গ্যাস সিলিন্ডার ভয়ংকর

বাসাবাড়ি, রেস্তোরাঁর পাশাপাশি শিল্পকারখানা, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও যানবাহনে যে যার খেয়াল-খুশিমতো গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করছেন। এমনকি হাসপাতালগুলোতেও নিরাপত্তা ঝুঁকি অগ্রাহ্য করে সিলিন্ডারের গ্যাস ব্যবহার করা হচ্ছে

প্রকাশ | ১১ মার্চ ২০২৪, ০০:০০

সাখাওয়াত হোসেন
জ্বলছে চুলার আগুন। পাশেই রাখা গ্যাস ভর্তি বড় বড় সিলিন্ডার। রাজধানীর স্ট্রিট ফুডের দোকান থেকে শুরু করে ছোট-বড়-মাঝারি বেশিরভাগ রেস্তোরাঁর রান্নাঘরেই দেখা যায় এমন চিত্র। নগর-মহানগর থেকে ছোট শহরগুলোর বাসাবাড়িতেও একই অবস্থা। চুলার নিচে কিংবা এক দেড় ফুট দূরত্বে গ্যাস সিলিন্ডার রেখে চলছে নিত্যদিনের রান্না। যা প্রায়ই অগ্নিদুর্ঘটনার বড় উৎস হয়ে উঠছে। অহরহ ঘটছে অগ্নিদগ্ধ ও প্রাণহানির ঘটনা। অথচ দীর্ঘদিনেও এ নিয়ে জনসচেতনতা যেমন বাড়েনি তেমনি নজরদারিও সেই তলানিতে রয়ে গেছে। উল্টো গ্যাস সিলিন্ডারের ভয়ংকর ব্যবহার দিনে দিনে আরও বাড়ছে। বাসাবাড়ি, রেস্তোরাঁর পাশাপাশি শিল্পকারখানা, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও যানবাহনে যে যার খেয়াল-খুশিমতো গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করছেন। এমনকি হাসপাতালগুলোতেও নিরাপত্তা ঝুঁকি অগ্রাহ্য করে সিলিন্ডারের গ্যাস ব্যবহার করা হচ্ছে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সাবেক পরিচালক মেজর (অব.) এ কে এম শাকিল নেওয়াজ জানান, চুলা থেকে অন্তত দশ ফুট দূরে রাখতে হবে গ্যাসের সিলিন্ডার। তার ভাষ্য, গ্যাস সিলিন্ডার চুলা থেকে এবং রোদ থেকে দূরে রাখতে হবে। কারণ এটা নির্দিষ্ট তাপমাত্রার মধ্যে রাখা জরুরি। এছাড়া গ্যাস সিলিন্ডার কাত করে রাখা যাবে না। আবার সিলিন্ডার যে জায়গায় রাখা হবে সেখানে ভেন্টিলেশন থাকতে হবে। কারণ সিলিন্ডারের এলপিজি অনেক ভারী। এটি নিচের দিকে ট্রাপ হয়। এখানে যদি উপরের দিকে ভেন্টিলেশন রাখা হয় তবে তা কাজ করবে না। অথচ বেশিরভাগ বাসাবাড়ি, রেস্তোরাঁ, শিল্পকারখানা ও হাসপাতালে এসব ঝুঁকির বিষয়গুলো অগ্রাহ্য করা হচ্ছে। এ কে এম শাকিল নেওয়াজ আরও বলেন, সব গ্যাস সিলিন্ডার চার বছর পর পর হাড্রো টেস্টিং করা জরুরি। এলপিজি গ্যাস রিফিল করা হয় 'টেন বার' প্রেসারে। হাড্রো টেস্ট করে দেখতে হবে সিলিন্ডারটি আসলে উপযোগী কিনা। বাংলাদেশে মানদন্ড নির্ণয় করার জন্য বেসামরিক প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য কিছু নেই। বিস্ফোরক অধিদপ্তরকে চিহ্নিত করতে হবে কোত্থেকে সার্টিফাই করতে হবে। কোত্থেকে টেস্টিং করতে হবে। অথচ পর্যাপ্ত নজরদারি না থাকার কারণে এসবের কিছুই হচ্ছে না। ফলে গ্যাস সিলিন্ডার থেকে অগ্নিদুর্ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। সরেজমিন রাজধানীর ধানমন্ডি, খিলগাঁও, মিরপুর, শেওড়াপাড়া, উত্তরা, তেজগাঁও, গ্রিনরোড, যাত্রাবাড়ী, ডেমরাসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে বেশিরভাগ ব্যস্ত সড়কের ফুটপাতে হাজার হাজার স্ট্রিট ফুডের দোকান গড়ে উঠেছে। কোথাও কোথাও রাস্তার পাশেও ছোট কাভার্ড ভ্যান কিংবা ভ্রাম্যমাণ টং দোকানে গরম খাবার তৈরি করে বিক্রি করা হচ্ছে। এসব দোকানের গ্যাস সিলিন্ডার চুলা থেকে মাত্র এক দেড় হাত দূরে রাস্তা কিংবা ফুটপাতের ওপর রাখা। অগ্নি নিরাপত্তার বিষয়ে তাদের কারো সামান্য কোনো মাথাব্যথা নেই। যদিও বেইলি রোডের ভয়াবহ অগ্নিদুর্ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সিটি করপোরেশন তৎপর হয়ে ওঠায় এ নিয়ে 'চোর-পুলিশ' খেলা শুরু হয়েছে। এদিকে রেস্তোরাঁয় গ্যাস সিলিন্ডারের ভয়ংকর ব্যবহারেও সেই একই দৃশ্যের দেখা মিলেছে। অভিযানের খবর পেলে তারা গ্যাস সিলিন্ডার কিছুটা এদিক-ওদিক সরিয়ে রাখলেও পরে তা আগের জায়গাতেই এনে রাখছে। সম্প্রতি বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে অভিযান চালিয়ে সেখানকার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ধরপাকড়ের পর কেউ কেউ আপাতত ব্যবসা বন্ধ রেখেছেন। তবে বাসাবাড়ি, হাসপাতাল, শিল্পকারখানা ও যানবাহনে গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারে নতুন করে তেমন কোনো সতর্কতা চোখে পড়েনি। বিশেষ করে যেসব বহুতল অ্যাপার্টমেন্টে ঝুঁকিপূর্ণ 'বুলেট' সিলিন্ডার ব্যবহার করা হচ্ছে তাদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মিরপুর ১৩ নম্বরের রূপসী প্রো-অ্যাকটিভ ভিলেজ এলাকাটি নতুন গড়ে ওঠার কারণে সেখানে পাইপলাইনে গ্যাসের সরবরাহ নেই। তাই সবাই এলপি গ্যাস ব্যবহার করছেন। নতুন পদ্ধতিতে একসঙ্গে বাসার নিচে বা পাশে বড় সিলিন্ডার থেকে এলপি গ্যাস ব্যবহার করা হচ্ছে। এই সিলিন্ডার থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে বাসায় বাসায় সরবরাহ করা হচ্ছে গ্যাস। ব্যবহার সুবিধাজনক হলেও এভাবে এলপিজি ব্যবহার নিরাপদ নয় বলে মনে করেন বিস্ফোরক পরিদপ্তর। সংশ্লিষ্টরা জানান, এটি এলপিজির অনিরাপদ ব্যবহার। সামান্য ভুলে ঘটতে পারে ভয়ংকর দুর্ঘটনা। তাদের ভাষ্য, বাতাসের সঙ্গে মাত্র দুই ভাগ এলপিজির সংমিশ্রণই বিস্ফোরক হিসেবে বিবেচিত হয়। কোনো কারণে বাতাসের সঙ্গে এই পরিমাণ এলপিজির সংমিশ্রণ ঘটার পর তা আগুনের সংস্পর্শে এলেই বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। এলপিজি যেহেতু বাতাসের চেয়ে ভারী, তাই এই গ্যাস কখনো বাতাসে উড়ে যায় না। কোনো কারণে লিকেজ হলে তা সিলিন্ডারের আশপাশেই জমা হয়। দুই ভাগ এলপিজি যদি বাতাসের সঙ্গে মিশে থাকে তখন বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে। অথচ শুধু এই একটি এলাকা নয়, রাজধানীতে যেসব নতুন বাড়ি নির্মাণ করা হচ্ছে তার বেশিরভাগ জায়গাতে এই পদ্ধতিতে গ্যাস বিতরণ করা হচ্ছে। এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ম. তামিম বলেন, এটা মূলত একটি বুলেট আকারে সিলিন্ডারে করে বিল্ডিংয়ের বাইরে মাটিতে রাখা উচিত। বেজমেন্টে রাখা কোনোভাবেই সমীচীন নয়। উন্মুক্ত স্থানে রাখলে গ্যাসের লিকেজ হলে কোনো সমস্যা হয় না। সাধারণত নতুন বিল্ডিংয়ের মধ্যে ১০-১৫ ফুট জায়গা রাখা হয়, সেই জায়গায় এই বুলেট সিলিন্ডার বসানো যায়। কিন্তু অনেক জায়গাতেই তা হচ্ছে না। যা ভয়ংকর ঝুঁকিপূর্ণ। এদিকে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ এবং তা থেকে অগ্নিকান্ড ও প্রাণহানির ঘটনার জন্য অনেকেই নিম্নমানের সিলিন্ডার ব্যবহারকে দায়ী করলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের ভাষ্য, বাজারে রান্নার জন্য যেসব গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি হয় সেগুলো যথেষ্ট নিরাপদ। কারণ এলপিজি গ্যাস যে চাপ তৈরি করে, তার চেয়ে অন্তত চার গুণ বেশি চাপ ধারণ করার ক্ষমতা এসব সিলিন্ডারের থাকে। তাই সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঝুঁকি খুবই কম। মূলত সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে যথাযথভাবে পরিবহণ, মজুত ও ব্যবহার না করার কারণে। হ পৃষ্ঠা ২ কলাম ২ এছাড়া হোস পাইপ, রেগুলেটর, গ্যাস ভালভের দুর্বলতার কারণে লিকেজ থেকে গ্যাস বেরিয়ে সিলিন্ডারের পাশে জমতে থাকে। সামান্য আগুন এমনকি স্ফুলিঙ্গের সংস্পর্শে আসার সঙ্গে সঙ্গে জমে থাকা এই গ্যাসে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। তাই গ্যাস সিলিন্ডার, রেগুলেটর, পাইপ কেনার সময় সার্টিফাইড কোম্পানি কিংবা অনুমোদিত বিক্রেতাদের থেকে কেনার মত দেন বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া সিলিন্ডারের গায়ে মেয়াদ দেওয়া আছে কি না গ্রাহকদের তা দেখার পরামর্শ দেন তারা। সংশ্লিষ্টরা জানান, সাধারণত একটি সিলিন্ডার ব্যবহারের নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেওয়া থাকে। যেটা সাধারণত ১০ থেকে ১৫ বছর হয়। মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার কোনো অবস্থাতেই ব্যবহার করা যাবে না। সেইসঙ্গে কোম্পানির সিল, সেফটি ক্যাপ, পাইপ রাবারের রিং, রেগুলেটর ঠিকভাবে আছে কি না সেটা পরীক্ষা করে নেওয়া জরুরি। কেননা দেশে ব্যবহৃত সিলিন্ডারগুলো আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন হলেও এর অনেক নিম্নমানের যন্ত্রাংশ বাজারে ছড়িয়ে পড়েছে। অগ্নিনির্বাপক বিশেষজ্ঞরা জানান, সিলিন্ডার ভালো হলেও গ্যাস লিক হতে পারে যদি এর পাইপ, রেগুলেটর নিম্নমানের হয়। দেশের বাজারে ভালো-খারাপ দুই মানের যন্ত্রাংশই আছে। কিন্তু অনেকে না বুঝেই কম দামের মানহীন পণ্য কেনেন। আবার অনেকে অর্থ বাঁচাতে নিম্নমানের পণ্য ব্যবহার করেন। আর এসব কারণেই সিলিন্ডারের গ্যাস ব্যবহার ভয়ংকর ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তারা জানান, বেশিরভাগ দুর্ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে তারা রেগুলেটর ও পাইপের লিকেজের কারণে সিলিন্ডার বিস্ফোরণের প্রমাণ পান। মাত্র ৫ থেকে ১০ শতাংশ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে নিম্নমানের সিলিন্ডারের কারণে। এছাড়া সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহারকারীদের অসচেতনতার কারণেও বেশকিছু দুর্ঘটনা ঘটে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল বলেন, দুর্ঘটনাগুলোর আগে গ্যাসলাইনের লিকেজ থেকে স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি মিথেন গ্যাস জমা হয়। মিথেন গ্যাস দাহ্য পদার্থ। বদ্ধ রুমে বাতাসে ৫ থেকে ১৫ শতাংশ অথবা তার চেয়ে বেশি মিথেন গ্যাসের উপস্থিতি ঝুঁকিপূর্ণ। সেখানে কোনো স্পার্ক (স্ফুলিঙ্গ), ম্যাচের কাঠি বা আগুনের উৎস থাকলেই বিস্ফোরণ ও অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। অনেক সময় মিথেনের সঙ্গে যুক্ত হয় হাইড্রোজেন সালফাইড। যা নিজে দাহ্য না হলেও অক্সিজেনের উপস্থিতিতে দাহ্য হয়। মিথেন ও হাইড্রোজেন সালফাইড এক হয়ে বেড়ে যায় দাহ্যতা। সে কারণে বড় ধরনের বিস্ফোরণ হয়। এতে ভবনও ধসে যেতে পারে। সিলিন্ডার দুর্ঘটনার বিষয়ে এএসএম মাকসুদ কামাল বলেন, এ ক্ষেত্রে সচেতনতার অভাব সবচেয়ে বেশি দায়ী। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, দুর্ঘটনাকবলিত সিলিন্ডারগুলো পুরনো। এগুলো মরিচা ধরে ছিদ্র হয়ে বাইরে গ্যাস জমে দুর্ঘটনা ঘটে। প্রয়োজনের তুলনায় বেশি গ্যাস ভর্তি করলে অথবা মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায় গ্যাস ধারণের ক্ষমতা হারিয়েও সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়। অনেকে আবার বাসাবাড়িতে চুলার কাছে সিলিন্ডার স্থাপন করেন। এতে সরাসরি সিলিন্ডারে তাপ প্রবাহিত হয়ে ঘটে দুর্ঘটনা। কেউ কেউ অসাবধানতাবশত সিলিন্ডারের রেগুলেটর বন্ধ করতে ভুলে যায়। এতে গ্যাস বেরিয়েও ঘটে দুর্ঘটনা। প্রসঙ্গত, বর্তমানে দেশে ৬০ লাখের বেশি এলপিজি ব্যবহারকারী রয়েছেন। আর এলপিজি সিলিন্ডার সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন কোটি। ২০১০ সালে আবাসিকে নতুন গ্যাস সংযোগ বন্ধের পর থেকে বাসাবাড়িতে এলপি গ্যাসের ব্যবহার বাড়তে থাকে। গত কয়েক বছর ধরে গ্যাস সংকটের কারণে পাইপলাইনে গ্যাসের গ্রাহকদের অনেকেই এলপিজি ব্যবহারে বাধ্য হচ্ছেন।