'ইফতার নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন সবাই। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ 'আগুন' 'আগুন' আর 'বাঁচাও' 'বাঁচাও' বলে চিৎকার-চেঁচামেচি। যে যার মতো পানি হাতে দৌড়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন। চোখের নিমেষেই মানুষগুলো পুড়ে গেল।' গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার তেলিচালা এলাকার পোশাকশ্রমিক স্বপন সরকার বৃহস্পতিবার সেখানে আগুন লাগার ঘটনার বর্ণনা দেন এভাবে।
বুধবার তেলিচালা এলাকায় সিলিন্ডারের ছিদ্র থেকে বের হওয়া গ্যাসে আগুন লেগে অন্তত ৩৬ জন দগ্ধ হয়েছেন। এর মধ্যে ৩৪ জনকে রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও পস্নাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগীরা জানান, যে বাসায় ঘটনাটি ঘটেছে সেখানে গ্যাস বের হতে থাকা গরম সিলিন্ডার ভেজা চট দিয়ে মুড়িয়ে বাইরে রেখে যান পরিবারের কেউ একজন। স্থানীয়দের অনেকে কী হচ্ছে সেটা দেখতে কৌতূহলী হয়ে এসেছিলেন।
ইফতারের সময় ঘনিয়ে আসছিল। পোশাক কারখানা থেকে বাসায় ফিরছিলেন অনেক পোশাক কর্মী। তাদের পাশাপাশি ঘটনা দেখতে ভিড় জমিয়েছিল আশপাশের শিশুরাও। এ সময়ই আগুন ধরে যায়।
শুরুতে বিস্ফোরণের কথা বলা হলেও পরে ফায়ার সার্ভিস ও বার্ন ইনস্টিটিউটের এক চিকিৎসক জানান, একটা ত্রম্নটিপূর্ণ গ্যাস সিলিন্ডার থেকে গ্যাস বের হচ্ছিল। বাসার মালিক সেটি বাইরে রেখে গেলে সেটি ঘিরে কিছু উৎসুক লোকজন দাঁড়িয়েছিল। এ সময়ই পাশের আরেকটি বাসায় চুলা ধরাতে গেলে পুরো রাস্তায় আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এতেই তারা সবাই দগ্ধ হন।
ওই ঘটনায় পোশাক কারখানার শ্রমিক মো. তারেকের কোমরের নিচ থেকে দুই পা পুড়ে গেছে।
তারেক বলেন, কারখানা থেকে ফিরে হইচই ফোনে বাইরে গিয়ে দেখেন গলির মধ্যে একটি সিলিন্ডারে ভেজা চট পেঁচিয়ে রাখা হয়েছে। সেখান থেকে সশব্দে গ্যাস বেরোচ্ছে। সেটি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। তখন সিলিন্ডারে ঘিরে বেশ কয়েকজনকে দেখতে পান তিনি।
ফেরার জন্য কয়েক কদম গিয়েছেন, সে সময় আগুন ধরে যায়। এ সময় আশপাশে যারা ছিলেন তারা মারাত্মকভাবে ঝলসে গেছেন।
এলাকাটি পোশাক কর্মীসহ নিম্ন আয়ের মানুষের বাস। অনেকটা বস্তির আদলে গায়ে গা লাগিয়ে টিনশেড ঘর বলে জানাচ্ছেন তারেক। এই ঘরগুলোতে ভাড়া থাকেন তারা।
পোড়া রোগী আসার
খবর শুনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন বার্ন ইনস্টিটিউটে ছুটে আসেন। তিনি রোগী ও চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলার পর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন। তিনি বলেন, 'গাজীপুর থেকে নারী ও শিশুসহ মোট ৩০ জন দগ্ধ এই ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়েছেন। রোগীদের মধ্যে ৯০ শতাংশ দগ্ধও আছে। এদের কাউকেই আশঙ্কামুক্ত বলা যাবে না।'
ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক প্রদীপ চন্দ্র দাসের অধীনেই গাজীপুরের দগ্ধ রোগীরা ভর্তি হয়েছেন। এই চিকিৎসক বলছেন, মোট ৩২ জন রোগী পেয়েছেন তারা। তিনি বলেন, 'এদের প্রায় সবারই শ্বাসনালি পুড়ে গেছে, সেই হিসেবে এদের সবাইকেই সংকটাপন্ন বলা যায়। তার ওপরে এদের ১৫ জনের শরীর পুড়েছে ৫০ শতাংশের বেশি। এদের মধ্যে সাতটি শিশু রয়েছে। দুটি শিশুর শরীর পুড়েছে ৯০ শতাংশের মতো। এদের জীবন চরম সংকটে রয়েছে।'
তিন বছরের ছোট্ট শিশু রাহিমার দুই হাত-পা সহ শরীরের অনেকটা অংশ ঝলসে গেছে। বার্ন ইনস্টিটিউটের জরুরি বিভাগে মাঝে মাঝে চোখ মেলে কেঁদে উঠছিল শিশুটি। পাশে থাকা অস্থির মা শিশুটির গালে মুখে কপালে চুমু দিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করছেন।
দগ্ধ পোশাক শ্রমিক রফিকুল ইসলাম বলেন, 'তেলিরচালা এলাকায় একটি বাসায় গ্যাসের সিলিন্ডার থেকে শো শো শব্দে গ্যাস বের হচ্ছিল। এরপর বাড়ির লোকজন সেই সিলিন্ডারটি গলির মধ্যে ফেলে যায়। ইফতারের আগে ওই গলিতে যখন অনেক লোকজন চলাচল করছিল ঠিক সেই সময় আগুন লাগে। সেই আগুনে গলিতে অবস্থানকারী ও চলাচলরত লোকজন দগ্ধ হন।' নিজে তখন ওই গলির রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন বলে জানান রফিকুল।
চিকিৎসাধীন আরিফুল ইসলাম বলেন, 'ওই গলি দিয়ে যাতায়াত করা প্রায় সবাই কম-বেশি দগ্ধ হন।'
গাজীপুর ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের উপসহকারী পরিচালক আব্দুলস্নাহ আল আরেফিন বলেন, 'তেলিরচালা এলাকায় শফিক খান তার বাসার জন্য একটি গ্যাস সিলিন্ডার আনেন। পরে সিলিন্ডারটি চুলার সঙ্গে লাগানোর সময় গ্যাস বের হতে থাকে। তখন তিনি সিলিন্ডারটি বাইরে রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দেন। এ সময় ওই স্থানে একটি মাটির চুলার আগুন থেকে সিলিন্ডারে গ্যাসে অগ্নিকান্ডের সৃষ্টি হয়। তখন রাস্তায় থাকা প্রায় অনেকে দগ্ধ হন।'
ফায়ার সার্ভিসের ওই কর্মকর্তা বলেন, স্থানীয়রা আহতদের উদ্ধার করে বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখান থেকে তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
হাসপাতালে যে ৩২ জনকে ভর্তি করা হয়েছে তারা হলেন- আজিজুল (২৪), তারেক রহমান (১৮), মশিউর আলী (২২), তায়েবা (৩), মোসাম্মৎ নার্গিস (২৫), রমিসা (৩৬), সুমন (২৫), কবীর (৩০), তাওহিদ (৭), রাব্বী (১৩), মো. সোলায়মান (৬), সাদিয়া খাতুন (১৮), শিল্পী (৪৫), মহিদুল (২৫), শারমিন (১১), মো. নাঈম (১৩), মুন্নাফ (১৮), মো. আরিফ (৪০), মনসুর আলী (৩০), রত্না বেগম (৪০), সুফিয়া (৯), জহুরুল ইসলাম (৩২), নাদেন (২২), ইয়াসিন আরাফাত (২১), রহিমা (৩), লালন (২৪), কমলা খাতুন (৮০), সুলাইমান মোলস্না (৪৫) নিলয় (৩), নীরব (৭), কুদ্দুস (৪৫), মোতালেব (৪৮)।
বার্ন ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক এস এম আইয়ুব হোসেন জানান, 'আমাদের এখানে ভর্তি ৩২ জনের মধ্যে ১৫ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। এই পনের জনের শতকরা ৫০-৯০ ভাগ পুড়ে গেছে। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।'