ব্যাংকিংয়ে গ্রামীণ নারীদের অন্তর্ভুক্তি বাড়ছে। গ্রামীণ নারীরা ব্যাংকিংয়ে পুরুষদের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। যদিও সামগ্রিক ব্যাংকিংয়ে (শহর ও গ্রাম) নারীদের অংশগ্রহণ উলেস্নখ করার মতো নয়। পাশাপাশি ব্যাংকিং পেশাতে নারীদের অংশগ্রহণ থাকলেও তা আশানুরূপ বাড়েনি।
ব্যাংকিং খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্রামের মানুষের মধ্যে প্রবাসীর হার বেশি। আর রেমিট্যান্সের সিংহভাগ আসে গ্রামীণ নারীদের কাছে। ফলে এজেন্ট ব্যাংকিং ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। বিশেষ করে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে পুরুষদের ছাড়িয়ে গেছে নারীরা।
এজেন্ট ব্যাংকিং নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক পরিসংখ্যানে, গ্রামীণ নারীদের ব্যাংকিংয়ের এ সফলতা সামনে এসেছে। ব্যাংকিং সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সুযোগ পেলে গ্রামের নারীরাও অনেক কিছু করতে পারে এটিই তার প্রমাণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যে দেখা গেছে, ডিসেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত দেশে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের ৪৯.৮৫ শতাংশই নারী। যেখানে পুরুষদের একাউন্ট কম। পুরুষদের একাউন্ট হার ৪৮.৯২ শতাংশ। নারীদের ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে এটি একটি বিশেষ ভূমিকা রাখছে বলে মনে করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
জানা গেছে, ডিসেম্বর পর্যন্ত এজেন্ট ব্যাংকে একাউন্টের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে দুই কোটি ১৪ লাখ ১৯ হাজার ৯৭৫টি। এরমধ্যে এক কোটি ছয় লাখ ৭৭ হাজার ৯৭৭টি একাউন্ট নারীদের। ২০২৩ এর শেষ
প্রান্তিকে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে একাউন্ট বেড়েছে ৩.৫৬ শতাংশ। মহিলাদের একাউন্ট বৃদ্ধির প্রবণতা বেশি। একই সময়ে মহিলাদের একাউন্ট বেড়েছে ৩.৭৯ শতাংশ। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের ৮৫.৫৩ শতাংশ আউটলেট গ্রামীণ অঞ্চলে। ১৪.৪৭ শতাংশ আউটলেট শহরাঞ্চলে।
নারীদের মধ্যে মোবাইল আর্থিক প্রতিষ্ঠানে হিসাব খোলার হারও বেড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর (বিবিএস) প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২১ সালে মোবাইল আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ১৫ বছরের ঊর্ধ্বের ২৮ দশমিক পাঁচ শতাংশ নারীর হিসাব ছিল। ২০২২ সালে এটি কিছুটা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ২৮ দশমিক আট শতাংশ।
গ্রামীণ নারীদের ব্যাংকিংয়ে এগিয়ে থাকার কারণ হিসেবে জানা গেছে, গ্রামের মানুষের মধ্যে প্রবাসী বেশি। বিশেষ করে বিবাহিত পুরুষ প্রবাসী হলে তার স্ত্রীর কাছেই টাকা পাঠায়। ফলে নারীদের কাছে রেমিট্যান্সের অর্থ বেশি আসে। সাম্প্রতিক সময়ে মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিসের (এমএফএস) মাধ্যমে রেমিট্যান্সের অর্থ দেশে আনার সুযোগও দেওয়া হয়েছে। এর ফলে ব্যাংক হিসাবের পাশাপাশি মোবাইল ব্যাংকিংয়ে একাউন্ট খোলার প্রবণতা বাড়ছে। সে কারণে নারীদের মধ্যে এমএফএস এবং এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে ব্যাংক হিসাব খোলার প্রবণতা বাড়ছে।
এদিকে গ্রামীণ নারীদের ব্যাংকিংয়ে অংশগ্রহণ বাড়লেও সামগ্রিকভাবে (শহর ও গ্রাম) নারীদের ব্যাংক একাউন্ট খোলার হার কমছে। বিবিএসের তথ্য মতে, ২০২১ সালে ১৫ বছরের ঊর্ধ্বের ২৪ দশমিক দুই শতাংশ নারীর ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে নিজ নামে হিসাব ছিল। ২০২২ সালে এ অনুপাত নেমে আসে ২১ দশমিক ছয় শতাংশে। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে নারীদের মধ্যে ব্যাংক হিসাব খোলার হার হ্রাস পেয়েছে ২.৬ শতাংশ।
অন্যদিকে ব্যাংকিং পেশায় দীর্ঘদিন ধরে নারীদের অংশগ্রহণ থাকলেও তা আশানুরূপ বাড়ছে না। আবার ব্যাংকে নারী কর্মকর্তার সংখ্যা সামষ্টিকভাবে বাড়লেও পরিচালনা পর্ষদে নারীদের উপস্থিতি কমেছে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে নারী পরিচালক ছিলেন ১৩ দশমিক ৫১ শতাংশ। এক বছর আগে অর্থাৎ ২০২২ সাল শেষে তা ছিল ১৪ দশমিক ২২ শতাংশ।
নারীদের মধ্যে সবসময়ই জনপ্রিয় ছিল ব্যাংকিং পেশা। এজন্য ব্যাংক কর্মকর্তাদের মধ্যে প্রবেশকালীন ও মধ্যমপর্যায়ে নারীদের উপস্থিতি বেশি। কিন্তু এর পরই ওপরের ধাপগুলো থেকে ক্রমাগতভাবে ছিটকে পড়ছেন নারীরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সমাপ্ত ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে নারী পরিচালক ছিলেন ১৩ দশমিক ৫১ শতাংশ। কিন্তু এক বছর আগে অর্থাৎ ২০২২ সাল শেষে তা ছিল ১৪ দশমিক ২২ শতাংশ।
এদিকে বর্তমানে মোট ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংখ্যা দুই লাখ তিন হাজার ৬৯৬ জন। এর মধ্যে নারী কর্মীর সংখ্যা ৩৩ হাজার ৩৪৬ জন। অর্থাৎ বর্তমানে ব্যাংক খাতে নারী কর্মীর সংখ্যা ১৬ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের বোর্ডে নারী পরিচালকদের হার ছিল ৮ শতাংশ। তবে বিশেষায়িত ব্যাংকের বোর্ডে নারীদের কোনো অংশগ্রহণ ছিল না। বেসরকারি ব্যাংকের পর্ষদে ১৪ দশমিক ১৬ শতাংশ ও বিদেশি ব্যাংকের পর্ষদে ১৭ দশমিক ৫৪ শতাংশ ছিল নারী পরিচলকের হার। অথচ আগের বছর ২০২২ সাল শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের বোর্ডে নারীদের উপস্থিতি ছিল ১০ শতাংশ, বিশেষায়িত ব্যাংকের বোর্ডে ৪ শতাংশ, বেসরকারি ব্যাংকের পর্ষদে ১৪ দশমিক ৭১ শতাংশ ও বিদেশি ব্যাংকের পর্ষদে নারীদের উপস্থিতি ছিল ১৮ দশমিক ৬০ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে দেশের ব্যাংক খাতে নারী কর্মীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৩ হাজার ৩৪৬ জন। ছয় মাস আগে সংখ্যাটি ছিল ৩২ হাজার ৫৬৭ জন। সেই হিসাবে বছরের দ্বিতীয়ার্ধে ব্যাংক খাতে নারীর কর্মসংস্থান বেড়েছে। বর্তমানে ব্যাংকে নারী কর্মকর্তার হার ১৬ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
দেশে কার্যরত তফসিলি ব্যাংকের মধ্যে ৪৩টি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকে সর্বোচ্চ সংখ্যক নারী কর্মকর্তা-কর্মচারী ২২ হাজার ২৪৮ জন রয়েছেন, যা মোট কর্মকর্তা-কর্মচারীর ১৬ দশমিক ৩২ শতাংশ। আর ছয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক নারী কর্মকর্তা-কর্মচারী আট হাজার ২০৬ জন কর্মরত রয়েছেন, যা মোট কর্মকর্তা-কর্মচারীর ১৬ দশমিক ৩১ শতাংশ। এছাড়া বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংকে সবচেয়ে কম সংখ্যক নারী কর্মকর্তা-কর্মচারী ৯৮১ জন কর্মরত থাকলেও অন্যান্য ব্যাংকগুলোর তুলনায় বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে নারী কর্মকর্তা-কর্মচারীর হার সবচেয়ে বেশি ২৪ দশমিক ১৮ শতাংশ।
এ বিষয়ে ব্যাংক এশিয়ার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরফান আলী যায়যায়দিনকে বলেন, সাধারণ মানুষের মধ্যে মোবাইল ও এজেন্ট ব্যাংকিং বাংলাদেশে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। বিশেষ করে গ্রামের মহিলাদের এত আগ্রহী করবে এটি অকল্পনীয় ছিল। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে হিসাবধারীদের অর্ধেকেই নারী। এর মাধ্যমে আবারও প্রমাণ হলো হাতের নাগালে সুবিধা দিতে পারলে নারীরাও এগিয়ে যাবে।