রোববার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১
এল নিনোর প্রভাব

দিন দিন গরম বাড়ছে

আলতাব হোসেন
  ১৬ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
দিন দিন গরম বাড়ছে

এল নিনো শুরু হয়ে গেছে বলে নিশ্চিত করেছেন মার্কিন বিজ্ঞানীরা। তারা আশঙ্কা করছেন, চলমান এল নিনো বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসে আটকে রাখার লক্ষ্যমাত্রাকে অতিক্রম করে যেতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চরমভাবাপন্ন এই আবহাওয়ার জন্য ২০২৪ সাল হতে পারে পৃথিবীর সবচেয়ে উষ্ণ বছর। এল নিনোর প্রভাব বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তেই দেখা যাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, এর ফলে অস্ট্রেলিয়ায় দেখা দেবে চরম খরা, যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলে বৃষ্টিপাত বেড়ে যাবে এবং দক্ষিণ এশিয়ায় দেশগুলোতে বর্ষা দুর্বল হয়ে বৃষ্টিপাত কমে যাবে এবং খরা পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।

১৮৫০ সালের পর পৃথিবীর সর্বোচ্চ গরমের বছরের রেকর্ডে ২০২৩ সাল স্থান পায়। ২০২৩ সালে ঢাকায় ৫৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এরপরই উষ্ণতম জানুয়ারির রেকর্ড গড়ল ২০২৪ সাল। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ব্যাকরণ ভুলে বৈরী হয়ে ওঠছে আবহাওয়া। ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোপার্নিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিস (সিথ্রিএস) এ তথ্য জানায়।

বিশ্বের বড় বড় বিজ্ঞানীরা বলছেন, ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সাল আরও বেশি রেকর্ড গরম হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া এটি শীর্ষ পাঁচটি উষ্ণতম বছরের্ যাংকিংয়ে স্থান পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে ৯৯ শতাংশ। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, মানবসৃষ্ট একাধিক কারণে জলবায়ু পরিবর্তন এবং পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরের ভূপৃষ্ঠে উষ্ণ পানির স্রোত বা এল নিনোর আবহাওয়ার ঘটনার কারণে পৃথিবীর উষ্ণতা অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। এ বিষয়ে জানুয়ারিতে সিথ্রিএস'র ডেপুটি ডিরেক্টর সামান্থা বার্গেস বলেন, 'শুধু রেকর্ড উষ্ণ জানুয়ারিই নয়, আমরা পুরো ১২ মাস প্রাক-শিল্প সময়ের চেয়ে ১.৫ সেন্টিগ্রেড (১.৭ ফারেনহাইট)-এর বেশি তাপমাত্রার আশঙ্কা করছি।'

বছরের শুরুতেই পৃথিবীর উষ্ণতম জানুয়ারি মাস দেখেছে বিশ্ব। মাঘ মাসে বাঘ পালানো শীতের দেখা পায়নি বাংলাদেশ। এরপর পুরো ফাল্গুন মাসে প্রখর রোদকে সঙ্গী করে সকাল শুরু হয়। বৃহস্পতিবার শেষ ফাল্গুনে দুপুর না গড়াতেই তেতে উঠে সূর্য। শেষ বিকালে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি ঝরলেও রোদের তেজ কমেনি। মাঠে-ঘাটে ঠা-ঠা রোদ দেখা যায়। এবার ফাল্গুন বুঝিয়ে দিয়ে যাচ্ছে চৈত্রে গরমের কেমন ঝাঁঝ পড়বে। সূর্য ডোবার পরও শীতল হচ্ছে না চারপাশ। প্রতিদিনই বাড়ছে তাপমাত্রা। গত কয়েক দিন ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৪ থেকে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করছে। দুর্বিষহ গরমে হাঁপিয়ে উঠছে রাজধানীবাসী। চৈত্র-বৈশাখ-জ্যেষ্ঠ তো এখনো পড়েই আছে। ঘরে ফ্যান চালিয়েও গরমকে অনেকে সামাল দিতে পারছেন না। কেউ কেউ শীতাতপ যন্ত্র (এসি) ব্যবহার শুরু করেছেন। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের ব্যবহার যত বাড়ছে, ভবনের বাইরের এলাকার তাপমাত্রা ততই বাড়ছে।

রাজধানীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য অপরিকল্পিতভাবে উঁচু ভবন নির্মাণ ও ভবনের মধ্যে উন্মুক্ত স্থান না রাখাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। ইট, বালু ও সিমেন্ট দিয়ে তৈরি হওয়ায় ভবনগুলোতে তাপ জমে থাকছে। আর উঁচু হওয়ায় এবং উন্মুক্ত স্থান না থাকায় জমে থাকা তাপ বের হতে পারছে না। গাছপালা কেটে ফেলা, জলাশয় ভরাট, যানবাহন ও কংক্রিটের স্থাপনা বেড়ে যাওয়ার কারণে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে গবেষণায় ওঠে আসে। রাজধানীর আটটি অঞ্চলের ২৫টি এলাকা এখন তপ্ত হয়ে উঠেছে। আর অন্য এলাকার সঙ্গে তপ্ত এলাকার তাপমাত্রার পার্থক্য ৩ থেকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যেখানে দিনে জমা হওয়া তাপের বেশিরভাগ রাতেও থেকে যাচ্ছে। পরদিন নতুন করে ওই এলাকায় তাপ জমা হচ্ছে। এভাবে এলাকাটি তপ্ত ভূখন্ডে পরিণত হচ্ছে। মতিঝিল, তেজগাঁও, মিরপুর, গুলশান, উত্তরা, মহাখালী, পান্থপথ, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট এলাকায় বেশি গরম অনুভূত হচ্ছে।

জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. অধ্যাপক সামসুল আলম বলেন, অতি খরা ও বৃষ্টি এল নিনো ও লা নিনো জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বন্যা, খরা, প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য দায়ী এল নিনো ও লা নিনো। লা নিনো বা লা নিনা স্প্যানিশ শব্দ। স্প্যানিশ ভাষায় নিনো শব্দের অর্থ ছেলে আর নিনা শব্দের অর্থ মেয়ে। এল নিনো শব্দের অর্থ ছোট ছেলে এবং লা নিনা অর্থ ছোট মেয়ে। প্রশান্ত মহাসাগরের শীতল পানি ও উষ্ণ পানির তারতম্য বিশ্লেষণ করে পেরুর জেলেরা এল নিনো ও লা নিনোর অস্তিত্ব খুঁজে পান। ১৯৬৩ সালে বিজ্ঞানী গিলবার্ট দেখান যে, এল নিনো বা লা নিনার সঙ্গে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ও বায়ুচাপের মধ্যে সম্পর্ক আছে। তখন বিজ্ঞানীরা নড়েচড়ে বসলেন এবং এ নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেন।

স্বাভাবিক অবস্থায় পেরু ও ইকুয়েডর উপকূলে প্রশান্ত মহাসাগর থেকে শীতল পানিতে ঝাঁক বেঁধে মাছ আসে। কয়েক বছর পরপর হঠাৎ করে মহাসাগরে উষ্ণ স্রোত প্রবাহিত হয়। গরম পানির প্রবাহ আছে। এই উষ্ণ পানিতে মাছ পাওয়া যায় না। কর্মহীন হয়ে পড়ে জেলে সম্প্রদায়। ফসলের ক্ষতি হয়। এ অবস্থার নাম এল নিনো।

এল নিনোর প্রভাব কমে আসার পর প্রশান্ত মহাসাগরে নতুন রূপে আসে অতিশীতল পানি। এ সময় জেলেদের জালে মাছ বেশি ধরা পড়ে। তখন আবহাওয়া বিরূপ আচরণ করে না। বায়ু হয়ে যায় স্বাভাবিক। বৃষ্টির দেখা মেলে। এ অবস্থাকে জেলেরা নাম দিয়েছেন লা নিনা।

ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকে প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিম প্রান্তে ইকুয়েডর ও পেরুর উপকূলের দিকে বিষুবরেখার অন্যদিক থেকে উষ্ণ পানির স্রোত আসতে শুরু করে। এর ফলে সাগরের পানির উষ্ণতা বাড়ে এবং ঝড়, খরা ও অনাবৃষ্টি হয়। সাধারণত দুই থেকে সাত বছর পরপর এল নিনো দেখা দেয়। এল নিনোর প্রভাবে তুষারঝড়, দাবানল এবং খরা সংঘটিত হয়।

শক্তিশালী এল নিনোর প্রভাবে বিশ্বের অনেক অঞ্চলের মানুষ ৪৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার দুর্ভোগে পড়ে। প্রচন্ড খরায় ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। তাপদাহে বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। অর্থনৈতিক সংকটের পূর্বাভাস দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এল নিনোর প্রভাবে বিশ্বের দ্বাদশ দীর্ঘ মেকং নদীর পানির স্তর অস্বাভাবিকভাবে নিচে নেমে গেছে। মেকং নদীবিধৌত বিশ্বের শীর্ষ চাল রপ্তানিকারক দেশ ভিয়েতনামে খরা পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। প্রতিবেশী থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়াও সংকটের মধ্যে পড়েছে। পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে মালয়েশিয়াতেও। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইএইচএস গেস্নাবাল ইনসাইট জানিয়েছে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বছরে হাজার কোটি ডলার ক্ষতির মুখে পড়তে পারে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষিবিষয়ক সংস্থা এফএও জানিয়েছে, পর্যাপ্ত মজুদ থাকায় খাদ্য সংকট এখনো তীব্র হয়ে ওঠেনি। কিন্তু সামনের দিনগুলোয় বিশ্বপরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটবে। বাংলাদেশে আমন চাষ সম্পূর্ণ বৃষ্টির ওপর নির্ভরশীল। এখন কোনো কোনো বছর ভরা বর্ষায়ও বৃষ্টির দেখা মেলে না। ফেটে চৌচির হয় ফসলের মাঠ। বাংলাদেশে আমন আবাদের ভরা মৌসুমে নদ-নদীতে পানি পাওয়া যায় না। উন্মুক্ত জলাশয়, পুকুর, খাল-বিল শুকিয়ে চৌচির হয়ে যায়।

সাধারণত এল নিনোর পরপরই লা নিনা আসে। এল নিনোর বিপরীত প্রতিক্রিয়া হিসেবে লা নিনা শুরু হয়। এল নিনোর প্রভাবে সাগরে উষ্ণ পানির স্রোত প্রবাহিত হওয়ার পরপর সাগরের পানির উষ্ণতা কমে আসে। সাগরের পানির এ উষ্ণতা কমে আসাকে লা নিনা নামে চিহ্নিত করেছেন বিজ্ঞানীরা। লা নিনার প্রভাবে অতিবৃষ্টি ও বন্যা হয়। ১৯৯৮ সালে লা নিনার প্রভাবে বাংলাদেশ ভারত ও চীনে ভয়াবহ এবং দীর্ঘস্থায়ী বন্যা হয়। বছরের শেষ দিকে লা নিনা দেখা দিলে কৃষির ব্যাপক ক্ষতি হয়।

পরিবেশ বিজ্ঞানী শুমেন্দ্র দেবনাথ বলেন, বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনে এল নিনো বা লা নিনার প্রভাব রয়েছে। বাংলাদেশের আবহাওয়া এল নিনো ও লা নিনার প্রতি সংবেদনশীল। ২০১৭ সালের বন্যায় বাংলাদেশের ভয়াবহ ক্ষতি হয়। ২০১৭ সালে লা নিনা ছিল ওই বন্যার অন্যতম কারণ। বলা হচ্ছে, ছিয়াত্তরের মন্বন্তর বা তেতালিস্নশের মন্বন্তরের কারণ ছিল এল নিনো। বাংলাদেশে যেসব বছরে খরা হয়েছে, যেমন- ১৯৭৩, ১৯৭৪, ১৯৯৭ ইত্যাদি ছিল এল নিনোর বছর। আবার যে বছরগুলোতে বন্যা হয়, যেমন- ১৯৭০, ১৯৮৮, ১৯৯৮, ২০০৬, ২০১৭, ২০২০ ও ২০২১ বছরগুলো ছিল লা নিনার বছর।

বাংলাদেশ নেচার কনজার্ভেশন ম্যানেজমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ড. এস.এম. মনজুরুল হান্নান খান যায়যায়দিনকে বলেন, ২০৫০ সাল নাগাদ দেশের উপকূল ছাড়বেন কমপক্ষে ৩৩ লাখ মানুষ। ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের প্রতি সাতজনে একজন জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে উদ্বাস্তু হবে। এ হিসাবে ২০৫০ সালের মধ্যে উদ্বাস্তু মানুষের সংখ্যা দাঁড়াবে এক কোটি ৩০ লাখ। এ তথ্য কম্প্রিহেনসিভ ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রামের। সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ বাস্তুচু্যত ব্যবস্থাপনা বিষয়ক জাতীয় কৌশলপত্রে বলা হয়েছে, ২০০৮ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে জলবায়ুর প্রভাবে সংঘটিত প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলাদেশের ৬০ লাখেরও বেশি মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছেন।

গত ১৪ ফেব্রম্নয়ারি থেকে ১৪ মার্চ পর্যন্ত ঢাকার বুকে যৎসামান্য যে বৃষ্টি হয়েছে, তা-ও কালবৈশাখীকে সঙ্গী করে। ইতিমধ্যেই দেশের অনেক এলাকায় তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গেছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ সাইফুল ইসলাম জানান, নিয়মিত কালবৈশাখী ও মৌসুমি বৃষ্টিপাত শুরু না হওয়া পর্যন্ত তাপমাত্রা কমবে না। এ বছর আবহাওয়া কিছুটা বৈরী উলেস্নখ করে তিনি বলেন, এ সময়টা মৃদু ও মাঝারি তাপদাহ সাধারণ ঘটনা। এটা প্রতি বছরই ঘটে। তবে গরম এত তীব্র হয় না।

এদিকে বৃহস্পতিবার ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) অধীন এলাকায় বায়ুদূষণ ও তাপমাত্রা কমাতে গবেষণার মাধ্যমে কারণ ও সম্ভাব্য প্রতিকার খুঁজে বের করতে তিনটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে ডিএনসিসি। সংস্থা তিনটি হলো বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস), ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ ও ঢাকা নর্থ কমিউনিটি টাউন ফেডারেশন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে