একাত্তরের ১৫ মার্চ স্বাধীনতার আন্দোলনে উত্তাল গোটা পূর্ববাংলা। পাকিস্তানের সামরিক আইনের বিরুদ্ধে জনতার সংগ্রাম তখন তুঙ্গে। এ অবস্থায় কঠোর সামরিক নিরাপত্তায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনা করতে এদিন ঢাকায় আসেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। তবে সর্বস্তরের মানুষ তার প্রতি ক্ষোভ জানায় সরকারি, আধা-সরকারি অফিস-আদালত বর্জন ও ঢাকার ভবনগুলোতে কালো পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে।
এদিকে বিমানবন্দরে তাকে অভ্যর্থনা জানান নবনিযুক্ত সামরিক গভর্নর 'বাংলার কসাই'খ্যাত লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান। প্রচলিত রীতি ভেঙে বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। সফরসূচিতেও ছিল কঠোর গোপনীয়তা।
রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী '৭১ এর দশ মাস' বইয়ে এই দিনের ঘটনাবলি সম্পর্কে উলেস্নখ করেছেন- কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আয়োজনে এই দিন পাকিস্তানের নতুন সামরিক ফরমান জারির প্রতিবাদে বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনে সভা হয়। সভায় বাংলাদেশ রক্ষায় সব নাগরিককে অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানানো হয়। সভা শেষে বিক্ষুব্ধ জনতার মিছিল কাকরাইল, বেইলি রোড হয়ে প্রেসিডেন্ট ভবনের সামনে দিয়ে অতিক্রম করে। ইয়াহিয়া খান তখন ওই ভবনেই অবস্থান করছিলেন। ভবনের সামনে সামরিক বাহিনীর বিপুল সংখ্যক সদস্যের উপস্থিতি ছিল। পরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়ে মিছিলটি শেষ হয়।
এই দিন খুলনায় আয়োজিত এক সমাবেশে ছাত্র
সমাজের নেত্রী হাসিনা বানু শিরিন বলেন, 'মহান স্বাধীনতা আন্দোলনে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও যুদ্ধ করতে প্রস্তুত।' খুলনার হাদিস পার্কের জনসভায় বাংলা জাতীয় লীগ প্রধান আতাউর রহমান খান বলেন, 'বাংলার প্রতিটি মানুষ আজ বঙ্গবন্ধুর পেছনে একতাবদ্ধ। রেডিও, টিভি, ইপিআর, পুলিশ বাহিনী, সেক্রেটারিয়েট প্রভৃতি আজ আওয়ামী লীগ প্রধানের আজ্ঞাবাহী।'
কবি সুফিয়া কামালের সভাপতিত্বে ঢাকার তোপখানা রোডে মহিলাদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বেতার ও টিভি শিল্পীরা দেশাত্মবোধক গান পরিবেশন করেন। উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সদস্যরা ভ্রাম্যমাণ ট্রাকে গণসঙ্গীত, পথনাটক পরিবেশন করেন। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে ঢাকার চেকপোস্টগুলো তুলে নেয়। চিকিৎসকরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আয়োজিত সভা থেকে অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে একাত্মতা প্রকাশ করেন এবং মুক্তি আন্দোলনের লক্ষ্যে দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হতে জনতার প্রতি আহ্বান জানান।
এই দিন পশ্চিম পাকিস্তানের জমিয়তে উলামায়ে পাকিস্তান, ন্যাপ (ওয়ালী), মুসলিম লীগ (কাউন্সিল) এবং পিডিপির নেতারা এক বিবৃতিতে ভুট্টোর ভূমিকার কঠোর সমালোচনা করেন এবং উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য তাকেই দায়ী করেন।
চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত হয় শিল্পী, সাহিত্যিক ও সাংবাদিকদের বিশাল সমাবেশ। অধ্যাপক আবুল ফজলের সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক মমতাজউদ্দিন, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান, সাংবাদিক নূর ইসলাম প্রমুখ। নেত্রকোনায় সুইপার ও ঝাড়ুদাররা ঝাড়ু, দা, লাঠি ও কোদাল নিয়ে মিছিল করেন। এছাড়া বগুড়া, রংপুর, লাকসাম, কুমিলস্না ও কুষ্টিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে স্বাধীনতার পক্ষে মিছিল-সমাবেশ হয়।
এই দিন নতুন করে শুরু হয় সাংস্কৃতিক আন্দোলন। দেশবাসীকে অধিকার বঞ্চিত করার প্রতিবাদে শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীরা তাদের খেতাব বর্জন অব্যাহত রাখেন। চারদিকে শিল্পী এবং বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এ নিয়ে ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনা দেখা যায়।
এই দিন বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার দাবিতে অটল থেকেই দেখা করতে যায় ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে। বৈঠকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
রাতে ঢাকায় তাজউদ্দীন আহমদ এক বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত অসহযোগ আন্দোলনের ব্যাখ্যা করেন এবং বলেন, 'শেখ মুজিবুর রহমানের এই আহ্বানে জনগণের নিরঙ্কুশ সাড়া পাওয়া গেছে।'