। ঘন ঘন লোডশেডিং হওয়ায় তারা ঠিকমতো ফটোকপি, কম্পোজ ও প্রিন্টের কাজ করতে পারছেন না।

লোডশেডিংয়ের কারণে বরফকলগুলো ঠিকমতো চলছে না। সাগর ও হাওড় এলাকার জেলেরা বিপদে পড়েছেন। মাছ সংরক্ষণে সমস্যা হচ্ছে। বরফের দামও বেড়ে গেছে। বরফকল মালিকরা জানান, বর্তমানে সাগরগামী ট্রলারে বরফের চাহিদা বেশি। কিন্তু লোডশেডিংয়ের কারণে বরফ হচ্ছে না। চাহিদার অর্ধেক বরফ দিয়েই জেলেদের বিদায় করতে হচ্ছে।

বিদু্যৎ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানান, বিশ্ববাজারে অস্থিরতা ও দেশে ডলার সংকটের কারণে বিদু্যৎ উৎপাদনের প্রয়োজনীয় রসদ আমদানি করা যাচ্ছে না। এরই মধ্যে এলএনজি আমদানি কমেছে অর্ধেকে। সরকার মোট জ্বালানির ২০ শতাংশ গ্যাস আমদানি করত। একটি এফএসআরইউ নিয়মিত সার্ভিসিংয়ে থাকায় গ্যাস সরবরাহ ১০ শতাংশ কমে গেছে। সার্ভিসিংয়ে থাকা এফএসআরইউ ৩০ মার্চের আগে আসবে না। এতে কিছুটা সংকট রয়ে গেছে। নিজস্ব যা ছিল তার থেকেও প্রায় ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট উৎপাদন কমে গেছে। এ কারণেই লোডশেডিং বাড়ছে।

এদিকে গরম আরও বাড়লে বড় ধরনের বিদু্যৎ ঘাটতি দেখা দেবে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। আমাদের দেশে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠকে গ্রীষ্মকাল ধরা হয়। সেই হিসাবে গ্রীষ্ম আসতে আরও এক মাস বাকি। তবে এখনই গরম পড়তে শুরু হয়েছে। বেড়েছে বিদু্যতের চাহিদা। ফলে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে ফের লোডশেডিং শুরু হয়েছে।

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার এ প্রসঙ্গে বলেন, একটি এলএনজি টার্মিনাল রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বন্ধ রয়েছে। চলতি মাসের শেষ সপ্তাহে এটি চালু হতে পারে। তখন গ্যাস সরবরাহ বাড়বে। সে সময় বিদু্যৎ খাতে ১১০-১২০ কোটি ঘনফুট গ্যাস দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য খাতেও সরবরাহ বাড়বে। সেচ ও গ্রীষ্ম মৌসুমে বিদু্যতের চাহিদা মেটাতে সরকারের বড় ভরসার জায়গা রামপাল, পায়রা ও ভারতে আদানির কয়লাভিত্তিক বিদু্যৎকেন্দ্র। এর বাইরে মে-জুনে চট্টগ্রামে এস আলমের বিদু্যৎকেন্দ্র এবং বরগুনার বরিশাল বিদু্যৎকেন্দ্র থেকে বিদু্যৎ পাওয়ার আশা করছে সরকার। আদানি ছাড়াই কয়লা দিয়ে আগামী মে-জুনে দুই হাজার ৮৬৫ মেগাওয়াট বিদু্যৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে। এর মধ্যে বড়পুকুরিয়া থেকে ৩২৫ মেগাওয়াট আসবে। আমদানি করা কয়লা থেকে হবে দুই হাজার ৫৪০ মেগাওয়াট। এর বাইরে আগামী ২৬ মার্চ থেকে আদানির কড্ডা বিদু্যৎকেন্দ্র থেকে দিনে ৭৫০ মেগাওয়াট করে বিদু্যৎ পাওয়ার কথা। কিন্তু প্রয়োজনীয় ডলার না থাকায় কয়লা ও এলএনজি আমাদানি করতে পারছে না সরকার। ফলে আসন্ন গ্রীষ্মের লোডশেডিং মোকাবিলায় কোনো প্রস্তুতিই কাজে আসছে না। এবার গ্রীষ্ম মৌসুমে সর্বোচ্চ বিদু্যৎ চাহিদা ধরা হয়েছে প্রায় ১৮ হাজার মেগাওয়াট।

এদিকে গত বছরের চেয়ে চাহিদা বেড়েছে ১১ শতাংশের মতো। একই সময় বিদু্যৎ উৎপাদন সক্ষমতাও বেড়েছে একই হারে। তবে গত বছরের মতোই সক্ষমতার বড় একটি অংশ বসিয়ে রাখতে হতে পারে জ্বালানির অভাবে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ইজাজ হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, একের পর এক অপরিকল্পিত বহু বিদু্যৎকেন্দ্র তৈরি করা হয়েছে। জ্বালনি সংস্থানের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নেই। চলমান এই সংকটের জন্য বিদু্যৎ খাতের অব্যবস্থাপনা দায়ী।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে