শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১

কবে বুঝবে বিএনপি?

হাসান মোলস্না
  ১০ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
কবে বুঝবে বিএনপি?

দেড় দশকেরও বেশি সময় ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি নির্বাচন ইসু্যতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে বার বার ভুল করে যাচ্ছে। গত চারটি জাতীয় নির্বাচনের আগে নিজেদের সঠিক অবস্থানে থাকার দাবি করলেও নির্বাচন পরবর্তী সময়ে ষড়যন্ত্র, নীল নকশা, ভুল ছিল এমন বিষয় স্বীকার করেছে দলটি। এবারেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দুই মাস দুইদিন পর দলের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরামের সদস্য মির্জা আব্বাস জানালেন, বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখার 'চক্রান্ত' তারা বুঝতে পারেনি। সঙ্গত কারণে রাজনৈতিক মহলে প্রশ্ন উঠৈছে কবে বুঝবে বিএনপি?

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে কিনা তা নিয়ে ২০০৮ সালের গোড়া থেকেই সন্দেহ শুরু হয়। নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিষয়ে খালেদা জিয়ার কিছু আপত্তি ছিল। 'বাংলাদেশ: ইমার্জেন্সি অ্যান্ড দ্যা আফটারম্যাথ (২০০৭-২০০৮)' শিরোনামের বইতে বিএনপির প্রয়াত নেতা মওদুদ আহমদ লিখেছেন যে, ছেলেদের মুক্তি এবং বিদেশ পাঠানোর বিনিময়ে খালেদা জিয়া হয়তো নির্বাচনে অংশগ্রহণের শর্ত মেনে নিয়েছিলেন। এই নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবি হয়। মাত্র ৩০ আসনে জয় পায় দলটি। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় দলের পক্ষ থেকে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ আনা হয়। পরে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল না বলে অনেক নেতাই মন্তব্য করেন। এরপর ২০১৪ সালের এক তরফা নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে ব্যাপক বিজয়ে বিএনপির অবস্থান বেশ ভালো ছিল। ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খালেদা জিয়াকে ফোন করে সংলাপে বসার কথা পর্যন্ত বলেছিলেন। কিন্তু আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায় করার ঘোষণা দিয়ে নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি। সেবার একতরফা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ টানা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসে। সেবারও নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত ভুল ছিল তা অনেক নেতাই পরবর্তী সময়ে স্বীকার করেন। এরপর ২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচনে অন্য দলের নেতার নেতৃত্বে নির্বাচনের অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত যে ভুল ছিল তা পরবর্তী সময়ে দলের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতারাও বলতে বাধ্য হন। সেই নির্বাচনে মাত্র ৭টি আসনে জয়ী হয় দলটি। আর সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচন নিয়ে শনিবার ৯ মার্চ প্রথম মুখ খুললেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে প্রচারপত্র বিতরণ ও গণসংযোগ কর্মসূচিতে তিনি বলেন, 'বিএনপি যাতে ক্ষমতায় আসতে না পারে, সে জন্য বিএনপিকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার চক্রান্ত ছিল। আমরা বুঝতে পারিনি।'

আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায় করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে বিএনপি সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনের আগে এমন ঘোষণা বিএনপির দায়িত্বশীল পর্যায়ের প্রায় সব নেতাই বলেছিলেন। তাদের হঁশিয়ারি ছিল, নির্বাচন হবে না, হতে দেওয়া হবে না।

বিএনপির দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন বর্জন করা কতটুকু সঠিক ছিল- এমন প্রশ্নের জবাবে অনেক নেতা ও বিশিষ্টজনদের মত হচ্ছে, নির্বাচন প্রতিহত করা যাবে না বিষয়টি উপলব্ধি করার পরেও বর্জন কোনোভাবেই যৌক্তিক ছিল না। কেননা, সরকার যে কোনো উপায়ে নির্বাচন সম্পন্ন করবেই। আর বিএনপির সাংগঠনিক শক্তির যে অবস্থা তাতে আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে নিজেদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন ছিল আকাশ-কুসুম কল্পনা। কিন্তু বিএনপির অনেক নেতা বিশেষ করে বিদেশে অবস্থান করা দায়িত্বশীল পর্যায়ের কয়েকজন তা বুঝতে চাননি। তারা সভা-সমাবেশে বিপুল উপস্থিতি দেখে ধারণা করেছিলেন, সরকার পতনের চূড়ান্ত আন্দোলনে জনগণ বুঝি বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো রাজপথ পস্নাবিত করে ফেলবে। বাস্তবে তা হয়নি।

বিএনপির সিনিয়র এক নেতা বলেন, জনগণের একটি বড় অংশ বিএনপির প্রতি সহানুভূতিশীল এবং সরকারের ওপর বিরক্ত। তারা সুযোগ পেলে ব্যালটে সিল মেরে তাদের সে মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটাবে। তবে বিএনপির ডাকে রাজপথে নেমে সরকার পতনের আন্দোলনকে 'সফল' করতে জানবাজ লড়াইয়ে অবতীর্ণ হবে তেমনটি নয়। অনেকেই বিএনপি নেতাদের পরামর্শ দিয়েছিলেন, বিগত দুই বছরের আন্দোলন-কর্মসূচিতে তারা যেভাবে মাঠ গরম করেছিলেন, তা থিতিয়ে আসার আগেই যে কোনো কৌশলে নির্বাচনে যাওয়া। আন্দোলনে চাঙা বিএনপি নেতা-কর্মীদের মাঠ থেকে উঠিয়ে দেওয়া সরকারি দলের পক্ষে সহজ হতো না। কিন্তু বিএনপি নেতাদের অনেকে এই পরামর্শ আমলে নিতে চাননি। তাদের যুক্তি ছিল, আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতায় রেখে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার অর্থ সরকারের গায়ে বৈধতার সিল মেরে দেওয়া। যা করা ঠিক হবে না।

এই নেতার মতে, এখানে বড় ভুল হয়েছে। কারণ একটি নির্বাচন বর্জনের অর্থ হলো একটি রাজনৈতিক দলের পাঁচ বছরের জন্য ব্যাকফুটে চলে যাওয়া। এখানে আওয়ামী লীগ থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত ছিল। ১৯৭৮ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন এবং ১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচনে জয় লাভের নূ্যনতম সম্ভাবনা নেই জেনেও শেষ অবধি তারা নির্বাচনে অংশ নিয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে