অগ্নিঝরা মার্চ

ইয়াহিয়ার ফরমানে ফুঁসে ওঠে মুক্তিকামী বাঙালি

প্রকাশ | ১০ মার্চ ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
অগ্নিঝরা ১০ মার্চ আজ। সর্বাত্মক অসহযোগে স্থবির পাক প্রশাসন। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান একাত্তরের আজকের এই দিনে এক ফরমান জারি করেন। এতে তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, 'সরকারের কাজকর্মে বাধা সৃষ্টি করা হলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কেউ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সরকারি কাজে বাধা দিলে বা সামরিক বাহিনীর চলাফেরায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলে সামরিক বিধিতে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।' ঘোষণায় সামরিক বাহিনীর ১১৪ নম্বর নির্দেশ জারি করে বলা হয়, 'যদি কেউ প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে সরকারি সম্পত্তি বিনাশ অথবা সেনাবাহিনীর চলাচলে বাধার সৃষ্টি করে তবে তা সামরিক বিধিতে দন্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।' প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের এ ফরমান জারির সঙ্গে সঙ্গে পুরো দেশেই তীব্র প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের আগুন দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে। প্রতিবাদে লাখো মানুষ বেরিয়ে আসে রাজপথে। বলতে গেলে সবকিছু থেকেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে পাকিস্তান সরকার। এদিকে গোপনে পাকিস্তান সরকার সি-১৩০ বিমানে রাতের অন্ধকারে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব বাংলায় সৈন্য আনতে শুরু করে। সমুদ্রপথেও আনা হয় বিপুল অস্ত্র ও গোলাবারুদ। ৭ মার্চের ভাষণের পর সেনানিবাসে বাঙালি সৈন্যদের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। প্রতিটি ঘটনা তারা প্রত্যক্ষ করতে থাকে। সিনিয়র বাঙালি সেনা কর্মকর্তারা অত্যন্ত গোপনে একে অপরের সঙ্গে শলাপরামর্শ করে সেনাবাহিনীর ভেতরের খবর বঙ্গবন্ধুর কাছে পৌঁছে দিতে থাকেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংবাদপত্রে এক বিবৃতিতে বলেন, 'বাংলাদেশের ইচ্ছাই চূড়ান্ত। সচিবালয়, সরকারি-আধাসরকারি প্রতিষ্ঠান, আদালত, রেলওয়ে ও বন্দরসহ সবাই আমাদের নির্দেশ মেনে চলছে। বিশ্ববাসী ও পশ্চিম পাকিস্তানের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন কোনো মানুষই পাকিস্তান সরকারের জুলুম, নির্যাতন ও সামরিক হস্তক্ষেপকে সমর্থন করেনি। তবুও তারা হঠকারী চক্রান্তে উন্মত্ত হয়ে সমরসজ্জা অব্যাহত রেখেছে। রংপুর ও রাজশাহীতে সান্ধ্য আইন চলছে। পুরো দেশে আজ তারা ত্রাসের পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল উথান্ট ঢাকায় অবস্থানরত তাদের লোকদের ফিরিয়ে নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। এ নির্দেশের মাধ্যমেই তার দায়িত্ব শেষ করলে চলবে না। গণহত্যার হুমকিকে বিবেচনায় রেখে জাতিসংঘের সনদ অনুযায়ী সাড়ে সাত কোটি বাঙালির মৌলিক অধিকার সংরক্ষণেও তাকে ভূমিকা পালন করতে হবে।' বঙ্গবন্ধুর এ বিবৃতি সংবাদপত্রে ফলাও করে প্রচারিত হয়। ১০ মার্চ নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগার থেকে ৪০ জন কয়েদি পালিয়ে যাওয়ার সময় গুলিতে ১ জন নিহত ও ২৫ জন আহত হয়। প্রাদেশিক সরকারের রাজধানী ঢাকাসহ বড় বড় শহরে শুরু হয় চোরাগোপ্তা হামলা ও গেরিলা যুদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর ডাকে দেশের আপামর জনতা যেখানে জীবনের মায়া তুচ্ছ করে দেশের স্বাধীনতার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত, সেখানে জেনারেল ইয়াহিয়ার এ হুঁশিয়ারিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আন্দোলন-সংগ্রামের গন্ডি বহুগুণে বৃদ্ধি পেতে থাকে। এদিন জাতীয় লীগের সভাপতি আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভা থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের জন্য আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। এ সময় দেশের পরিস্থিতির এতটাই দ্রম্নত পরিবর্তন হতে থাকে যে, ঘটতে থাকে প্রতিদিনই নতুন নতুন ঘটনা। আন্দোলন-সংগ্রামরত জনতার উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, কেউ যেন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে বাংলার মানুষের প্রাণের দাবিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে না পারে- সেদিকে সবাইকে লক্ষ্য রাখতে হবে। নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পাশাপাশি গ্রামে গ্রামে গঠিত হতে থাকে সংগ্রাম কমিটি, চলতে থাকে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ এবং সংগৃহীত হতে থাকে অস্ত্র। বিস্ফোরণোন্মুখ জাতি দ্রম্নতই লিপ্ত হয় মুক্তিযুদ্ধে। দিশেহারা হতে থাকে পাকিস্তান সরকার ও পাকিস্তান সেনাবাহিনী। সর্বত্র শুধু একই আওয়াজ- জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর।