সোমবার, ১১ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ কার্তিক ১৪৩১

বাজার অস্থিরতায় ঘাটতির দোহাই

সাখাওয়াত হোসেন
  ০৯ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
রোজার পণ্য

রমজান মাস ঘিরে যেসব নিত্যপণ্য আমদানির জন্য এলসি (ঋণপত্র) খোলা হয়েছে তার সিংহভাগই দেশে চলে এসেছে। বাকি যেসব পণ্য পথে রয়েছে তা রোজা শুরুর আগেই বন্দরে পৌঁছাবে। এ ছাড়া অধিকাংশ নিত্যপণ্যের আগের মজুতও পর্যাপ্ত। সব মিলিয়ে রোজার অতি জরুরি ৬ পণ্যসহ বেশিরভাগ নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের জোগান অনেকটাই স্বাভাবিক। অথচ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট নিত্যপণ্যের ঘাটতির দোহাই দিয়ে বাজার অস্থিতিশীল করে তুলছে। এ অজুহাতে এরই মধ্যে বেশকিছু পণ্যের দাম বাড়াতে শুরু করেছে।

বাজার পর্যবেক্ষকদের আশঙ্কা, সরকারের কাছে চাহিদা ও জোগানের সঠিক তথ্য না থাকায় অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা বরাবরের মতো এবারও রমজানকে সামনে রেখে বিভিন্ন পণ্য অবৈধভাবে মজুত করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করছে। বাজারে প্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক না থাকায় ক্রেতাদের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। এতে অনেকেই চাহিদার অতিরিক্ত পণ্য কিনতে চাইছেন। ফলে বাজারে এক ধরনের অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে। আর এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট কয়েকগুণ বেশি লাভে পণ্য বিক্রি করে স্বল্প সময়ে ভোক্তার পকেটের লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।

বাজার সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, বছরের পর বছর ধরে একই ধরনের কারসাজির ঘটনা ঘটলেও প্রতিবারই ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট বিশাল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পর প্রশাসন নানা ধরনের নামকাওয়াস্তের পদক্ষেপ গ্রহণ করে। যা বাজার নিয়ন্ত্রণে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না। অথচ চাহিদা ও জোগানের সঠিক পরিসংখ্যান থাকলে এবং বাজার অস্থিতিশীল হয়ে ওঠার আগে যথাযথ নজরদারি বাড়ানো গেলে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের এ ধরনের অপতৎপরতা রুখে দেওয়া সম্ভব- যোগ করেন বাজার পর্যবেক্ষকরা।

কাস্টমসের দেওয়া পণ্য আমদানি তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, রোজায় প্রয়োজনীয় প্রধান ছয় পণ্যের মধ্যে গত বছরের চেয়ে এ বছর ছোলা আমদানি বেড়েছে ১০২ দশমিক ২১ শতাংশ। এ ছাড়া চিনির আমদানি বেড়েছে ৪৭ দশমিক ৯৯ শতাংশ। আর ভোজ্যতেল আমদানি বেড়েছে ১৩ দশমিক ৪০ শতাংশ এবং পেঁয়াজ আমদানি বেড়েছে ৫৪ শতাংশ। তবে খেজুর আমদানি কমেছে ৫৯ দশমিক ২৯ শতাংশ এবং ডাল আমদানি কমেছে ৯ দশমিক ৫৩ শতাংশ।

যদিও সরকারি বিপণন সংস্থা টিসিবি রোজা উপলক্ষে এই দুই পণ্য কম দামে বিক্রি করায় সংকট হওয়ার কথা নয়। আর পণ্য আমদানির চিত্রমতেও এবারের রোজার পণ্যের কোনো ঘাটতি নেই। তবুও রোজার আগেই লাফিয়ে লাফিয়ে দাম বাড়ছে। ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারসাজিতে এমনটা ঘটছে বলে মনে করেন বাজার বিশ্লেষকরা।

এ বিষয়ে কনজু্যমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, 'চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টমসের তথ্যমতে এবার রোজার আগে পর্যাপ্ত নিত্যপণ্য আমদানি হচ্ছে। সুতরাং বাজারে এসব পণ্যের দাম বৃদ্ধির কোনো কারণ নেই। অথচ বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, এসব পণ্যেরও দাম দফায় দফায় বাড়ছে। পণ্য পর্যাপ্ত থাকার পরও দাম বৃদ্ধির জন্য দায়ী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। আর এই সিন্ডিকেট দাম বৃদ্ধির বিষয়টি হালাল করার জন্য বিভিন্ন টকশো এবং সভা-সেমিনারে বলে বেড়াচ্ছে দেশে এবার ডলার সংকটের কারণে প্রয়োজন অনুযায়ী এলসি খোলা যায়নি। এ কারণে আমদানিকৃত পণ্যের সংকট সৃষ্টি হয়েছে।'

ব্যবসায়ীরা এরই মধ্যে বিভিন্ন পণ্যের ঘাটতির যে দোহাই দিচ্ছে তা মিথ্যা ও অহেতুক দাবি করে এসএম নাজের হোসেন বলেন, পণ্য কারা আমদানি করছে, কী পরিমাণে করছে এবং আমদানি করার পর বন্দর থেকে খালাসের পর সেগুলো কোথায় যাচ্ছে- সব তথ্য সরকারের কাছে থাকার কথা। এটি পর্যালোচনা করলে সহজেই জানা যাবে আদৌও পণ্যের কোনো ঘাটতি রয়েছে কিনা এবং ওই সংকটে পণ্যের দাম কতটা বাড়া যৌক্তিক। কিন্তু এত পণ্য আমদানির পরও কেন দাম বাড়ছে, সরকার কেন এ বিষয়ে আমদানিকারকদের কাছে জানতে চাচ্ছে না- এ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি।

আসলে এ ব্যাপারে সরকারের বা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কিংবা ট্যারিফ কমিশনের কোনো তৎপরতা নেই- এমন অভিযোগ তুলে এসএম নাজের হোসাইন আরও বলেন, দায়িত্বশীল জায়গা থেকে বলা হচ্ছে, 'বিশ্ববাজারে দাম বেড়েছে, তাই দেশেও পণ্যের দাম বেড়েছে।' তাদের এ বক্তব্য শোনার পর ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।

বাজার বিশ্লেষকদের দাবি যে অমূলক নয় তা বিভিন্ন পণ্যের চাহিদা, জোগান ও দর বৃদ্ধির চিত্র পর্যালোচনা করলে সহজেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বছরজুড়ে বাংলাদেশে ছোলার তেমন চাহিদা না থাকলেও শুধুমাত্র রমজান মাসেই ইফতারের সামগ্রী হিসেবে অন্তত ৮০ হাজার টন ছোলার চাহিদা থাকে। তারপরও বছরে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে অস্ট্রেলিয়ান ছোলার পাশাপাশি স্থলবন্দরগুলো দিয়ে প্রায় দেড় লাখ টন ছোলা আমদানি হয়। অথচ চাহিদার বিপরীতে বেশি আমদানির পরও চড়া দেশের ছোলার বাজার। যা দেশের প্রতিষ্ঠিত ছয়টি শিল্পগ্রম্নপ নিয়ন্ত্রণ করছে।

বাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, ডলার সংকটে ছোট ব্যবসায়ীরা ছোলা আমদানি করতে না পারার সুযোগে ওই ছয় শিল্পগ্রম্নপ বিপুল পরিমাণ ছোলা আমদানি করে এর সিংহভাগই গুদামজাত করে রেখেছে। রোজা শুরুর ঠিক আগ মুহূর্তে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে ছোলার দাম আরও বাড়িয়ে দেওয়া হতে পারে। অথচ করপোরেট ওই হাউসগুলোকে এখনো জোরালো মনিটরিংয়ের আওতায় আনা হয়নি। যা সাধারণ ব্যবসায়ীদেরও উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।

চট্টগ্রামের চাকতাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মহিউদ্দিন বলেন, বাজারে পর্যাপ্ত ছোলা আছে। এর কোনো সংকট নেই। সরকারের উচিত করপোরেট ব্যবসায়ীদের ওপর নজর রাখা। তাহলে তারা বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়ানোর সুযোগ পাবে না।

\হচট্টগ্রাম বন্দর সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ৬৯২ কোটি টাকা মূল্যের ৯৩ হাজার ৪৪৯ টন ছোলা আমদানি করেছে শিল্পগ্রম্নপগুলো। অথচ আগের বছরের একই সময়ে ৫৩৬ কোটি টাকার ৭৯ হাজার ৩ টন ছোলা আমদানি করা হয়েছিল। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় এ অর্থবছরের প্রথম ৭ মাসে প্রায় ১৫ হাজার টন বেশি ছোলা আমদানি হয়েছে। এ হিসাবে আসন্ন রমজান মাসে ছোলার সংকট হওয়ার কথা নয়।

অথচ রমজান মাস শুরুর তিন-চার দিন বাকি থাকলেও এরই মধ্যে ইফতারিতে ব্যবহৃত এ পণ্যের দাম বেড়েই চলছে। নিত্যপণ্যের বড় পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে পণ্যটির কেজি ১০৫ থেকে ১১২ টাকা। আর খুচরায় ১১৫ থেকে ১২৫ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। ঢাকাসহ সারাদেশে একই হারে ছোলার দাম বেড়েছে।

সাধারণ ব্যবসায়ীরা জানান, বছর দু-এক আগেও রমজানে ছোলার কেজি ছিল ৬০ থেকে ৬২ টাকা, ২০২২ সালে ৭৪-৭৫ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছিল। গত বছরের আগস্টে পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে নিম্নমানের ছোলার কেজি ছিল ৭২ টাকা। আর ভালো মানের ছোলা ছিল ৭৫ টাকা কেজি। এ বছর বাজারে নিম্নমানের ছোলার কেজি ছিল ৭৮ টাকা, ভালো মানেরটা সর্বোচ্চ ৮৯ টাকা। গত ২২ ফেব্রম্নয়ারিতেই দাম ওঠে কেজিপ্রতি ৮০ থেকে ৯৩ টাকায়।

কনজু্যমার অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী দেশে ছোলার চাহিদা বছরে দেড় লাখ টন। যদি বার্ষিক চাহিদা দুই লাখ টনও হয় তাহলে দেশে ছোলার ঘাটতি হওয়ার কথা নয়। এরই মধ্যে দেশে এক লাখ ৪০ হাজার টন ছোলা এসেছে। অনেক ছোলা পাইপলাইনে রয়েছে। এ ছাড়া গত বছরের আমদানি করা ছোলাও বাজারে আছে। তার মানে ছোলার ঘাটতি নেই।

এদিকে জোগান স্বাভাবিক থাকলেও সংকটের দোহাই দিয়ে কিছু অসাধু আমদানিকারক ও ব্যবসায়ী রমজানকে সামনে রেখে বাড়তি মুনাফা পেতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে উলেস্নখ করা হয়েছে। দাম বাড়ানোর এই প্রবণতা আগামী ১২ মার্চ থেকে শুরু হওয়া পবিত্র রমজানে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে এবং এটি বন্ধে ব্যবস্থা না নিলে রোজার মাসে বাজার অস্থির হয়ে উঠতে পারে বলেও প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ এই প্রতিবেদনটি তৈরি করে বাণিজ্য, কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট কয়েকটি কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়েছে। বাজারের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে এতে কিছু সুপারিশও করা হয়েছে।

প্রতিবেদনটিতে বেশকিছু পণ্যের স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে দামের পার্থক্য, সরবরাহ-চাহিদা পরিস্থিতি এবং প্রধান আমদানিকারকদের মজুত-আমদানি সংশ্লিষ্ট তথ্যের তুলনামূলক বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়েছে।

দেশের অসাধু আমদানিকারকরা আন্তর্জাতিক বাজারের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ বাজারেও তাদের পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে এমন অভিযোগ তুলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আমদানি আদেশের তথ্য অনুযায়ী, অনেক ক্ষেত্রে তারা আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির অজুহাত দেখিয়ে পণ্য সরবরাহের আগেই অভ্যন্তরীণ বাজারে দাম বাড়ায়। ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকদের এ ধরনের অসাধু কর্মকান্ড দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রাখে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে